Categories
বিজ্ঞানমন্দির |

মধুরেণ সমাপয়েৎ

579 |
Share
| ১৬ জানুয়ারী, ২০২২
ড: সায়নী মুখোপাধ্যায়

গবেষক, হেলসে বার্গেন, বার্গেন, নরওয়ে

চিত্রঋণ: diabetes.co.uk, www.news-medical.net

মিষ্টি মানেই আমাদের মনে প্রথমে যেটা আসে সেটা হল কলকাতার রসগোল্লা, শক্তিগড়ের ল্যাংচা বা বর্ধমানের সীতাভোগ বা চন্দননগরের সূর্য মোদকের জলভরা। আর বাঙালি তো মিষ্টি ছাড়া বাঁচতেই পারবে না। সমস্যা তখনই বাধে যখন এই মিষ্টিপ্রিয় বাঙালিকে মিষ্টির থেকে দূরে থাকতে বলা হয়। তবুও মন যে মানে না। প্রাণ যায় যাক, মিষ্টি খাওয়া বজায় থাক। এই মিষ্টি খাওয়ার লোভের কথা বলতে বলতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই সব মানুষদের কথা যারা ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগে ভুগছেন বা যাদের রক্তে মিষ্টির পরিমাণ বেশি হয়ে গেছে। আজকে না হয় সেই নিয়েই কিছু আলোচনায় আসা যাক। মানে, এই রোগের কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার এবং সঙ্গে কিছু সমসাময়িক গবেষণার কথা।

ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যেটিতে আমাদের রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার পরিমাণ বেশি হয়ে যায়। অন্যদিকে, আমাদের রক্তে শর্করার উপস্থিতি কিন্তু আমাদের শক্তির প্রধান উৎস। আর এই রক্তের শর্করা বা গ্লুকোস কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের খাওয়া খাবার থেকে আসে। ইনসুলিন হল অগ্ন্যাশয়ের (pancreas) দ্বারা তৈরি এমন একটি হরমোন যেটি খাদ্য থেকে গ্লুকোজগুলি আমাদের কোষগুলিতে শক্তি সরবরাহ করার জন্য ব্যবহার করতে সহায়তা করে। অনেকসময় দেখা গেছে যে, আমাদের শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন তৈরি করতে ব্যর্থ হয় অথবা আমাদের দেহের কোষগুলি এই ইনসুলিনকে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়। যার ফলাফল স্বরূপ রক্তে উপস্থিত শর্করা রক্তেই থেকে যায় এবং আমাদের কোষে পৌঁছাতে পারে না, শেষ পর্যন্ত আমাদের এই ডায়াবেটিস বা মধুমেহ রোগের সম্মুখীন হতে হয়।

এই ডায়াবেটিস এর আবার তিনটি ধরণ আছে: টাইপ 1, টাইপ 2 এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (১)।এই তিনটি ডায়াবেটিস এর ধরণের ভিতর টাইপ 2 ডায়াবেটিসটি প্রায়শই দেখা যায়। টাইপ 2 ডায়াবেটিস-এ বহু মানুষ আক্রান্ত হন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে এটি স্থূলতার একটি অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শৈশবকালেও বা যেকোনও বয়সে টাইপ 2 ডায়াবেটিসের বিকাশ ঘটতে পারে। তবে এই ধরণের ডায়াবেটিস প্রায়শই মধ্যবয়স্ক এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যায়। টাইপ 2 ডায়াবেটিস হল যেখানে আমাদের দেহে ইনসুলিনের ব্যবহার ক্ষমতার হ্রাস ঘটে। আমাদের শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণ ইনসুলিন উৎপাদনের পরেও আমাদের দেহের কোষগুলি এই ইনসুলিনকে ঠিক আগের মতো ব্যবহার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

এটা দেখা গেছে যে, টাইপ 2 ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিস মেলিটাস নামেও পরিচিত) খুব বেশি ভুল-ভাল খাবার, মানসিক চাপ, ঘুমের অভাব এবং জিনগত সমস্যার সমষ্টিগত ফলাফল।

টাইপ 2 ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাধারণত পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার মধ্যে প্রথমেই চলে আসে ফুট আলসার বা পায়ে আলসার। এছাড়াও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের হৃদরোগজনিত কারণেও ভুগতে দেখা গেছে। শুধু তাই নয়, দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা, মাড়ির রোগ, ক্লান্তি, নার্ভের ক্ষতিও ডায়াবেটিসের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ ঘটতে দেখা গিয়েছে। তাই অনেক সময়ই টাইপ 2 ডায়াবেটিস রোগীরা তাদের রোগের চিকিত্সার জন্য বাজারে প্রচলিত ওষুধ ব্যবহারের সাথে সাথে প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসকে বদলানোর চেষ্টা করছেন এবং কিছু ট্রাডিশনাল ভেষজ প্রাকৃতিক ওষুধকে ব্যবহার করছেন ডায়াবেটিসের চিকিত্সার জন্য। তবে, সঠিক জ্ঞান বা নির্দেশিকা ব্যতীত যদি তারা নিজেদের মতন করে এগুলি ব্যবহার করেন তাহলে কিন্তু বিপরীত এবং ভয়াবহ ফলাফল হতে পারে। এখন তোমাদের সেই সব ভেষজ গাছ বা প্রাকৃতিক ওষুধগুলি বলব যেগুলিকে নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে আবার অনেকক্ষেত্রে এগুলিকে ডায়াবেটিসের প্রিভেন্টিভ মেডিসিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন ধরো বেল গাছের পাতার রস, শুকনো গুঁড়ো করা পেঁয়াজ বা রসুন— এদের প্রত্যেকের কিন্তু ডায়াবেটিস কমানোর ক্ষমতার কথা জানতে পারা গেছে সাম্প্রতিক গবেষণায়। শুধু তাই নয়, এলোভেরা জুস বা নিমপাতা অথবা উচ্ছের রসের ভিতরও কিন্তু রক্তের শর্করার হার কমানোর উপাদান পাওয়া গেছে (২)।

এই খাদ্যাভ্যাসের পাশাপাশি যেটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেটি হল নিয়মিত শরীরচর্চা করা। আবার এটাও ঠিক আমার মতো ভেতো বাঙালিদের আলসেমি করে অনেকেরই নিয়মিত শরীরচর্চা করা হয়ে ওঠেনা। না! করা হয়ে ওঠেনা বললে ভুল হবে, ঠিক ইচ্ছে করে না এতো পরিশ্রম করার, এর থেকে ভাতঘুম দেওয়া অনেক আনন্দের ও স্বস্তির। কি ঠিক বলছি তো?

যাইহোক, এবার কিছু স্টেম সেল থেরাপির ম্যাজিকের কথা তোমাদের বলি।

প্রথমেই যার কথা বলব তিনি হলেন ইতালির অধ্যাপক ড: আলবার্তো বাজান। ২০০৫ সালে তাঁর ডায়াবেটিস টাইপ ২ ধরা পড়ে। তাঁর ডাক্তার প্রথমে মেটফর্মিন দিয়ে চিকিৎসা শুরু করেছিলেন। কিন্তু কোনওভাবেই এই ডায়াবেটিসকে বাগে আনা যাচ্ছিল না। আবার ঠিক সেই সময় তার ওজন বেড়ে প্রায় ১২৪ কিলোগ্রাম হয়ে যায় এবং কোনও রকম ডায়েট বা অনুশীলন-ই কাজ করছিল না। উপরন্তু তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। তার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে এগোচ্ছে দেখে তিনি ২০০৭ সালে ঠিক করেন যে স্টেম সেল থেরাপি করাবেন। বলা বাহুল্য, এই স্টেম সেল থেরাপি শুরু করার পরে ৪ মাস পর্যন্ত তাঁর রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু এরপরে আবার আস্তে আস্তে তার রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে শুরু করে। তিনি ঠিক করলেন যে তিনি খাদ্যাভ্যাসের কিছু পরিবর্তন আনবেন যাতে আরও কিছুটা সাহায্য হয় এই ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসাতে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনে তিনি অনেকটাই উপকৃত হন এবং ঠিক করেন তিনি আবার স্টেম সেল থেরাপি করাবেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় বার স্টেম সেল থেরাপির পর তিনি অভূতপূর্ব উন্নতি লক্ষ্য করেন। আমরা জানি যে একজন ডায়াবেটিক রোগীকে সাধারণত শর্করা জাতীয় খাবার খেতে মানা করা হয়। কিন্তু এই স্টেম সেল থেরাপির অভূতপূর্ব ফলস্বরূপ তিনি ২০০৯-এর অক্টোবর মাস থেকে কম শর্করা যুক্ত খাবার খেতে শুরু করার অনুমতি পান। এমনকি চার মাসের ভিতর তিনি ২৬ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেন এবং ২০০৯ এর অক্টোবরের পর থেকে তার গ্লাইসেমিক সূচকটি স্বাভাবিক মাত্রার মধ্যেই ঘোরাফেরা করে। শুধু তাই নয় তার রক্তচাপ ও কলেস্টেরল এর মাত্রাও স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। তিনি নিজেই ভাবতে পারছেন না যে তিনি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান সিঁড়িগুলিতে নির্দ্বিধায় লাফিয়ে উঠতে পারেন (৩)।

পরবর্তীকালে জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটস (National Institute of Health, USA) একটি যুগান্তকারী সমীক্ষা চালিয়ে জানতে পারে যে ঠিকঠাক খাদ্যাভ্যাস এবং শারীরিক অনুশীলন কিন্তু ডায়াবেটিসকে বিলম্বিত করতে পারে (৪)। ক্লিনিকাল ট্রায়াল প্রমাণ করেছে যে প্রতিদিন আধ ঘন্টা হাঁটা বা অন্যান্য ব্যায়াম বা কম চর্বিযুক্ত ডায়েট টাইপ 2 ডায়াবেটিসের ঝুঁকি ৫৮ শতাংশ কমিয়েছে। সুতরাং এটা বুঝতে বাকি নেই যে শুধু মাত্র ঠিকঠাক খাদ্যাভ্যাস আর শারীরিক অনুশীলন করেই ডায়াবেটিস হওয়ার প্রবণতাকে প্রায় অর্ধ শতাংশের বেশি কমিয়ে ফেলা যায়।

এদিকে ২০০৬ থেকে শুরু করে ২০১৬ পর্যন্ত যত গবেষণা হয়েছে এই ডায়াবেটিস উপর স্টেম সেল থেরাপির কার্যক্ষমতা নিয়ে সেই গবেষণা গুলির ফলাফল একত্রিত করা করা হয় ২০১৭ সালে (৪)। সেখানে দেখা যায় যে, ২০০৬ থেকে শুরু করে ২০১৬ পর্যন্ত মোট ৪৫৩ জন স্টেম সেল গ্রহণ করেন, এবং তার ভিতর সবাই যে এই স্টেম সেল গ্রহণ করার পরে টাইপ 2 ডায়াবেটিস-এর ট্রিটমেন্টে সাড়া দিয়েছেন তা নয় তবে বেশির ভাগ জনই এই স্টেম সেল নেওয়াতে উপকৃত হয়েছেন এবং তাদের রক্তে শর্করার হারও কমতে দেখা গেছে এবং চার বছর পর্যন্ত তাদের কৃত্তিম ইনসুলিন-এর উপর নির্ভরতাও কমতে দেখা গেছে। কিন্তু এই গবেষণায় অনেকগুলি প্রশ্নের সদুত্তর এখনও মেলেনি যেমন: এই স্টেম সেল এর ব্যবহার কেন সবার ক্ষেত্রে কাজ করল না বা স্টেম সেল-এর নির্দিষ্ট ডোজ কী হতে পারে এবং কত বার ট্রান্সফিউশন করতে হতে পারে ইত্যাদি। সুতরাং ডায়াবেটিস-এর চিকিৎসার জন্য এই স্টেম সেল-এর ব্যবহার এখনও অবধি পুরোপুরিভাবে অজানা ।

অন্যদিকে, ব্রাজিলে টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২১ জন প্রাপ্তবয়স্ক রোগীর সমন্বয়ে গঠিত একটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা যায় যে স্টেম সেল ইনফিউশন কমপক্ষে কয়েক বছর ধরে এই রোগের প্রতিকার করতে সক্ষম (৫)। ফ্রন্টিয়ার্স ইন ইম্মুনোলোজি জার্নাল (Frontiers in Immunology)-এ ২০১৭ সালে প্রকাশিত ফলাফলগুলি প্রমাণ করেছে যে বেশিরভাগ রোগী সাড়ে তিন বছর ধরে ইনসুলিন মুক্ত হয়েছেন এবং তার ভিতর একজনকে আট বছর ইনসুলিন ব্যবহার করতে হয়নি। এটি কিন্তু আবারও প্রমাণ করে স্টেম সেল থেরাপির কার্যক্ষমতা যেটি টাইপ 1 ডায়াবেটিসের মতো রোগকেও বাগে আনতে পারে।

তাহলে এই মধুমেহ রোগটির সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া গেল এবং এটাও বোঝা গেল যে ডায়াবেটিসকে আমরা নিজেরা পুরোপুরি ভাবে বাগে আনতে না পারলেও এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কিছুটা তো কমানোই যায় সঠিক খাদ্যাভ্যাস আর কিছু শারীরিক অনুশীলনের মাধ্যমে। তা বলে, আমি কখনোই বলছিনা যে মিষ্টি খাব না! আরে বাবা মিষ্টি না খেলে নিজেকে বাঙালিই ভাবতে পারব না। এর থেকে বরং মিষ্টিও খাব মাঝেমধ্যে, আর সঙ্গে সঙ্গে নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন আর ঠিকঠাক ডায়েটকে মেনে চলব।

মধুরেণ সমাপয়েৎ!

তথ্যঋণ: 1. Tiinamaija Tuomi. Type 1 and Type 2 Diabetes, Diabetes. 2005; 54 (2) :S40-S45. 2. Modak M, Dixit P, Londhe J, Ghaskadbi S, Devasagayam TP. Indian herbs and herbal drugs used for the treatment of diabetes. J Clin Biochem Nutr. 2007;40(3):163-173. 3. https://a1-medical-center.com/stem-cell-treatment-for-diabetes/ 4. Charatan F. Exercise and diet reduce risk of diabetes, US study shows. BMJ. 2001;323(7309):359. 5. https://www.cryo-cell.com/treatments-and-research/diabetes