Categories
ভাষাপুকুর |

মনসামঙ্গল (পর্ব ৩)

625 |
Share
| ১১ মার্চ, ২০২১
অনিল কাঞ্জিলাল

ঘন জঙ্গলে সর্পবেষ্টিত মনসা দেবী; শিল্পী: অজ্ঞাত; চিত্র সৌজন্য: wikipedia

বাণিজ্য শেষ করে সদাগর রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ডিঙায় এসে উঠল৷ এবার দেশে ফিরবে সদাগর৷ পাইক-মাঝিরা ডিঙা ছেড়ে দিল৷ চোদ্দোখানা ডিঙা নানা বাঁক দহ পেরিয়ে বাতাসের বেগে ছুটে চলল চম্পকনগরের দিকে৷ ডিঙা কালীদহে পড়তেই ভয়ানক ঝড় উঠল৷ মেঘে মেঘে ছেয়ে গেল আকাশ৷ ঝড়ের ঝাপটে তোলপাড় হয়ে উঠল কালীদহের জল৷ দেখতে দেখতে সদাগরের চোদ্দোখানা ডিঙাই ভেঙে চুরমার হয়ে ডুবে গেল জলে৷ সদাগর জলের উপর ভাসতে লাগল৷ সদাগরের হাতের হেমতাল কাঠও একটা চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল৷ ভাসতে ভাসতে এক সময় সদাগর ডুবে গেল জলের তলে৷ জল খেয়ে পেট ফুলে সদাগর আবার ভেসে উঠল জলের উপর৷ প্রাণটি হাতে করে এমনি একনাগাড়ে সাত দিন সাত রাত জলে ভেসে চলার পর সদাগর একসময় সাগরের কূলে ‘লক্ষিপুর’ নগরের ঘাটে এসে ঠেকল৷ কিন্তু কূল পেয়েও সদাগর ওপরে উঠতে পারল না৷ পরনের কাপড় তার জলে ভেসে গেছে কখন৷ এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে রইল সে জেলেদের মতো৷ মেয়েরা ঘাটে জল নিতে এসে অর্ধেক জলে ডোবা সদাগরকে দেখে কোনও দানো মনে করে ভয়ে কলসী ফেলেই আছাড় খেতে খেতে ছুটে পালাল৷

এমন সময় ঘাটে এল এক ব্রাহ্মণ৷ স্নান-তর্পণ করবার জন্যে সে জলে নামতেই সদাগর তার কাছে এক টুকরো কাপড় চাইল৷ ব্রাহ্মণ অনেক ভেবেচিন্তে ভাঙা গামছার অর্ধেকটা ছিঁড়ে সদাগরকে ছুঁড়ে দিল৷ তাই কোমরে এঁটে সদাগর লক্ষিপুর নগরের মোড়ল চন্দ্রধরের কাছে হাজির হল৷ সদাগরের দুর্দশার কাহিনি শুনে মোড়ল তাঁকে খাইয়ে-দাইয়ে খুব আদর-আপ্যায়ন করল৷ পদ্মার কিন্তু এটা সহ্য হল না৷ পাকে চক্রে সদাগরকে তিনি বিপদে ফেললেন৷ লক্ষিপুরের মোড়লের কাছে আদর-যত্ন পেয়ে সদাগর মনে মনে ভাবছিল, মোড়লের দোলায় চড়ে সে নিজের দেশে ফিরে যেতে পারবে৷ কিন্তু পদ্মার এমনই চক্রান্ত যে, মোড়ল তাঁকে চোর ঠাউরে মুখে চুনকালি মাখিয়ে গঙ্গার পাড়ে তাড়িয়ে দিল৷

নিরুপায় সদাগর কাঁটার খোঁচা খেতে খেতে বনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলল৷ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে সে কামরূপ নগরে পৌঁছাল৷ সেখানে এক বিলে ভাল ভাল বেশ কিছু মাছ সে পেল৷ মাছের পসরা নিয়ে কর্ণপুর নগরে গিয়ে সদাগর গেরস্তের ঘরে মাছ বিক্রি অনেক অনেক পয়সা পেল৷ কিন্তু পদ্মা গোপনে গেরস্তের বাড়িতে ঢুকে মাছের চুপড়ি থেকে মাছ চুরি করে তার মধ্যে সাপ রেখে দিলেন৷ চুপড়ি তুলে লোকেরা টের পেল, জেলে ব্যাটা মাছ বলে সাপ বেঁচে গেছে তাদের কাছে৷ সবাই তখন ছুটল জেলেকে ধরে আনতে৷ জেলে বলে সদাগরকে ধরে তারা বেদম পেটাল, দাড়ি উপড়ে মুখে চুনকালি লেপে দিয়ে অপমানের চূড়ান্ত করে ছাড়ল তাঁর৷

সদাগর প্রাণে বেঁচে পালিয়ে এলেন কেদার মাণিকপুরে৷ কিন্তু পালিয়েও তিনি পদ্মার হাত থেকে রেহাই পেলেন না৷ যেখানেই যান সেখানেই পদ্মা তাঁকে একটা-না-একটা দুর্ভোগের মধ্যে ফেলেন৷

বিদেশ-বিভুঁইয়ে পদ্মার চক্রান্তে এমনই নানা লাঞ্ছনা ভোগ করে সদাগর চন্দ্রধর অবশেষে  নিজের দেশ চম্পকনগরে একদিন ফিরে এলেন৷ কিন্তু দুরবস্থার মধ্যে পড়ে তাঁর চেহারা এমনই বদলে গিয়েছিল যে, তাঁর নিজের বাড়ির লোকেরাই তাঁকে প্রথমটা চিনতে পারল না৷ তাঁর ছয় ছেলের বিধবা বৌয়েরা, এমনকী তাঁর ঘরের পুরনো দাসীটাও পর্যন্ত তাঁকে চোর মনে করে বেদম মারধর করল৷ শেষে বৌ সনকা এসে তাঁর মুখে আগাগোড়া সব কথা শুনে, তাঁর হাতের চিহ্ণ দেখে তাঁকে নিজের স্বামী বলেই চিনতে পারল৷ বাড়ির লোকজনেরা তখন সদাগরকে নিয়ে তাঁর নিজের ঘরে বসাল৷ সেই সংবাদ মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল৷ চম্পকনগরের লোকেরা এসে ভিড় করল সদাগরের বাড়িতে৷ আনন্দ উৎসব শুরু হয়ে গেল চম্পকনগরে৷

বারো বছর পরে চাঁদ সদাগর ফিরে এসেছে বাণিজ্য থেকে৷ তাঁর বৌ-এর ছেলেপুলে হবে একথা সে যাবার সময়ই জেনে গিয়েছিল৷ কিন্তু এই বারো বছরের মধ্যে দেশের কোনও খবরই সদাগর পাননি৷ যাবার কিছুদিন পরেই সনকার একটি ছেলে হয়৷ স্বামীর কথা মতো সনকা ছেলের নাম রাখে লক্ষ্মীন্দর, আদর করে ডাকে লখাই৷ সেই ছেলে আজ বারো বছরের কিশোর৷ ছয় ছেলে সাপে কেটে মরার পর এই ছেলে৷ পূর্ণিমার চাঁদের মতো রূপ তাঁর৷ সদাগর দুঃখ ভুলে গেল ছেলের মুখ দেখে কিন্তু পদ্মার ওপর আক্রোশ তাঁর গেল না৷ সদাগর সকলকে জানিয়ে দিল— তাঁর রাজ্যের মধ্যে যে সাপ পেয়েও এড়িয়ে যাবে, সদাগর তার হাত-পা কেটে দেবেন, আর যে সাপ মারবে তাকে দেবেন পাঁচ তোলা সেনা৷

লক্ষ্মীন্দরের বিয়ে দিয়ে বিদ্যাধরীর চেয়েও সুন্দর বৌ ঘরে আনবেন ঠিক করলেন সদাগর৷ যত ভাট বামুনদের ডাক পড়ল সদাগরের বাড়িতে৷ কাঞ্চননগরের ভাট মাধব বামুন অনেক দেশ ঘুরেছে৷ কাশী, কাঞ্চী, উড়িষ্যা, মথুরা, দ্বারকা, অযোধ্যা, কিষ্কিন্ধ্যা, অঙ্গ, কলিঙ্গ, দিল্লি, পাটনা— কোথাও কোনও মেয়ে কেমন মেয়ে আছে সে সবই জানে৷ সদাগরকে একে একে সব দেশের মেয়ের নাম সে শোনাল৷ কোনও মেয়েকেই সদাগরের মনে ধরে না৷ শেষে মাধব ভাট উজানি নগরের সাহে সদাগরের মেয়ে বিপুলার কথা বলল৷ এই মেয়ে নাকি হারানো জিনিস ফিরে পেতে পারে, এমনকী মরা মানুষকেও বাঁচাতে পারে:

উজানি নগর          সাহে নাম সদাগর
তার ঘরে বিপুলা সুন্দরি৷
হারাইলে বস্তু পায়     মৈলে মরা জিয়ায়
রূপে গুণে জেন বিদ্যাধরী৷৷

এই মেয়েকেই সদাগরের মনে ধরল৷ ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে উজান নগরে সাহে রাজার বাড়িতে গিয়ে সদাগর মেয়েটিকে দেখল৷ রূপে-গুণে বিপুলা সত্যি সত্যিই বড় ভাল মেয়ে৷ আদর করে সকলে ডাকে তাকে বেহুলা৷ সাহে রাজার কাছে বিয়ের কথা পাড়তেই সাহে রাজা রাজি হয়ে গেল৷ ছেলে মেয়ের কুষ্ঠি দেখে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে সদাগর বাড়িতে ফিরে এল৷

কিন্তু সদাগর ভুলেই গিয়েছিল যে, বিয়েতে লক্ষ্মীন্দরের এক মস্ত বড় ফাঁড়া আছে৷ কালরাত্রিতে লক্ষ্মীন্দরকে নাকি সাপে কেটে মারবে৷ ফাঁড়ার কথা মনে করিয়ে দিতে সদাগর কেসাই কামারকে ডেকে লক্ষ্মীন্দরের জন্যে লোহার বাসরঘর গড়িয়ে দিতে আদেশ করলেন৷

পদ্মারও টনক নড়ল৷ লোহার ঘরের মধ্যে ঢুকে কালরাত্রিতে লক্ষ্মীন্দরকে যদি সাপে কাটতে না পারে, তা হলে যে আর তার মরণ নেই! পদ্মা তখনই কোটি সাপ সঙ্গে নিয়ে ছুটলেন কেসাই কামারের বাড়িতে৷

সাপের গর্জন শুনে কেসাই কামার চেয়ে দেখল, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং পদ্মা আর তার বাড়ি ঘেরাও করেছে কোটি কোটি সাপ৷ কেসাই তো থরোথর কাঁপতে থাকল ভয়ে৷ সে কিছু বলবার আগেই পদ্মা তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে, কালরাত্রিতে তিনি লক্ষ্মীন্দরকে মারবেনই, আর তাই লোহার ঘরের মধ্যে সাপ ঢোকবার মতো কোনও ফাঁক যদি কেসাই না রাখে, তাহলে তার রক্ষা নেই৷ পদ্মার কথা অমান্য করবে কেসাই কোন সাহসে? ভয়ে ভয়ে সে তুরপুন হাতে নিয়ে লোহার ঘরের এককোণে ছোট্ট একটা ছেঁদা করে দিল— এত ছোটো যে একটা সুতো শুধু তার মধ্যে ঢুকতে পারে৷

লোহার বাসর দেখে সদাগর নিশ্চিন্ত হলেন৷ কালরাত্রির কথা ভেবে সনকা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলেন৷ সদাগর তাকে অভয় দিয়ে বললেন, পদ্মাকে জব্দ করবার ব্যবস্থা সে করেছে কালরাত্রিতে ছেলে-বৌ লোহার বাসরে থাকবে, আর তাঁর সৈন্যরা বাইরে পাহারা দেবে। সাপে কী করতে পারবে লক্ষ্মীন্দরের?

ঋণ: পদ্মাপুরাণ, নারায়ণ দেব, বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর-চাঁদ সদাগর কথা