Categories
খেলার মাঠ |

মশালের আলোয় ইডেনে দিওয়ালি

1282 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
বিশ্বজিৎ দে

রেডিও উপস্থাপক ও ক্রীড়া-উৎসাহী

চিত্র সৌজন্য: circleofcricket.com; www.sportskeeda.com গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী

ইডেন গার্ডেন্স মানে রোমাঞ্চ, রোশনাই, শিহরণ আর ইতিহাস। যতবার নতুন ম্যাচ হয়েছে ইডেনে, ততবার হয়েছে নতুন কিছু। নব্বইয়ের দশককে ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দশক বলা হয়। এই সময় থেকেই দেশ বদলাচ্ছিল। জাতির জীবনে আসছিল নতুন জোয়ার। অনেক বদলের মধ্যে সবচেয়ে বড় বদলটা হল দেশের অর্থনীতিতে। উন্মুক্ত হল অর্থনীতি; বিদেশি লগ্নি আর নানান প্রযুক্তিতে সেজে উঠছিল দেশের মানুষের জীবনযাত্রা। সেই বদলের ঢেউ এসে লাগল খেলার মাঠে—ক্রিকেটে।

১৯৯৩ সাল ছিল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশান অফ বেঙ্গল-এর (CAB) ষাটতম বছর— ডায়মন্ড জুবিলী উদযাপন। সেই উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছিল ‘হিরো কাপ’। দেশের প্রথম স্পন্সরশিপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এবং দেশের এমন কোনও ক্রিকেট টুর্নামেন্ট যা টিভির পর্দায় দেখানো হয় দূরদর্শনের বাইরে। বলা ভাল এটাই প্রথম ক্রিকেট প্রতিযোগিতা যা প্রাইভেট চ্যানেলে সম্প্রচারিত হয়। ভারত, শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং জিম্বাবুয়ে ছিল এই টুর্নামেন্টের অংশগ্রহণকারী দল। পাকিস্তানও থাকবে বলেছিল, তবে একদম শেষের দিকে ৩রা নভেম্বর তারা সরে যায়। টুর্নামেন্ট চলে ৭ই নভেম্বর থেকে ২৭শে নভেম্বর অবধি। ফাইনাল ম্যাচ হয় ইডেনে, ভারত এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যে; সেই ম্যাচ ভারত জেতে আজহারউদ্দিনের নেতৃত্বে। ম্যান অফ দি ম্যাচ হন অনিল কুম্বলে (১২ রানে ৬টি উইকেট পান তিনি)। তবে ফাইনাল ম্যাচের চেয়েও যে ম্যাচ ‘হিরো কাপ’ বলতেই শিহরন জাগায় তা হল, ভারত বনাম দক্ষিণ আফ্রিকার সেমি-ফাইনাল ম্যাচ আর সেই ম্যাচে শচীন তেন্ডুলকরের করা শেষ ওভার।

প্রথমে ব্যাট ক’রে ভারত করে ১৯৫ রান। যার মধ্যে ক্যাপ্টেন আজহারউদ্দিনের ৯০, প্রবীণ আমরের ৪৮ ও তেন্ডুলকরের ১৫। রানটা মোটেও বড় ছিল না ডিফেন্ড করার জন্য। সেই সময়ে একটা ৫০ ওভারের ম্যাচে ভাল স্কোর বলতে বোঝাত ২৩৫-২৫০ রান; আর কোনও দল যদি ২৭০-২৮০ করে ফেলত, সেক্ষেত্রে ধরে নেওয়া হত যে তারাই ম্যাচটা জিতে যাবে। এই পরিসংখ্যান মাথায় রাখলে ভারতীয় দল, ম্যাচ জেতা তো দূরের কথা, ম্যাচ বাঁচানোর কাছাকাছিও ছিল না; বিশেষ করে যখন উলটো দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। যে দলে কেপলার ওয়েসেলসের মতো তুখোড় ক্যাপ্টেন, জনটি রোডসের মতো বিদ্যুৎগতির ফিল্ডার, অ্যালান ডোনাল্ডদের মতো আগুন ঝরানো বোলার, হান্সি ক্রোনিয়ের মতো ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক এবং ম্যাকমিলানের মতো নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডার থাকে, সেই দলের সঙ্গে লড়াই করাটাও একটা বিরাট ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ওদিকে ভারতের দলটাও কিন্তু দুর্বল ছিল না— বিশ্বজয়ী ক্যাপ্টেন ও বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার কপিল দেব, ফর্মে থাকা প্রবীণ আমরে ও বিনোদ কাম্বলি, অলরাউন্ডার অজয় জাদেজা আর মনোজ প্রভাকর আর ক্রিকেট দুনিয়ার মহাতারকা হবার সকল ট্যালেন্ট ও টেকনিক নিয়ে শচীন রমেশ তেন্ডুলকর আর অনিল কুম্বলে।

সেই সময় আরও একটা কথা প্রচলিত ছিল যে ইডেন কখনও আজহারকে শূন্য হাতে ফেরায় না। ইডেনে বহুবার আজহারকে মাঠে নামতে দেখেছি; কখনও ক্যাপ্টেন হিসেবে, কখনও ব্যাটসম্যান হিসেবে। ওর শরীরী ভাষা নিরুত্তাপ। মনের মধ্যে কী চলছে একেবারেই বোঝা যেত না, শুধু কথা বলত ওর শৈল্পিক ফ্লিক আর গ্লান্স। খেলার মাঠেও যে কী ভাবে কবিতা রচনা করা যায় তা আজহার ছাড়া আর কেউই জানত না। ইডেনে নামলেই আজহারের জন্য থাকত স্পেশাল হাততালি, চিৎকার আর উন্মাদনা। সেদিনও এইসব কোনও কিছুরই কমতি ছিল না।

ম্যাচ যত এগোচ্ছিল তত সহজ হচ্ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য ম্যাচটা জেতা, কারণ তারা ১৯৬-এর দিকে এগোচ্ছিল নিশ্চিন্তভাবে। ভারত একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস করছিল, তা হল রেগুলার ইন্টারভ্যালে উইকেট নিয়ে যাচ্ছিল। তবে ম্যাচের মোচড়টা এল শেষ ওভারে। জেতার জন্য দরকার ছিল মাত্র ৬ রান আর ক্রিজে ম্যাকমিলান আর অলরাউন্ডার ডি’ভিলিয়েরস। মাঠে তখন চরম উন্মাদনা এবং আগ্রহ যে শেষ ওভার কে করবে! ইডেনের নব্বই হাজার দর্শক এবং আজহার সবাই প্রায় নিশ্চিত যে কপিল ছাড়া এই গুরুত্বপূর্ণ ওভার আর কারোর জন্য নয়। তখনই আমরা দেখলাম ক্লাব হাউসের দিকে মাঠের মধ্যেই একটা ছোট্ট আলোচনা চলছে আজহারের সাথে আরও কিছু খেলোয়াড়ের আর সেখানে কপিল নেই, উনি তখন বাউন্ডারিতে দাঁড়িয়ে। আজহার ইশারায় কপিলকে ডাকলেন বল করার জন্য; কিন্তু কপিল জানালেন তিনি ওই ওভারটা করতে ইচ্ছুক নন। এরপর কপিলও যোগ দিলেন সেই মিটিং-এ। রুদ্ধশ্বাস আলোচনার পর বল তুলে দেওয়া হয়েছিল শচীনের হাতে। গোটা ইডেন হতবাক। এ কী! যে ম্যাচ তখনও জেতা যায়, সেই ম্যাচে একদম একটা নতুন বোলারকে বল দেওয়াটা কতটা যুক্তিসঙ্গত! গ্যালারিতে চলছিল সমালোচনা আজহারের এই পদক্ষেপ নিয়ে। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটসম্যানরাও বার বার নালিশ করছিলেন আম্পায়ারকে সময় নষ্টের জন্য।

এইসবের পর শচীন শুরু করলেন শেষ ওভার। প্রথম বল: অফ-ব্রেক। ম্যাকমিলান কভারে মেরে এক রান নিলেন এবং দ্বিতীয় রানের জন্য ডি’ভিলিয়েরসকে ডাকলেন এবং সেখানেই হল বিপত্তি! সলিল আংকোলার ছোঁড়া বলে রান আউট হলেন ডি’ভিলিয়েরস। ক্রিজে এলেন শেষ ব্যাটসম্যান অ্যালান ডোনাল্ড এবং ওভারের দ্বিতীয় বলটা মিস করলেন। তিন এবং চার নম্বর বলেও রান এল না। পাঁচ নম্বর বলে এক রান। শেষ বলে দরকার আর তিন রান। স্ট্রাইকারস এন্ডে ম্যাকমিলান একটা চার মেরেই ম্যাচ শেষ করে দিতে পারতেন। চেষ্টাও করেছিলেন কিন্তু সফল হলেন না, বল মিস করলেন। সেই ম্যাচ জিতে ভারত গেল ফ্যাইনালে। ইডেন সাক্ষী রইলেন এক রোমহর্ষক শেষ ওভারের ম্যাচ দেখার।

নব্বইয়ের দশকে ইডেনে খাবারের জন্য টিফিন কেরিয়ার আর জলের বোতল— এ সব নেওয়ার অনুমতি ছিল। বসার জন্য বাকেট সিট ছিল না তখন। সব সিমেন্টের সিট আর সেই সিটে বসার জন্য যে যার খবরের কাগজ নিয়ে যেত এবং পেতে বসত। ম্যাচ জিতেই সমস্ত দর্শক সিটের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল এবং গ্যালারির কোনও একপ্রান্তে দ্যাখা গেল— কিছু মানুষ ওই খবরের কাগজ লম্বা রোল করে, আগুন জ্বালিয়ে মশাল তৈরি করে ফেলেছে। তৎক্ষণাৎ মুহূর্তের মধ্যে গোটা ইডেন সেজে উঠল নব্বই হাজার মশালে। সে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। আমিও আমার এক দাদার সঙ্গে মাঠে ছিলাম এবং সেই রোমাঞ্চকর মুহূর্তের সাক্ষী হলাম ওই রকম মশাল জ্বালিয়ে। ইডেনে তখন দেওয়ালির রোশনাই আর যুদ্ধ জয়ের আনন্দ। মশালে মশালে মিলে গিয়েছিল আসমুদ্রহিমাচল। প্রথম ফ্লাড লাইটের আলো আর মশালের আগুন জাগিয়ে তুলেছিল নতুন ভারতকে। নতুন ভারতের ক্রিকেটের প্রজন্মকে।

আজহারকে কখনও ইডেন খালি হাতে ফেরায় না! এই ইডেনেই ‘হিরো কাপ’ জিতে আজহার আমেদাবাদ ফিরেছিলেন এবং রচনা হয়েছিল ভারতের ক্রিকেটীয় ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের। উদয় ঘটেছিল শচীন রমেশ তেন্ডুলকর নামক এক মহাতারকার যিনি পরের প্রায় আড়াই দশক বিশ্ব ক্রিকেটে রাজত্ব করেছেন মহাসমারোহে।