Categories
বিজ্ঞানমন্দির |

মাধ্যাকর্ষণের নতুন চিন্তাধারা

699 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
সাত্যকি বন্দ্যোপাধ্যায়

নবম শ্রেণির ছাত্র, বিজ্ঞান-উৎসাহী

(বাঁদিক থেকে প্রথম) আইজ্যাক নিউটন, (মাঝখানে) অ্যালবার্ট আইনস্টাই্‌ন, (ডানদিকে) মাধ্যাকর্ষণের কল্পিত গ্রাফিক্স; চিত্র সৌজন্য: Wikipedia

১৬৬৬ সালের গ্রীষ্মের দুপুর৷ ইংল্যান্ডের লিঙ্কনশায়ার প্রদেশের উল্সথর্প গ্রামে আপেলের বাগানে গাছের ছায়ায় বসে একটি যুবক পরম মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিল৷ তার নাম আইজাক নিউটন৷ হঠাৎ গাছ থেকে একটা আপেল টুপ করে পড়তে দেখে নিউটনের মনে এক রোমাঞ্চকর প্রশ্ন জেগে উঠেছিল৷ তা হল কীসের টানে আপেলটি পড়ল? এই প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে করতে নিউটন একদিন প্রকৃতির বৃহত্তম শক্তির দ্বার খুলে দিলেন৷ এই শক্তিই হচ্ছে মহাকর্ষীয় শক্তি অথবা গ্র্যাভিটি৷

এই বহু পরিচিত গল্প আজ কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে৷ নিউটন শুধুমাত্র একটি আশ্চর্য শক্তিই আবিষ্কার করেননি বরং পৃথিবীর ওপর কার্যকরী এই শক্তিটির মাধ্যমে মহাবিশ্বের বিভিন্ন ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ দিয়েছিলেন৷ পৃথিবীর বুকে আপেল পড়া আর মহাকাশে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা যে একই শক্তির প্রভাবে হচ্ছে তা তিনি বুঝিয়েছিলেন৷ জাগতিক এবং মহাজাগতিক আকর্ষণের শক্তিকে একই সূত্রে বেঁধেছিলেন নিউটন (unification of the terrestrial and the celestial)৷ তাই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মহাআকর্ষণ বা মহাকর্ষ নামেও খ্যাত৷

এবার আসা যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রে৷ তিনি দেখিয়েছিলেন যে, মহাবিশ্বের সমস্ত বস্তুই মাধ্যাকর্ষণ নামক এক শক্তিতে আকৃষ্ট হচ্ছে অন্য সমস্ত দিকে৷ কিন্তু তাহলে যে সব বস্তুই অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে লেগে যাবে? এই উত্তর খুঁজতেই নিউটন সামনে আনেন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র৷ তিনি বলেছিলেন যে, দুটি বস্তুর মধ্যে যে শক্তি কাজ করে সেটি বস্তু দুটির ভরের সঙ্গে সমানুপাতিক এবং তাদের কেন্দ্রের মধ্যের দূরত্বের বর্গের সঙ্গে ব্যস্তানুপাতিক৷

নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র মানুষের কাছে বিজ্ঞানের একটি বড় এবং অজ্ঞাত সত্যকে উন্মোচিত করেছিল৷ মানুষ বুঝেছিল যে পৃথিবী এবং মহাকাশকে একই সূত্র দ্বারা বর্ণনা করা সম্ভব৷ এই ধারণার সাথে মানুষ বিজ্ঞানের বহু তথ্য আয়ত্ত করেছিল৷ কিন্তু এই অসাধারণ মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের মধ্যে একটি গভীর অজ্ঞাত জিনিস লুক্কায়িত ছিল৷ নিউটন মহাকর্ষীয় শক্তিকে বর্ণনা করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি এটি বোঝাতে অক্ষম ছিলেন যে সূর্য পৃথিবীর ওপরে ১৪ কোটি কিলোমিটার শূন্যের মধ্য দিয়ে কী করে কোনও শক্তি প্রয়োগ করতে পারে৷ এই চিন্তা তখনকার জন্য গোপন থাকলেও নিউটনীয় মহাকর্ষের জয়যাত্রার প্রায় ২০০ বছর বাদে ভাবিয়ে তুলেছিল জার্মানির আল্ম শহরের অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে৷

আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে নিজের আবিষ্কৃত তথ্যগুলিকে একে একে সামনে আনেন এবং এই সবগুলোই বিজ্ঞানের সম্পর্কে আমাদের ধারণা পরিবর্তিত করে ফেলেছিল৷ আলো, কণার গতি, তরঙ্গ এবং আপেক্ষিকতা সম্পর্কে সবকালের চিন্তাধারাকে বদলে দিয়েছিলেন তিনি৷ তাই ১৯০৬ সালটিকে ভৌতবিজ্ঞানের বিপ্লবের সাল হিসেবে ধরা হয়৷ এরপর মহাবৈজ্ঞানিক অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এমন এক আপেক্ষিকতার খোঁজে মগ্ন ছিলেন, যা সমস্ত স্থানে সব প্রকারে কার্যকরী হবে৷ দশ বছর এ বিষয় নিয়ে চিন্তা করে করে ১৯১৫ সালে তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতার সূত্র (General Relativity) সামনে আনেন৷ আর অদ্ভুতভাবে এই নীতি অনুসারে মহাকর্ষকে এক অন্য রূপ দিলেন তিনি৷ এটি খুবই অস্বাভাবিক ব্যাপার কারণ কারও কখনও চিন্তাতেই আসেনি যে আপেক্ষিকতা আর মহাকর্ষ একইভাবে কাজ করে৷

আইনস্টাইন দেখালেন যে সারা মহাবিশ্ব একটি দেশকালের জালের ওপরে স্থায়ী৷ এই জালটি আসলে ১০টি সমীকরণের সমষ্টি (Graph of 10 dimensions)৷ যখনই কোনও ভারী গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র অথবা অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুবিশেষ এই জালের ওপরে সৃষ্টি হয়, তখন একটি বিকৃত আকার তৈরি হয় যাকে বলা হয় দেশকালের বিকৃতি৷ যদি বস্তুটির চেয়ে কম ভরের অন্য কোনও বস্তু এই বিকৃতির মধ্যে এসে পড়ে তাহলে এটি বিকৃত জালের ওপর প্রদক্ষিণ করতে থাকবে৷ অর্থাৎ বস্তুটির মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মধ্যে আবদ্ধ হবে৷ আইনস্টাইন বলেন যে মাধ্যাকর্ষণ কোনও শক্তিই নয়, এটি শুধু মহাবিশ্বের বিকৃত জ্যামিতি৷ এখান থেকেই আইনস্টাইন মাধ্যাকর্ষণ সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন৷

মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে জানার অদম্য কৌতূহল এখনও চলছে৷ কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে প্রকৃতির চারটি শক্তিকেই কণা দ্বারা ব্যাখ্যা করা সম্ভব৷ কিন্তু এক্ষেত্রে আমরা আইনস্টাইনের মাধ্যাকর্ষণকে লঙ্ঘন করি কারণ তিনি বলেছিলেন যে মাধ্যাকর্ষণ দেশকালের জ্যামিতি মাত্র এবং তা কখনই কোনও কণা বহন করতে পারে না৷ এখন গ্র্যাভিটন নামক একটি কণার অস্তিত্ব আমরা ধারণা করতে পারি মাত্র কিন্তু তা এখনও অজানা৷ তাই মাধ্যাকর্ষণকে বোঝার জন্যে অনেক পথ এখনও আমাদের অতিক্রম করা বাকি৷

এটা একটা অবাক করা বিষয় যে, যে শক্তির প্রভাবে আমরা সকলে বেঁচে আছি, সৌরমণ্ডল স্থায়ী এবং মহাবিশ্বের প্রতিটি ঘটনা ঘটছে, সেই শক্তিকেই আমরা এখনও চিনতে পারিনি৷ মাধ্যাকর্ষণ না থাকলে না আমি এই পেনটা ধরে লিখতে পারতাম না। এই লেখাটি কারও কাছে পৌঁছত না৷ আমাদের মধ্যে যারা বিজ্ঞান ভালবাসে, তারাই হয়তো একদিন এই অজ্ঞাত স্থান পূর্ণ করবে৷ আমরা এখনও সেই শক্তিকেই বুঝতে পারিনি যেটি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে৷ তাই এটা বলাই যায় যে, আমরা হয়তো এখনও পর্যন্ত কিছুই বুঝিনি৷ অজ্ঞাত মহাবিশ্বকে জানার প্রচেষ্টা করতে করতেই একদিন হয়তো প্রাণের অস্তিত্ব মুছে যাবে পৃথিবীর বুক থেকে৷ কিন্তু সে কথা স্মরণ না করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে নতুন কিছু জানার ইচ্ছায়৷ নিউটন এবং আইনস্টাইনের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আমরা একদিন না একদিন মাধ্যাকর্ষণের মূল রূপকে হয়তো চিনতে পারব।

ঋণ: Einstein for Everyone, Robert L. Piccioni; মহাকর্ষর কথা, সুকন্যা সিংহ, সম্পাদক―পলাশবরণ পাল