Categories
রকমারিনগর |

মানিকদর্শন

302 |
Share
| ১ মে, ২০২৩
ড: অশোক গঙ্গোপাধ্যায়

বিশিষ্ট চিকিৎসক ও নাট্যকর্মী

ছবি: ইন্টারনেট থেকে গৃহীত

জীবনে এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যা ঘটার সময় মনে হয় যেন স্বপ্ন দেখছি এবং পরে স্মৃতির পাতায় সেগুলো জায়গা করে নেয় রূপকথার গল্পের মতো। তেমনই আমার জীবনের রঙিন স্মৃতি স্বয়ং সত্যজিৎ রায়কে ঘিরে।

আমি দক্ষিণ কলকাতার মাধব চ্যাটার্জী লেনের বাসিন্দা। যে সময়ের গল্প বলছি তখন সময়টা ওই সত্তর দশকের মাঝামাঝি। ঘটনাটা ঘটেছিল এক রাতে। তখন মাধব চ্যাটার্জী লেন ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার আবার একটু রাত জেগে পড়াশোনা করার ও বাজনা বাজানোর অভ্যাস ছিল। সেই রাতে আমি তখন সবে বাজনা বাজানো শেষ করে বই পড়া শুরু করেছি। হঠাৎ শুনলাম মাইকের আওয়াজ। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম বারোটা চল্লিশ বাজছে। বেরিয়ে পড়লাম রাস্তায়। দেখলাম দিনের আলোর মতো আলো। মাধব চ্যাটার্জী লেনের গলিটা ওই মধ্যরাত্রে একদম দিনের মতো দেখাচ্ছে। রাস্তার মাঝখানে একটা জটলা। আওয়াজ এল ‘স্টার্ট ক্যামেরা। সাইলেন্স।’ বেশ মেজাজি গলায় শুনলাম ‘সাইলেন্স’ কথাটা। কালো কাপড়ের আড়ালে ঢাকা এক জলদগম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে সবাই চুপ করে গেল। ক্যামেরাটা এগিয়ে আসছে, গলিটাকে ধরছে।
সামনে দু’-একজন লোক হাঁটাচলা করছে, এমন সময় ‘কাট’।
হয়ে গেল শট নেওয়া।
একজন ক্যামেরাম্যান বললেন— ‘মানিকদা, একটা কুকুর চলে গেল যে। আরেকটা শট নেব।’
কালো কাপড়ের আড়াল থেকে উত্তর এল ‘না, আমি তো ওইটাই চাইছিলাম।’

তারপর হঠাৎ ক্যামেরার কালো কাপড় সরিয়ে উনি উঠে দাঁড়ালেন। সেই প্রথমবারের জন্য সামনে থেকে দেখলাম সত্যজিৎ রায়কে। দীর্ঘকায় একজন মানুষ, গমগমে গলা— প্রথমবার দেখে যেন তাকিয়েই থাকলাম!

এরপরের শট মুকুলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওই এই গলিটা— মোড়ের মাথা থেকে শটটা নেওয়া হল।তাহলে বুঝতেই পারছ কোন সিনেমা!
হ্যাঁ, সোনার কেল্লা।
পুরো শুটিং জুড়ে আমি দেখলাম যে ওঁকে ঘিরে অনেকে থাকলেও ক্যামেরাতে ফাইনাল শটটা উনি নিজেই নিচ্ছিলেন।
আর সেই গলা!
ওই মধ্যরাত্রে মাইকে সত্যজিৎ রায়ের গলার স্বরের যেন প্রতিধ্বনি হচ্ছে। সোনার কেল্লার দু’টো শট সেদিন দেখেছিলাম।
প্রায় চল্লিশ মিনিট ধরে চলেছিল।
কখনও লাইট ঠিক করছেন, ক্যামেরায় মাঝে মাঝে চোখ রাখছেন, কাউকে কোনও নির্দেশ দিচ্ছেন আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি ভিড়ের মধ্যে।

একবার ওনার বাড়িতে গিয়ে ওনার সঙ্গে দেখা করার একটা ছোট্ট অভিজ্ঞতার কথা বলি।
আমি ক্যালকাটা সিনে ইনস্টিটিউটের সদস্য ছিলাম।
ক্যালকাটা সিনে ইনস্টিটিউটের একটা পত্রিকা বেরত।
পাবলিকেশনটা আমার বন্ধু ভাস্কর দেখত।
পত্রিকা বেরলেই প্রথমে এক কপি সত্যজিৎ রায়কে দিয়ে আসতাম আমরা।
উনি সেটা নিতেন, পড়তেন এবং দু’একবার কিছু পরামর্শও দিয়েছিলেন ওই পত্রিকার ব্যাপারে।
একবার ভাস্কর আমাকে বলল, ‘যাবে? আজ লম্বার কাছে যাচ্ছি।’
এমন সুযোগ কি কেউ ছাড়ে। আমিও সঙ্গী হলাম ভাস্করের।
বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে গেলাম, দরজাটা স্বয়ং সত্যজিৎ, রায়ই খুললেন। দীর্ঘাকার একজন মানুষ, চাদরটা নামাবলির মতো গায়ে জড়ানো।
আমাদের দেখে বললেন, ‘ও, বেরিয়ে গেছে পত্রিকা? দাও!’ বলে হাত থেকে পত্রিকাটা নিয়ে ধন্যবাদ জানালেন।
আমরাও আর কথা না বাড়িয়ে আসছি’ বলে বেরিয়ে এলাম।
উনি কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করলেন না।
ততক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা চোখের আড়ালে চলে যাই।
এই ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লেগেছিল।
তাই বিশেষ করে এই মুহূর্তটার কথা আমার স্মৃতিতে উজ্জ্বল রয়েছে।