Categories
গল্পগ্রাম |

মেষ ডেকে যায় অন্ধকারে

693 |
Share
| ১৭ অক্টোবর, ২০২০
কাকাতুয়া

গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী


নিরঞ্জন হালদারের সঙ্গেই কিনা এইভাবে দেখা হয়ে গেল। তাও আবার জলদাপাড়ার ফরেস্ট বাংলোতে! নিরঞ্জনবাবু সিনিয়ার ফরেস্ট অফিসার। ভারতের নানা জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর বিরাট অভিজ্ঞতা আছে ওঁর। নানা পত্রপত্রিকায় নিরঞ্জনবাবুর লেখা বহুদিন ধরেই পড়ছি। আজ বেথলা নিয়ে লিখছেন তো কাল পেরিয়ার ন্যাশনাল পার্ক নিয়ে লিখছেন। ওঁর লেখার আমি বরাবরের ভক্ত। ওঁর ওই লেখা থেকেই প্রথম জানতে পারি যে উত্তরবঙ্গের ইণ্ডিয়ান গাউর, চিতাবাঘ বা হাতির চেয়েও বেশি হিংস্র। চিতাবাঘ বা হাতি তাড়া করলে রেহাই পাওয়া গেলেও যেতে পারে, কিন্তু গাউর তাড়া করলে পালানো মুশকিল। ওরা শিং দিয়ে একটা পুরো জিপকে চারজন মানুষসমেত উলটে দিতে পারে। নিরঞ্জন হালদারের লেখা থেকে তথ্য জোগাড় করে কতবার যে আমার অফিস এবং পরিবারের লোককে তাক লাগিয়ে দিয়েছি, কী বলব! আর সেই নিরঞ্জন হালদারের সঙ্গে যে এইভাবে দেখা হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি।

অফিস থেকে দিন তিনেকের ছুটি নিয়ে আমরা তিনবন্ধু— আমি, প্রশান্ত আর অর্ণব এসেছিলাম জলদাপাড়ার ফরেস্ট বাংলোতে নিরিবিলিতে সময় কাটাতে। আর সেখানেই দ্বিতীয় দিন সকালে অপ্রত্যাশিতভাবেই মুখোমুখি হলাম নিরঞ্জন হালদারের। তিনিও দিন কয়েক থাকতে এসেছেন ওখানে।
প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর নিরঞ্জনবাবু বললেন, ‘সন্ধেবেলা কী করছেন? হাতে সময় থাকলে একটু আড্ডা দেবেন নাকি?’
ওঁর সঙ্গে আড্ডা! মনটা লাফিয়ে উঠল—বললাম—‘অবশ্যই দেব! এ তো আমাদের পরম সৌভাগ্য!’
নিরঞ্জনবাবু বললেন, ‘ঠিক আছে তাহলে। আজ ঠিক সাতটা নাগাদ চলে আসুন। আমার ঘরের বারান্দায় বসা যাবে।’

সারাদিন জলদাপাড়া অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করে বিকেলের দিকে সাফারি সেরে ফিরছি যখন, তখন আকাশজুড়ে গোধূলি নামছে। সূর্যাস্তের শেষ আলোয় গাছের মাথাগুলো রাঙা হয়ে উঠেছে। বনের গভীরে নেমেছে ছায়া। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই গহন অন্ধকারে ঢেকে যাবে পৃথিবীর মুখ। যারা জেগেছিল, তা ঘুমিয়ে পড়বে। যারা লুকিয়ে ছিল, তারা বেরিয়ে আসবে। গাছপালার তীব্র ঘ্রাণের আস্তরণ সরিয়ে ডেকে উঠবে হাতির পাল, গাউর, চিতা। চাঁদ তার আধখানা ঘোমটা খুলে ঝরিয়ে দেবে রূপোলি জ্যোৎস্না হরিণের শরীরে। রাতের জঙ্গল তার দাঁত, নখ বের করে শিকারের অপেক্ষা করবে। সে বড় ভয়ঙ্কর অপেক্ষা। রাতের জঙ্গল মানুষের জন্যে নয়; তা শুধুমাত্র নিশাচর প্রাণীদের জন্যে।


সন্ধে সাতটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম নিরঞ্জনবাবুর ঘরে। তিনি আমাদের আপ্যায়ন করে বারান্দায় বসালেন। বেয়ারা গরম চা আর ভেজিটেবল চপ দিয়ে গেল। বাইরের অন্ধকার আলকাতরা মাখানো। চতুর্দিক থেকে পোকামাকড়ের আওয়াজ কানে আসছে। কানে আসছে রাতচরা পাখির ডাক। আর আসছে বুনো লতাপাতার তীব্র গন্ধ। নিরঞ্জনবাবু তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলি উপুড় করলেন সেদিন। নানা ধরনের গল্প বলতে লাগলেন।
হঠাৎ অর্ণব ফস করে বলে উঠল, ‘স্যার, আপনি জঙ্গলে ভূত দেখেছেন?’
আমরা বাকি দুজন হাঁ-হাঁ করে উঠলাম, ‘কী রে বাবা! অর্ণবটার কি মাথা খারাপ হল?’
প্রশান্ত বলল, ‘সত্যিই ভাই, তোকে নিয়ে আর পারা গেল না! জঙ্গলে এতকিছু থাকতে শেষে ভূত?’
অর্ণবও দমবে না— ‘কেন, জঙ্গলে ভূত থাকবে না কোথায় লেখা আছে? ধরা যাক জঙ্গলে যে লোকটাকে বাঘে খেল, সে যে ভূত হয়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে না তার কী প্রমাণ আছে!’
আমি বললাম, ‘বোকা-বোকা কথা বলিস না তো! এরকম আবার হয় নাকি!’
অর্ণব বলল, ‘কেন হয় না? হতেই পারে!’
প্রশান্ত বলল—‘কিছু মনে করিস না অর্ণব, এইটা তোর একটা মহাসমস্যা! প্রত্যেকটি বিষয়ে একটা ভৌতিক অ্যাঙ্গেল টেনে না আনলে তোর ভাত হজম হয় না।’
অর্ণব বলল, ‘হয় না তো হয় না। তাতে তোর কী! আমি তো স্যারকে জিজ্ঞেস করেছি! তোকে তো করিনি! ওঁকেই বলতে দে না! তুই কেন মাঝখান থেকে ব্যাগড়া দিচ্ছিস!’
নিরঞ্জন হালদারের সামনে আমাদের কথোপকথনটা একটা ঝগড়ায় পরিণত হল। নিরঞ্জনবাবু এই দৃশ্য দেখে মৃদু হেসে হাত তুলে থামার ইঙ্গিত করলেন। আমরা চুপ করলুম। আমার নিজেরই লজ্জিত লাগছিল। নিরঞ্জনবাবু একটা সিগারেট ধরিয়ে নিচু গলায় বলতে লাগলেন, ‘জঙ্গলে ভূত আছে কী নেই, তা আমি বলতে পারব না; কিন্তু আমি নিজে একবার একটা অদ্ভুত ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলুম, যেটা আমাকে একটা সময়ে খুব নাড়িয়ে দিয়েছিল। তোমরা কি শুনবে সেই গল্প?’
অর্ণব যেন হাতে চাঁদ পেল। সে উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘অবশ্যই শুনব স্যার! আপনি বলুন।’ নিরঞ্জনবাবু বলতে শুরু করলেন। আমরা সবাই কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম তাঁর গল্প।


‘আজ থেকে প্রায় বছর তিরিশেক আগেকার কথা। তখন আমার বয়সও অল্প। সবেমাত্র ফরেস্ট ডিপার্টমেণ্টের চাকরিটা পেয়েছি। পোস্টিং কুমায়ুনের চৌখাম্বায়। উঠেছি জঙ্গলের ধারে বনদপ্তরের বাংলোতে। আজও মনে আছে প্রথম রাত। বসে আছি বারান্দায়। সমস্ত জঙ্গল জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। ঝিঁ-ঝিঁর ডাকে ভরে আছে চারপাশ। কখনও রসুইখানার পাঁচিলের দিক থেকে দু-একটা বেড়ালের ঝগড়ার আওয়াজ কানে আসছে। দূরে কোথাও একদল শেয়াল চেঁচিয়ে উঠল। গাছ থেকে গাছে ‘খুররররর-খুররররর’ করে ডেকে হুড়মুড়িয়ে উড়ে গেল প্যাঁচা।
বাংলোর কেয়ারটেকার লছমন সিং এসে বলল, বাবুজী চায়ে পিয়েঙ্গে?
—চা? হ্যাঁ, দাও।
লছমন সিং এসে আদা দেওয়া গরম চা দিয়ে গেল। চা খেতে খেতে তাকিয়ে দেখছিলাম কীভাবে পাইনগাছের শিখরদেশে জোনাকিরা উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। এমনই সময়ে একটা ভেড়ার ডাক শুনতে পেলুম। ডাক না কান্না? মনে হল কাছে পিঠে কোথাও থেকে ডাকটা আসছে। ভেড়াটা বেশ কয়েকবার ডেকে চুপ করে গেল। আমার বেশ অবাক লাগল ব্যাপারটায়। এত সন্ধ্যায় ভেড়া ডেকে গেল জঙ্গলের ধারে? কিন্তু এদিকে তো ভেড়া চরানো হয় না। গ্রেজিং গ্রাউণ্ড, মানে গোচারণভূমি তো বেশ খানিকটা দূরে! তাহলে? কে জানে কোনও দলছুট মেষ হয়ত অন্ধকারে হারিয়ে গিয়ে করুণ স্বরে তার মেষপালককে খুঁজছে।
এইসব ভাবছি, হঠাৎ শুনতে পেলাম গুলির শব্দ।
পরপর চারবার।

তারপর খানিকটা নীরবতা।
আবার ডেকে উঠল ভেড়াটি।

আবার গুলির শব্দ।
আবার ভেড়ার ডাক।

ব্যাপারটা কী? কেউ কি শিকারে বেরল নাকি?

কিন্তু এসব এলাকায় তো শিকার করা আইনত দণ্ডনীয়। নিচে নেমে গেলাম। নেমে দেখি বাংলোর সামনের বাগানে দাঁড়িয়ে লছমন সিং। সে জঙ্গলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জ্যোৎস্নার আলোয় দেখলুম তার মুখের মধ্যে ভয়। সে এতটাই মগ্ন ছিল যে, আমি যে এসে দাঁড়িয়েছি, সেটা সে বুঝতেই পারেনি। ডাকলাম,
—লছমন
চমকে উঠল সে।
—জী বাবুজী
—কী ব্যাপার লছমন? এসব কী হচ্ছে? ভেড়াটা কার? আর বন্দুকই বা চালাচ্ছে কে? মনে তো হচ্ছে যে সে আশেপাশেই রয়েছে।
—ভেড়ার ডাক আপনিও শুনতে পেয়েছেন না, বাবুজী?
—হ্যাঁ, পেয়েছি তো বটেই
লছমন চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
—কী হল লছমন! এখানে তো এভাবে শিকার করা যায় না। তার জন্যে বনদপ্তর থেকে পারমিশন লাগে। যে যা ইচ্ছে তো করতে পারে না। দেশে তো একটা আইনকানুন আছে না কি? যে-ই এসব করুক, তাকে শাস্তি পেতে হবে। কে করছে তুমি কি জানো? আমাকে তার নাম বলো! আমি তার বিরুদ্ধে কঠিন অ্যাকশান নেব!
লছমন মাথা নিচু করে রইল। দেখে মনে হল, ও জানে কে গুলি করছে, কিন্তু বলতে চায় না।
আমি খানিকটা ধমকের স্বরে বললাম, কী হল? নামটা বলো!
ইতিমধ্যে আবার ডেকে উঠল মেষ।
তার ঠিক পরেই গর্জে উঠল বন্দুক।
আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। সোজা হাঁটা লাগালাম আমার জিপের দিকে। এই জঙ্গলের ইন-চার্জ হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে। আই ক্যানট লেট দিস গো অন। আই হ্যাভ টু স্টপ ইট ইমিডিয়েটলি।
জিপে উঠতে যাব, এমন সময় লছমন এসে প্রায় কঁকিয়ে উঠল—‘বাবুজি দোহাই আপনার, আজ বেরোবেন না। আজ বড় খতরনাক রাত আছে।’ ওর গলার স্বরে কিছু একটা ছিল যা আমাকে আটকে দিল।
আমি বললাম, ‘কী হয়েছে? খতরনাক রাত মানে?’
বুড়ো লছমন তার সাদা পুরুষ্টু পাকানো গোঁফের ফাঁক দিয়ে বিড়বিড় করে বলে উঠল—
—মোতিলালের নাতিটাও আজ চলে যাবে—
—মোতিলালের নাতি? ঠিক বুঝলাম না। কে মোতিলাল?
—বাবুজী এ বড় অদ্ভুত কাহানি আছে। আসেন, উপরে আসেন। আপনাকে বলি। এ কাহানি না জানলে আপনি আজকের এই ভেড়ার ডাকের মানেটা বুঝবেন না!

আমরা কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওপরের বারান্দায় গিয়ে বসলাম।
আমি বললাম—কী কাহানি?
লছমন বলল— এ এক অভিশাপের কিসসা! বড় ভয়ানক!
—অভিশাপ? কিসের অভিশাপ?
বুড়ো লছমন সিং এর উত্তরে আমায় একটা অদ্ভুত গল্প বলল—

—বাবুজী আজ থেকে সত্তর বরস আগে ই ইলাকায় ছিল রতনলালের জমিদারি। রতনলালের বাবা ছিল মশহূর ডাকু। ও ডাকাইতি করে অনেক পয়সা করেছিল, তারপর জমিদারী কিনেছিল। রতনলাল লোকটাও ভাল ছিল না। প্রজাদের ওপর খুব জুলুম করত। রতনলালের তিন ছেলে। বড় ছেলে—মোতিলাল, মেজ—বিরজুলাল ঔর ছোটা— শ্যামলাল। রতনলাল বুড়া হলে জমিদারী দেখতে শুরু করে মোতিলাল। বিরজুলাল আর শ্যামলাল দাদাকে খুব ভালোবাসত। এই কারণে জমিদারী নিয়ে কোনো ঝামেলা হয় নি। ওরা দাদার সঙ্গেই থাকত।
মোতিলালের যখন চালিশ বরস, তখন দেশ স্বাধীন হয়। অংরেজরা চলে গেলে, সে জমিদারী চলে যায় গরমেন্টের হাতে। কিন্তু হাভেলী আর বারো বিঘা জমিন আজও রয়ে গেছে।

জমিদারি চলে গেলেও মোতিলাল, বিরজুলাল ঔর শ্যামলাল ভাবত যে তাঁরা জমিদার ছিল, আছে ঔর থাকবে। কিন্তু ইলাকার মানুষ ওদের আর মানতে চাইত না। কিন্তু মানতে না চাইলে কী হবে, ইখানকার পুলিশকে ওরা ঘুষ দিয়ে কিনে রেখেছিল। তাই ওদের কেউ কিছু বলত না। একবার এইসা হল কী মোতিলালের বড় ছেলে কিষেণলাল ঘোড়ায় চড়ে গিয়েছিল জঙ্গলের ওধারে কুমায়ুনি গ্রামে। নামের একটি লেড়কার একটা দুধসাদা ভেড়া ছিল। মক্ষন ভেড়াটার নাম দিয়েছিল গোরিয়া। সে ছিল মক্ষনের জিগর। সে সারাক্ষণ গোরিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াত।
—মাখনের কত বয়স ছিল?
—সে দশ এগারো বারো হবে, বাবুজি
—আর কিষেণলালের?
—আঠরা-বিশ। তা, সে বার কিষেণলাল ঘোড়ায় করে ঘুরতে ঘুরতে ঐ গ্রামে যায়। গোরিয়াকে দেখে তার খুব পসন্দ হয়।
সে মক্ষনকে বলে,

কি। এই! শোন, এদিকে আয়!
ম। হামি?
কি। আরে হ্যাঁ হ্যাঁ তুই! এদিকে আয়। শোন, ওই যে ভেড়াটা রয়েছে, ওটা হামার বহুত ভালো লেগেছে! ওটাকে দে, হামি পুষব।
ম। না না। ওটা তো হামার ভেড়া আছে। ওর নাম গোরিয়া। ও হামার কাছেই থাকবে। ওকে হামি কিছুতেই দেব না, হুজুর!
কি। আরে ভাই হামি তোকে রূপিয়া দেব।
ম। না হুজুর, হামি দেব না। গোরিয়া হামার সব কুছ।
কি। ভালো করে চাইছি, তুই দিবি না তো?
ম। না, হুজুর!
কি। আবার ভেবে নে। দিবি না তো?
ম। না হুজুর হামি কিছুতেই দেব না—জান থাকতে দেব না, চল গোরিয়া—
কি। আচ্ছা! দেখি তুই কী করে না দিস!

সেদিন ঘোড়া ছুটিয়ে কিষেণলাল হাভেলিতে ফিরে যায়। ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজের কুমায়ুনি জঙ্গল কেঁপে ওঠে।
পরদিন দুপুরে দুটো গুলির শব্দ হয়। গাঁয়ের লোকেরা দ্যাখে পাইনবনের মধ্যে একটা সবুজ ঘাসের জমিনের ওপর মক্ষন আর গোরিয়ার ছোট্ট দুটো শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তারা দুজনেই মৃত, তাও মক্ষন গোরিয়াকে জড়িয়ে রয়েছে, তাকে ছাড়ে নি। মক্ষন ছিল বাপ-মরা ছেলে। তার জীবনে ছিল শুধু তার মা, চাঁদরানি। মক্ষনের মরে যাবার খবর পেয়ে চাঁদরানি দুঃখে শোকে পাগল হয়ে যায়।
সে বুড়া রতনলাল আর তরুণ মোতিলালকে হাভেলিতে গিয়ে বলে, ‘তোরা হামার মক্ষনকে নিয়ে নিলি! লেকিন জেনে রাখ, মক্ষনের হয়ে গোরিয়া ফিরবে। ওয়াপস আসবে! ও মক্ষনের মৃত্যুর বদলা নেবে। তোর পরিবার বিনাশ করে দিবে।’

মোতিলাল দারোয়ানকে বলে—‘হোই চরণ, ঐ চাঁদরানি কো চল্লিশ ঘা চাবুক মারো! বান্ধো ওকে! হামার পরিবার বিনাশ করে দিবে! আমার পরিবার? দেখাচ্ছি কাকে বিনাশ হওয়া বলে! আরে এ চরণ, জোর সে লাগা চাবুক লাগা! হামি ওর খুন দেখতে চাই! লাগা চাবুক!’
সপাং সপাং করে চাবুক পড়তে থাকে চাঁদরানির পিঠে।
তবু চাঁদরানির চোখ থেকে একফোঁটাও জল পড়ে না। সে শুধু চিৎকার করতে থাকে— ‘গোরিয়া আসবে। মক্ষনের মৃত্যুর বদলা নেবে। তোর পরিবার বিনাশ করে দিবে, রতনলাল—’
মোতিলাল হেসে ওঠে—‘বদলা! বিনাশ! বুরবক ঔরত! চরণ মার চাবুক! হাত চালা! কস কে!’
অবশেষে চল্লিশ ঘা চাবুক মেরে চাঁদরানিকে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় ছেড়ে দেওয়া হয়।
সেদিন অনেক রাতে গাঁয়ের লোকেরা জেগে উঠে দ্যাখে চাঁদরানির কুঁড়েঘর জ্বলছে ঔর একঠো পাইন গাছের ডাল থেকে ঝুলছে চাঁদরানির লাশ। পায়ের দিক থেকে উল্টো করে বাঁধা।

ঠিক এরপর থেকে শুরু হয় সেই অদ্ভুত ঘটনা।
শোনা যায় চাঁদরানির মারা যাবার ঠিক পরের অমাবস্যার রাতে একটা ভেড়ার ডাক শুনতে পেয়েছিল গাঁয়ের লোক। তাদের মধ্যে কয়েকজন দেখেছিল ভেড়াটাকে। তার দুধসাদা শরীর, শুধু গায়ের একটা দিকে গুলি আর খুনের দাগ। এক নাগাড়ে ডেকেছিল ভেড়াটা, হাভেলির ধারে।
সেই রাতে রক্তবমি করতে করতে মারা গিয়েছিল বুড়া রতনলাল। লোকে বলে বনের ভিতর থেকে সে রাতে চাঁদরানি হাসির শব্দ শোনা গিয়েছিল। বুড়া রতনলালের বুকে নাকি ছিল ধারালো নোখের দাগ!
বুড়া রতনলাল মারা যাবার আগে চিল্লিয়েছিল—‘হোই চাঁদরানি আমারে মারিস না! আমার গলতি হয়ে গেছে! আমারে মারিস না! আমারে মারিস না!’

রতনলালের পর মোতিলাল জমিদার হয়। সবকুছ ঠিকঠাক চলছিল। একদিন হাভেলিতে বাজল সেহনাই। আলো দিয়ে সাজানো হল পুরা হাভেলি। কিষেণলালের বিয়ে হল। সেই বিয়েতে আমি ভি গিয়েছিলাম। তখন আমার দশ-এগারো বরস হবে। বহুত ধুমধাম হল। গানা বাজানা হচ্ছিল। এই সময়ে হঠাৎ শোনা গেল গোরিয়ার ডাক। গানা-বাজানা থেমে গেল। গোরিয়া যেন ঐ হাভেলির চারপাশে ঘুরে ঘুরে ডেকে যাচ্ছে। সবাই শুনল।
সেদিন মোতিলাল হাভেলির চারদিকে পুলিশ পাহারা বসিয়েছিল।
সে বলল, ‘আরে ইয়ার পুলিশের পাহারা আছে! কৌনো ভয় নাই!’
যে-যার বাড়ি চলে গেল।
নতুন বর-বউ ঢুকে গেল নিজেদের সাজানো ঘরে।

আগলা দিন সকালে উঠে মোতিলাল চমকে ওঠে। কিষেণলাল ঘরে নেই। কিষেণলালের নতুন বউ নিজের হাতের শিরা কেটে মরে পড়ে আছে। তাহলে কিষেণ কোথায়? খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে কিষেণলালকে খুঁজে পাওয়া গেল সেই পাইন গাছে, যেখানে একদিন ঝুলছিল চাঁদরানির লাশ। আজ সেই গাছেই ঝুলছে কিষেণলালের মৃতদেহ। মোতিলাল এই দৃশ্য দেখে পাগল হয়ে গেল। সে পাগলের মতো বলতে লাগল—‘আমার কিষণ কাঁহা গেল? আমার কিষণকে চাঁদরানি কাঁহা নিয়ে গেল? কাঁহা? কাঁহা? কাঁহা নিয়ে গেল? কাঁহা নিয়ে গেল?’

এর কয়েকমাস পর, আবার অমাবস্যার রাতে ডেকে উঠল গোরিয়া। পরদিন সকালে দেখা গেল কুয়োর পানিতে ভাসছে মোতিলাল ঔর তার স্ত্রীয়ের লাশ। এরপর, গত পঞ্চাশ বছরে যতবার গোরিয়া এসে কেঁদে গেছে অন্ধকারে, ও হাভেলিতে কেউ না কেউ মরে গেছে।
—কিন্তু গোরিয়া কবে আসবে তার কি কোনও ঠিক আছে?
—না বাবুজী। দশ বছরে একবারও সে না আসতে পারে। কিন্তু যেদিন রাতে সে আসবে, সে রাতে ও-বাড়ির কাউকে না কাউকে যেতেই হবে। আমি নিজে একমাসে তাকে দুবার ডেকে যেতে শুনেছি। তখন আমার আপনার বয়স। সেবার শ্যামলালের ছেলে আর নাতিকে টেনে নিল। আজকে সে প্রায় সাত বছর পরে ডাকছে।
—কাকে? কার জন্যে এসে থাকতে পারে?
—মোতিলালের ছোট ছেলে হরকিষণলাল রয়েছে। তার বউ রয়েছে। তার ছেলে শিওলাল রয়েছে। ওদিকে বিরজুলালের ছেলেরা আছে। কিন্তু কাকে ও টানবে কেউ জানে না।
—বন্দুক কে চালাল, লছমন?
—ওটা হরকিষণলাল। কিন্তু যে আগে থেকেই মরে গেছে, তাকে মারবে কৌন গোলি? হরকিষণলালের বউটা খুব ভাল। কত ব্রত, মানত, দরগা, পীর, সাধু্সঙ্গ করেছে। আমরা তো ভেবেছিলাম যে ইবার চাঁদরানির অভিশাপ কেটে যাবে। কিন্তু কাটল না। আজ সাতবছর পর গোরিয়া আবার ফিরে এসেছে। ঐ শুনুন বাবুজী, গোরিয়া কাঁদছে। আজও মক্ষনের জন্য কাঁদছে আর বলছে আয়, আয়, আয়। দেখবেন তাকে বাবুজী, দেখবেন?

আমি লছমনের কথায় একটি শিহরণ অনুভব করলাম। লছমনের কথা মতো তার পেছনে পেছনে হাঁটতে লাগলাম। আমরা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। চারদিক জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। পাইন গাছগুলো দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে দিয়েই দেখা যাছে একফালি ঘাসজমি, চাঁদের আলোয় রূপোলি হয়ে আছে। লছমন দাঁড়াল। আঙুল তুলে দিকনির্দেশ করল। আর আমি দেখলাম একটা সাদা ক্ষুদ্রকায় তুলোর বলের মতো মেষ অন্ধকারে হাঁটছে আর ডেকে চলেছে। তার শরীরের একটা দিকে চাপ রক্ত আর বুলেটের দাগ। আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। এই সেই মক্ষনের প্রাণের চেয়ে প্রিয় গোরিয়া? এই সেই চাঁদরানির অভিশাপের দূত? এত সুন্দর? একটা সময়ে গোরিয়া ঘন বনের মধ্যে মিলিয়ে গেল। লছমন সিং কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল। আমরা ফিরে এলাম।

সে রাতে ঘুম হল না। পরদিন শুনলাম, শিওলালের মা বিষ খেয়ে মারা গেছে।
লছমন বলল, ‘লেড়কাকে বাঁচানোর জন্য মা চলে গেল। ভালো ঔরত। কিন্তু শিওলাল বাঁচবে না, হরকিষণলাল বাঁচবে না—গোরিয়া আবার আসবে! এর কয়েক মাস পরে চৌখাম্বা থেকে বদলি হলাম মধ্যপ্রদেশে। চৌখাম্বাতে আর ফেরা হয় নি কখনও। তাই জানি না আজ ঐ পরিবারে আর কে বেঁচে আছে। বা গোরিয়া আর এসেছিল কিনা! কিন্তু আজ এত বছর পরেও আমার বিশ্বাস যে সেদিন আমি গোরিয়াকেই দেখেছিলাম। তাকে এই দুচোখ দিয়েই তো দেখেছি। সেটা অস্বীকার করি কী করে? আমি আজও শুনতে পাই গোরিয়ার করুণ কান্নার মতো ডাক।
আমার কানে আজও বাজে লছমনের গলা, ঐ শুনুন বাবুজী, গোরিয়া কাঁদছে। আজও মক্ষনের জন্য কাঁদছে আর বলছে আয়, আয়, আয়।

নিরঞ্জনবাবু চুপ করলেন। আমরাও তখন একটা গভীর ঘোরে আচ্ছন্ন। এদিকে সন্ধে গড়িয়ে রাত নেমেছে জলদাপাড়ার অরণ্যে। আর দূরে ঝাঁকড়া সেগুন গাছটার মাথায় তখন উঠেছে কৃষ্ণা চতুর্থীর আধভাঙ্গা রহস্যময় রক্তবর্ণের চাঁদ।