Categories
আঁকানিকেতন |

মোনা লিসা

744 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
বিভাস সাহা

অর্থনীতির অধ্যাপক, ডারাম ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড

চিত্র: মোনা লিসা (অন্য নাম লা জিওকোন্ডা), ১৫০৩, পপলার কাঠের প্যানেলের উপর তেল রঙে আঁকা, ৩০x ২১ ইঞ্চি, (ডানদিকে, পূর্ণাঙ্গ চিত্র; বাঁদিকে, খণ্ডিত চিত্র)

এবার আমরা তাঁর কয়েকটি অসাধারণ ছবি নিয়ে আলোচনা করব। শুরু করা যাক শেষ থেকে, অর্থাৎ তাঁর শেষ দিকের আঁকা ছবি, সবার প্রিয় মোনা লিসা দিয়ে। মোনা লিসা, যার অন্য নাম ‘লা জিওকোন্ডা’ (La Gioconda), লিওনার্দোর সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি বলা যেতে পারে। এই ছবিটি যখন তিনি আঁকেন তখন তিনি খ্যাতির মধ্যগগনে, তাঁর বয়স তখন ৫১ বছর। এখন একটু আলোচনা করা যাক ছবিটি কেন এত বিখ্যাত।

প্রথমেই যেটি লক্ষণীয় তা হল ছবিটির সরলতা। পৃথিবীর সব বিখ্যাত ছবিই এক অর্থে সহজ ছবি, সহজ মানে তাকে প্রথম দর্শনে জটিল বলে মনে হবে না, অন্তত দর্শকের চোখে। বিষয়বস্তু সহজ হতে হবে। মোনা লিসায় আমরা দেখি কোনও গল্প নেই, রয়েছেন শুধু এক মহিলা। মহিলা মধ্যবিত্ত কি অভিজাত তা পরিষ্কার নয়। তাঁর পোষাকটির ডিটেলগুলি অন্ধকারে লুকানো আছে। তাঁর শরীরে-গলায় বা হাতে— কোনও গহনা নেই। সুতরাং তাঁর সম্পদ ও সামাজিক অবস্থান জানা যায় না। এমনকি তাঁর হাতে আংটিও নেই। অর্থাৎ তিনি বিবাহিতা, অনূঢ়া না বিধবা, তাও পরিষ্কার নয়। দর্শক যা খুশি কল্পনা করতে পারেন। মহিলার বয়স কত? দেখে মনে হয় পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশের মধ্যে। লিওনার্দো আমাদের শুধু ওই টুকুর আভাস দিয়েছেন। বাকি সবকিছু, সব আর্থ-সামাজিক তথ্য মুছে দিয়ে তিনি মোনা লিসার নারীত্বকেই বিশেষ ভাবে তুলে ধরেছেন। মোনা লিসার মুখ ও আঙুলগুলির দিকেই দর্শকের চোখ বারবার ফিরে আসে।

দ্বিতীয়ত, মোনা লিসার চোখ দুটি দর্শককে যেন অনুসরণ করে। এক ধরনের আত্মীয়তা সৃষ্টি হয়। যে কোণ থেকেই আমরা দেখি না কেন, মনে হয় তিনি যেন আমাদের দেখতে চান, আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। অথচ তাঁর মুখটি দেখলে তাঁকে মিতভাষী মনে হয়। তাঁর হাসিটি রহস্যময়। সামনে থেকে দেখলে মনে হয় হাসছেন না, কিন্তু একপাশ থেকে দেখলে মনে হয় হাসছেন। এই দ্ব্যর্থবোধ ছবিটিকে একই সঙ্গে মায়াবী ও রহস্যময় করে রাখে। অনেকে প্রশ্ন তোলেন মোনা লিসার ভুরু নেই কেন। এর কোন পরিষ্কার উত্তর নেই। কারও কারও মতে ইতালিতে তখনকার দিনে অভিজাত মহিলারা ভুরু তুলে দিতেন। বিষয়টি রহস্যের।

তৃতীয়ত, রহস্যময়তা আরও বাড়ে যখন আমরা মোনা লিসার পিছন দিকটা দেখি। লিওনার্দো ল্যান্ডস্কেপ শিল্পী ছিলেন না, অথবা বলা ভাল ক্রেতারা কেউ ল্যান্ডস্কেপ বা প্রাকৃতিক দৃশ্য আঁকতে বলতেন না। তবু লিওনার্দো এখানে একটি প্রকৃতি-দৃশ্য এঁকে দিয়েছেন। এটা পরিষ্কার নয় মহিলা ঠিক জানালার ধারে বসে আছেন, নাকি কোনও বারান্দায়। আলো আসছে ছবির বাঁদিক থেকে। সেই আলোর সঙ্গে বহির্দৃশ্যের কোন যোগ নেই। বাইরের দৃশ্যটি রুক্ষ, প্রায়ান্ধকার, কোন্ ঋতু বোঝার উপায় নেই। ফলে ছবিটি আমাদের মনে অনেক রকম প্রশ্ন তোলে।

চতুর্থত, ছবিতে দিগন্তরেখা মোনা লিসার চোখের ঠিক নিচে এবং উপর থেকে ধরলে ছবির এক চতুর্থাংশ পর্যায়ে। আমরা ফোটোগ্রাফির নিয়ম থেকে জানি একের চার থেকে একের তিন অংশের মধ্যে আকাশ রাখলে ছবি দৃষ্টিনন্দন হয়। মোনা লিসার চোখের স্তরে দিগন্তরেখা থাকার ফলে দর্শকের বোধ হয় সে বুঝি মোনা লিসার সঙ্গে একই সমতলের উপর দাঁড়িয়ে আছে।

ওপরের এই কারণগুলির জন্যে মোনা লিসা দর্শকদের বার বার আকর্ষণ করে, আমাদের মধ্যে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন এক অনুভূতির জন্ম দেয়। কিন্তু শুধু সাধারণ দর্শকদের নয়, তাঁর সমকালীন ও শতাব্দী পরবর্তী শিল্পীদেরও মুগ্ধ করেছেন লিওনার্দো। তার কারণগুলি অবশ্য একটু গভীর।

মোনা লিসাকে বলা যেতে পারে আধুনিক অর্থে প্রথম পোর্ট্রেট। মাথা থেকে পা অবধি নয়, শরীরের অর্ধাংশ আঁকা। লিওনার্দোই প্রথম মুখোমুখি বসিয়ে পোর্ট্রেট বা প্রতিকৃতি আঁকা শুরু করেন। তাঁর আগে এক পাশ থেকে (অর্থাৎ প্রোফাইল) প্রতিকৃতি আঁকা হতো, যেমন সিলমোহর বা ধাতব মুদ্রায় রাজা বা শাসকদের ছাপ থাকত। মোনা লিসাকে লিওনার্দো একদম সামনাসামনি নয়, একটু কোনাকুনি করে বসিয়েছেন। এই ভঙ্গিটিই পরবর্তীকালে প্রতিকৃতির সবচেয়ে জনপ্রিয় পোজ হয়ে যায়― আঁকা বা ফোটো তোলা উভয় ক্ষেত্রেই। সাবজেক্টের মুখ সামনে থেকে আঁকার ফলে দর্শকের সঙ্গে সাবজেক্টের তথা ছবির একটা সরাসরি সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। আবার একটু কোনাকুনি বসানোর জন্যে সাবজেক্টের শরীরের ত্রিমাত্রিকতা অনেক বেশি ফুটে ওঠে।

লিওনার্দোর ছবি বাস্তববাদী। নিখুঁতভাবে বাস্তবকে সম্পূর্ণ ধরার জন্য লিওনার্দো সাবেকি টেম্পেরা (এই মাধ্যমে ডিমের সাদা অংশ ব্যবহার করা হয় রং গোলার জন্যে) ছেড়ে তেল রঙের আশ্রয় নেন। যদিও তেল রঙের ব্যবহার তাঁর আগে বেলজিয়ান শিল্পীদের মধ্যে দেখা যেত, তবুও লিওনার্দোই প্রথম তেল রঙের বিপুল সম্ভাবনা আবিষ্কার করেন, এবং তাঁর ব্যবহৃত ‘স্ফুমাটো’ পদ্ধতি পরবর্তীকালে ইতালি ও সমগ্র ইউরোপের শিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্ফুমাটো কথাটির মানে হচ্ছে ধোঁয়াটে, অর্থাৎ আলো-আঁধারির খেলা ধরার পক্ষে অত্যন্ত উপযোগী পদ্ধতি। লিওনার্দো বুঝেছিলেন যে বাস্তবকে সম্পূর্ণ ধরতে গেলে আলো ও ছায়াকে ঠিক ভাবে আঁকতে হবে। ছায়া মানেই অন্ধকার নয়, বরং আবছা হয়ে লুকিয়ে থাকা আর এক বাস্তবতা। যেমন মোনা লিসার হাতদুটি যে চেয়ারের হাতলে রয়েছে সেই হাতলটি আমরা ভাল করে দেখতে পাই না, শুধু আভাস পাই। আলো ও অন্ধকারের মধ্যে রয়েছে ছায়ার জগৎ। লিওনার্দোর কাছে এই ছায়ার জগৎটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। দৈনন্দিন জীবনে আমরা যেহেতু এই আলো-আঁধারির খেলা দেখে অভ্যস্ত, তাই ছবি দেখার সময় আমাদের মস্তিষ্ক এই একই রকম প্রত্যাশা করে। মোনা লিসার মুখের উপরে একটা স্বচ্ছ ভেইল বা আবরণ আছে, যার ঊর্ধ্বভাগ কপালের উপর থেকে ডানদিকে চুলের উপর অবধি চলে গেছে। কিন্তু ভেইলের নিচের দিকটা দেখা যাচ্ছে না। তাতে কিন্তু অসুবিধা হয় না। আমাদের মস্তিষ্ক অনুমান করে নেয় ভেইলের নিম্নাংশ কোথাও আছে, হয়তো অন্ধকারে মিশে গেছে।

লক্ষণীয়, মোনা লিসার চিবুকের নিচের অন্ধকার ডানদিকে ছড়িয়ে গালের পাশ বেয়ে চুলের সাথে মিশে গেছে। চকিতে নয়, ধীরে ধীরে আলো থেকে ছায়ার মধ্যে দিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। এই ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া আজকের দিনে ছবিতে আমরা দেখতে খুব অভ্যস্ত। কিন্তু পঞ্চদশ শতাব্দীতে এটি অভিনব ছিল এবং এই অঙ্কন পদ্ধতিটি লিওনার্দোর বিশেষ উদ্ভাবন। এর জন্যে তিনি প্রথমে ছবিটির ড্রয়িং করে তাকে একরঙা আঁকতেন (underpainting), তারপর স্তরে স্তরে, তার উপরে একাধিকবার গ্লেজিং পদ্ধতিতে রং চাপিয়ে ছবি আঁকতেন। এর জন্যে ছবিটির যে শেষ রূপটি আমরা দেখি, তার তলায় অনেকগুলি বিভিন্ন স্বচ্ছ স্তর আঁকা থাকে। এর ফলে কাছ থেকে, বা দূরে গিয়ে বা পাশ থেকে ছবি দেখার মধ্যে অভিজ্ঞতার পার্থক্য হয়। এমনকী কতটা আলোর মধ্যে ছবি দেখছি বা প্রদর্শনী কক্ষের আলো কোন দিক থেকে এসে ছবির ওপর পড়ছে, তাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

মোনা লিসা ছবিটি কাঠের ওপর আঁকা, ক্যানভাসে নয়। লিওনার্দো সাধারণত খুব উজ্জ্বল রং ব্যবহার করেন নি। বরং ম্রিয়মাণ রংই তাঁর পছন্দ ছিল। মোনা লিসার ঠোঁটে লাল, বা চোখে নীল রং দেননি। অপেক্ষাকৃত অনুজ্জ্বল বাদামী, সবুজ, গৈরিক হলুদ (yellow ochre), নীল ইত্যাদি মিলিয়ে মিশিয়ে এক মায়াময় মুড তৈরি করেছেন, যা তাঁর বিশেষত্ব ছিল, এবং এই বিশেষত্বের নিরিখেই গবেষকরা আসল লিওনার্দো থেকে নকল লিওনার্দোকে আলাদা করতে পারেন। এক-কথায় বলা যেতে পারে, তিনি অন্ধকার আঁকতেন।

লিওনার্দোর পদ্ধতি যেমনই অভিনব ছিল, তেমনই শেষ করতে তিনি সময় নিতেন খুব। তেল রঙের ছবি এমনিতেই অনেক বেশি সময় নেয়, কারণ রং শুকোতে সময় নেয় এবং রঙের উপর রঙের স্তর বসাতে আরও বেশি সময় লাগে। তদুপরি লিওনার্দো ছিলেন পারফেকশনিস্ট। নিরলস পরিশ্রমী হয়েও বহু ছবি তিনি মাঝপথে অসমাপ্ত রেখে গেছেন, বা সংরক্ষণের অভাবে মাঝপথে নষ্ট হয়ে গেছে। গবেষকরা মনে করেন মোনা লিসা ছবিটির আঁকা শুরু হয়েছিল ১৫০৩-এ, কিন্তু শেষ হয়েছিল অন্তত চার বছর পরে। ফ্লোরেন্সের অভিজাত ব্যবসায়ী ফ্রাঞ্চেস্কো ডেল জিওকোন্ডো তাঁর স্ত্রী লিসা ঘেরার্দিনির ছবি আঁকার কাজ দেন লিওনার্দোকে। এই কারণে মোনা লিসার অন্য নাম ‘লা জিওকোন্ডা’। স্টুডিওতে লিসা ঘেরার্দিনিকে বার বার বসিয়ে লিওনার্দো ছবিটির কাজ ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু সময়ের সাথে তিনি ছবিটির এমন প্রেমে পড়ে যান যে কাজ শেষ হলে জিয়োকোন্ডোকে ছবিটি আর দিতে চাননি, নিজের কাছে রেখে দেন। শেষ বয়সে তিনি যখন ফ্রান্সে যান, মোনা লিসাকে সঙ্গে নিয়ে যান, এবং সেই সূত্রে মোনা লিসা ফ্রান্সের জাতীয় সম্পত্তি হয়ে যায়।

এই প্রসঙ্গে বলা ভালো যে মোনা লিসাকে চাক্ষুষ দেখে দর্শকেরা প্রথমে হতাশ হন, তার একটা কারণ মোনা লিসার নাতিদীর্ঘ আয়তন। মাত্র তিরিশ ইঞ্চি বাই একুশ ইঞ্চি সাইজের ছবি দেখে দর্শকরা অবাক হন যে কী করে এত ছোট ছবি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ছবি হয়! মোনা লিসা একবার চুরিও হয়েছিল। তাই ছবিটি এখন বুলেট প্রুফ কাচের ভল্টে রাখা আছে। লুভের মিউজিয়মে নিঃসন্দেহে মোনা লিসা সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। ভিড় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মোনা লিসার থেকে দর্শকের দূরত্বও করে রাখা আছে। খুব কাছ থেকে দেখা যায় না। তবু এই মহান সৃষ্টির সামনে দাঁড়ালে এক অনন্য অনুভূতি হয়।