রাত্তিরবেলা শুতে এসে যখন ঘুম আসে না, তখন বালিশের তলা থেকে গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে আসে সব ফেলে আসা ‘সময়রা’। তারা কথা বলে, হাসে, খেলে, কখনও বা কাঁদেও। এক পৃথিবী গল্প থাকে ঘুম না আসা বালিশের তলায়। আজ তেমনই একটা রাত। বালিশের তলা থেকে Edward Stanley Gibbons সাহেব হঠাৎ বেরিয়ে এলেন। এই সাহেবের সঙ্গে, আমার বাবা যখন আমায় পরিচয় করিয়ে দেন, তখন আমার বয়স মাত্র দশ। মোটা, ভারী, বড় একটা বই, তার পাতায় পাতায় দেশ-বিদেশের স্ট্যাম্প-এর ছবি, আর তার ইতিহাস। তখন তো সেই বই পড়ে ওঠার মত বিদ্যে আমার হয়নি। কিন্তু ওই সব ছবি দেখিয়ে দেখিয়ে বাবার সরস গল্প বলা চারিয়ে গেল আমার মধ্যে। নেশা ধরে গেল স্ট্যাম্প জমানোর।
সে যুগে তো সবাই চিঠি লেখালেখি করত, যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম চিঠি। দেশ থেকে দেশান্তরে উড়ে আসত, ছুটে যেত চিঠি। তারপর ডাকহরকরার ব্যাগে করে, রানারের কাঁধে চড়ে, ডাক পিয়নের হাতে হাতে চিঠি পৌঁছে যেত ঘরে ঘরে। কিন্তু এই যে পরিক্রমা তার জন্য তো একটা পাসপোর্ট দরকার অবশ্যই— সেটা হল স্ট্যাম্প বা ডাকটিকিট। এই ডাকটিকিটের গল্প ছিল Gibbons-এর বইয়ে। সেকালের ছেলেমেয়েরা অনেকেই ডাকটিকিট সংগ্রহ করত। সারা পৃথিবীর নানা দেশের স্ট্যাম্প। মাঝে মাঝেই কোনও বিশেষ তাৎপর্য বুঝে নতুন স্ট্যাম্প বেরত, আর তার প্রথম প্রকাশের দিন Post Office-এ পাওয়া যেত First day cover, সেটি সংগ্রহ করতে যে কী উৎসাহ! বাবা অফিস ফেরত GPO থেকে কিনে আনতেন সেটি, আমি সকাল থেকে তারই প্রতীক্ষায় থাকতাম। এ নেশা আমার ছিল পুরো ছোটবেলাটা জুড়ে। তারপর ধীরে ধীরে কবে যে ছেড়ে গেল সেটা আর মনে পড়ে না। বাবা কিন্তু চালিয়ে গেলেন তাঁর স্ট্যাম্প সংগ্রহ আর স্ট্যাম্প নিয়ে লেখালেখি চিরদিনই।
আমি বড় হয়ে পড়তে গেলাম শান্তিনিকেতনে। সেখানে গিয়ে প্রথম কিছু মাস ছিলাম মোহরদির (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়) বাড়িতে। তাঁর কাছে থাকার সুবাদে নানা গল্প হত তাঁর সঙ্গে। পুরনো দিনের আশ্রমের কথা বলতে ভালবাসতেন মোহরদি। এসব গল্প আমাতে-মোহরদিতে হত রাত্তিরবেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে। আমি আর মোহরদি শুতাম একই ঘরে, একই বিছানায়। তারপর ঘুম না আসা পর্যন্ত আমি বলতাম আমার সারাদিনের রোজনামচা, আর মোহরদির কাছ থেকে কুড়িয়ে নিতাম গল্পের মণি-মুক্তো। গল্পে গল্পে একদিন বেরল আমার আর মোহরদির মিল, দুজনেই ছোটবেলায় স্ট্যাম্প জমাতাম। সেই গল্পে যত না ছিল স্ট্যাম্প মাহাত্ম্যের কথা, তার চেয়েও অনেক বেশি করে ধরা ছিল ‘তখনকার সময়’ আর আশ্রম পরিবারের ছবিটা। মোহরদি যে গল্পটা বলেছিলেন সেটা এইরকম—
‘সকালবেলা শান্তিনিকেতন পোস্ট অফিসে চিঠি বাছাই করা হত; তারপর সেই চিঠি নিয়ে বাড়ি বাড়ি বিলি করতে বেরয় হরিহরদা। মাঝবয়সি, তাগড়া চেহারা, নাকের তলায় তার গোঁফ জোড়াটি মোটা— চেহারার সঙ্গে চরিত্রের মিল কম। সে ছিল বড়ই সদাশয় ব্যক্তি, আমার সঙ্গে তার খুব ভাব হয়েছিল। তার অবশ্য একটা কারণ ছিল। বিদেশ থেকে কোনদিন কত চিঠি আসছে জানা, আর তারপর সেই চিঠির স্ট্যাম্প সংগ্রহের জন্য হরিহরদার শরণাপন্ন হওয়া।
গুরুদেবের নামে বিদেশ থেকে অনেক অনেক চিঠি আসত, আর, চিঠি আসত C.F. Andrews-এর কাছে। আমি সকালের ক্লাস শেষ করেই বাড়ি গিয়ে নাকে মুখে দুটি ভাত গুঁজেই ছুটতাম পোস্ট অফিসে হরিহর দর্শনে। “হরিহরদা, গুরুদেব বা Andrews সাহেবের চিঠি আছে নাকি গো?” হাঁপাতে হাঁপাতে বলি। হরিহরদা বলত— “চলো, যেতে যেতে কথা হবে”। ব্যস, ওইটুকু বলেই চুপ করে যেত। এরপর সে, এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরছে চিঠি বিলি করতে করতে, আর আমিও চলেছি তার সঙ্গে সঙ্গে। শেষে অনেক ঘুরে একটা সময়ে উত্তরায়ণে এসে ঢুকত গুরুদেবকে চিঠি দেবে ব’লে।
বিদেশ থেকে আসা খামটা বার করে গুরুদেবকে দেওয়ার আগে একটু মুচকি হাসি দিত আমার দিকে চেয়ে। খুশিতে লাফিয়ে ওঠে আমার মন। চুপ করে গিয়ে দাঁড়াই গুরুদেবের টেবিলের সামনে। তিনি ঠিকই বুঝেছেন কেন দাঁড়িয়ে আছি। তবু যেন কিছু না বোঝার ভান করে বলতেন—“কী ব্যাপার? গানটা ঠিক মতো না হলে কিন্তু স্ট্যাম্প পাওয়া যাবে না, সেটা হচ্ছে তো?” এই বলে খাম থেকে স্ট্যাম্প খুলে আমার হাতে দিতেন, সঙ্গে একটা লজেন্স, কোনওদিন বা চিনেবাদাম। আমি আবার নাচতে নাচতে চললাম হরিহরদার সঙ্গে Andrews সাহেবের বাড়ির দিকে। তাঁকে একটু ভয় পেতাম। কী জানি সাহেব বলে কী! তিনিও আমাকে স্ট্যাম্প দিতেন, তবে কিছু রেখে, সবগুলো নয়। আশ্রমের আরও কিছু ছেলেমেয়েরা স্ট্যাম্প জমাত, তাদের হাতেও তো কিছু দিতে হবে। আমি দেখছি, তাঁর কাছে আরও বেশ কিছু বিদেশী স্ট্যাম্প আছে, কিন্তু তিনি আমায় দিলেন একটা বা দুটো। জুলজুল করে তাকিয়ে আছি, নড়ছি না সেইখান থেকে। আমার মাথার চুলগুলি নেড়ে দিয়ে তিনি বলতেন— “আজ এই ক’টাই, আবার পরের দিন হবে”। কাঁচুমাচু মুখে ফিরতে হল, পিছন থেকে শুনলাম তিনি হেসে বললেন ‘নটি গার্ল’। গুরুদেবের কাছে অবশ্য আমি ছাড়া বোধহয় আর কোনও স্ট্যাম্প-এর দাবীদার ছিল না।
এর বাইরেও হরিহরদা মাঝে মাঝে নিজের কাছে থাকা কিছু ডাকটিকিট দিত আমাকে। আমি বলি, “হরিহরদা, তোমাকে কে চিঠি দেয় গো? তুমি কোথা থেকে বিদেশের ডাকটিকিট পাও?” হরিহরদা বলত, “সব কথা কি তোমার জানা চাই? তবে হ্যাঁ, বলতে পারি, যদি তুমি আমায় গান শোনাও”। তখন ডাকটিকিটের লোভে, ইচ্ছে না থাকলেও গান শুনিয়ে দিতাম। মাঝে মাঝে বাড়ির গাছের মিষ্টি পেয়ারাও নিয়ে গিয়ে দিতাম তাকে খুশি করতে।
একদিন দেখি আশ্রমের ভেতরে এ-পথ ও-পথ ঘুরে হরিহরদা সাইকেল নিয়ে চিঠি বিলি করতে বেরিয়েছে। গরমকাল, আমি ঘেমে নেয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। সেই সময়টাতে বেশকিছু ছাত্র-ছাত্রী সিংহল থেকে এসেছিল কলাভবনে ছবি আঁকা শিখতে। দেখি হরিহরদা তাদের হাতে হাতে চিঠি দিচ্ছে, আর কী যেন বলছে তাদের। প্রত্যুত্তরে তারা হেসে হেসে খাম থেকে ডাকটিকিট খুলে হরিহরদার হাতে দিচ্ছে। হরিহরদা হাসিমুখে মাথা নেড়ে সাইকেলে চড়ে ফিরতে গিয়ে একেবারে আমার মুখোমুখি। আমার হাতে খুশি হয়ে তুলে দিল অনেকগুলো ডাকটিকিট। আমি যে পুরো ব্যাপারটা দেখেছি সেটা আর বললাম না। শ্রদ্ধায়-ভালবাসায় হরিহরদার জন্য মনটা ভরে উঠল। এমনই ছিল শান্তিনিকেতনের মানুষগুলি আর তাদের সঙ্গে ভালবাসার বাঁধন।
এরপর আরেকটু বড় হতে স্ট্যাম্পের নেশা ততদিনে ছুটে গেছে। হরিহরদার সঙ্গে সম্পর্ক কিন্তু তখনও একই রকম। তখন আর স্ট্যাম্পের জন্য ছোটাছুটি নয়। সে গল্প আরেকরকমের। তখন হরিহরদা পত্রবাহকের ভূমিকায়। সে গল্প আর একদিন হবে—’
এই পর্যন্ত বলেই মোহরদি পাশ ফিরে শুলেন। আমি হৈ হৈ করে উঠি— ‘একি! না না! তুমি এমন জায়গায় দাঁড়ি টানলে চলবে কেন? রহস্যের গন্ধটুকু দিয়ে তুমি ঘুমিয়ে পড়বে? হরিহরদা তখন পত্রবাহকের ভূমিকায়—এর পরেরটা কী? সে তো ছিলই পত্রবাহক? তাহলে ভূমিকার বদলটা হল কীসে?’ মোহরদি বললেন—
‘বদলটা বুঝলে, আসলে হল আমারই। আগে ছিলাম আশ্রমশিশু, একটু বড় হয়ে হলাম আশ্রমবালিকা। মনটা তো বদলে যাচ্ছে। গুরুদেবের সঙ্গে সঙ্গে কত জায়গায় গান গেয়ে বেড়াচ্ছি। শ্রোতাদের প্রশংসা, মুগ্ধতা, এসব ছিটেফোঁটা তো ক্বচিৎ কখনও উড়ে উড়ে আসে আমার কাছেও। ১২ বছরে গ্রামাফোনে রেকর্ড বেরল, ১৩ বছরে গুরুদেবের সঙ্গে কলকাতার মঞ্চে গিয়ে গান . . . শান্তিনিকেতনেও কত গান গাইছি।
ওই যে, তোমরা যাকে বল Fan-Mail, তা, সে-জিনিসের গুরুত্ব একজন সেই যুগের দ্বাদশী-ত্রয়োদশীর কাছে কম নাকি? হলই বা সময়টা অন্যরকম!
বাবার হাতে পড়ার আগে, চিঠিটা যেন আমার হাতেই আসে, সেই কারণেই তো হরিহরদাকে বিশেষ প্রয়োজন!’
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছি আর দেখছি . . . তেরো বছরের মোহরের চোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে . . .
খুট করে টেবল ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন মোহরদি।