Categories
বিজ্ঞানমন্দির |

ম্যাজিক কোষ ও মানুষের পুনর্জন্ম

1106 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
ড: সায়নী মুখোপাধ্যায়

স্নায়ু-অন্তঃস্রাব গবেষক, অন্তঃস্রাব গবেষণা কেন্দ্র, রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

চিত্র সৌজন্য: Nature Genetics

ধরো যদি এমন হত . . .
সিঁড়ি থেকে গেলুম পড়ে / আর ভাঙা হাত গেল জুড়ে!!

অথবা পাশের বাড়ির মিনু কাকিমার ব্লাড ট্রান্সফিউশনের আর দরকারই হল না, নিজে থেকেই রক্ত উৎপাদনকারী মেশিন ঠিকঠাক কাজ করতে শুরু করল। ভাবছ এসব কী অলীক ভাবনার কথা তোমাদের শোনাচ্ছি! না না! অলীক-টলিক কিচ্ছু নয়, এই দিন আসতে আর বেশি দেরি নেই। চিকিৎসা-বিজ্ঞানের উন্নতি যে হারে ঘটছে, এসব বাস্তবায়িত হতে আর বেশিদিন লাগবে না বোধ করি। এখন এই ব্যাপারগুলো কী করে সম্ভব হতে পারে তাই ভাবছ, তাই তো?
তবে বলি শোনো . . .

পুনর্জন্মের কথা নিশ্চয়ই শুনে থাকবে! না, না, আমি ‘ওম শান্তি ওম’ বা ‘জাতিস্মর’ বা এরকম কিছু গল্পের কথা বলছি না। আমি যার কথা বলতে চাইছি সে হল ‘স্টেম সেল’। এখন তোমাদের মনে হতেই পারে যে স্টেম সেল-এর সাথে পুনর্জন্মের কী সম্পর্ক? আছে আছে! স্টেম সেল হল দেহের এমন কোষ যা থেকে সমস্ত রকম কার্যকরী কোষগুলি সৃষ্টি হয়। যেমন ধরো রক্তের কোষ, হৃৎপিণ্ডের কোষ, অস্থি কোষ অথবা মস্তিষ্কের কোষ। এখন এই স্টেম সেলকে ব্যবহার করে মানুষের অসুস্থ বা ক্ষতিগ্রস্থ টিস্যুগুলিকে পুনরায় জন্মানো ও মেরামত করা যেতে পারে। অর্থাৎ, ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলি প্রতিস্থাপন করে স্বাস্থ্যকর কোষ তৈরি করার কাজটি এই স্টেম সেল করে, সেই অর্থে এই ঘটনাকে ‘re–birth’ ও বলা যেতে পারে।

এখন ভাবছ এই স্টেম-সেলের উৎপত্তিস্থল কোথায়? স্টেম-সেলগুলি প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত। একটি হল ‘এম্ব্রায়োনিক’ বা ভ্রূণ স্টেম-সেল আর একটি প্রাপ্তবয়স্ক বা ‘অ্যাডাল্ট স্টেম-সেল’। এখন ভ্রূণ স্টেম-সেলগুলি প্রধানত আসে অব্যবহৃত ভ্রূণ থেকে যেটি গবেষণার কাজে ব্যবহার করা হয়। এই ভ্রূণ স্টেম-সেল দেহের যে কোনও সেল তৈরি করতে পারে, এবং নিজেরাই দেহের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলির মেরামত করে নেয়। ভ্রূণ স্টেম-কোষের এই অভাবনীয় কার্যক্ষমতাকে pluripotency বলা হয়। এখন, প্লুরিপোটেন্ট প্রাপ্তবয়স্ক অথবা অ্যাডাল্ট স্টেম পাওয়া খুবই দুর্লভ এবং এগুলি umbilical cord-এ খুবই কম সংখ্যায় পাওয়া যায়। অস্থিমজ্জা বা bone marrow-কে প্রাপ্তবয়স্ক স্টেম-সেলগুলির একটি উৎসস্থল হিসেবে ধরা যেতে পারে, যেটি চিকিৎসা বিজ্ঞানে এখন খুবই কার্যকরী। আশা করি কিছুটা হলেও বোঝাতে পেরেছি এই ম্যাজিক কোষের কথা। এবার তোমাদের কিছু সত্যিকারের গল্প বলব এই স্টেম-সেলের ব্যবহার নিয়ে।

২০১৬ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট ফর রিজনেটিভ মেডিসিন’ (সিআইআরএম) একটি বোর্ড-মিটিং ডাকে কয়েকজন রোগীদের অভিজ্ঞতা জানতে যারা সিআইআরএম ফান্ডিং-এ স্টেম-সেল ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলিতে অংশ নিয়েছিল। তাদের ভিতর দুজনের অভিজ্ঞতা আর অনুপ্রেরণার গল্পই বলি আগে।

ব্রেন্ডেন হুইটেকারের যখন একবছর বয়স, তখন তাকে একটি ভয়াবহ অসুখের সম্মুখীন হতে হয় যেটা এক্স-লিংকড ক্রনিক গ্রানুলোম্যাটাস ডিজিজ (এক্স-সিজিডি) নামে পরিচিত। এটি এমনি একটি বিরল, জিনগত অসুখ যেখানে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আস্তে-আস্তে কমতে থাকে, সহজেই ব্যাক্টেরিয়া বা ফাংগাসের সংক্রমণ ঘটতে থাকে, এমনকী এই অসুখ প্রাণও নিয়ে নিতে পারে। ব্রেন্ডেন কয়েক বছর হাসপাতালে বেশ কয়েকবার ভর্তি হয়, সংক্রমণের কারণে তার ফুসফুস আর লিভারের কিছু অংশ বাদ দেওয়াও হয়। এক সময় সে এটাও ভাবে যে সে বোধহয় আর সুস্থ হবে না। কিন্তু সে হাল ছাড়ল না, ওর এই বাঁচার ইচ্ছের কাছে হার মানতে হল হাড়-হিম-করা এই দুর্বোধ্য অসুখকে। তারিখটা ছিল ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৫। ব্রেন্ডেনের ওপর একটা পরীক্ষামূলক পদ্ধতির প্রয়োগ করেন ডাঃ ডন কোহন। এই পরীক্ষাতে ডাঃ কোহন প্রথমে ব্রেন্ডেনের রক্তের স্টেম-সেলগুলি সরিয়ে নিয়েছিলেন, এরপরে ওই সেলগুলিকে তিনি এমনভাবে সংশোধন করেছিলেন যাতে সমস্যাদায়ক জিনটি অপসারিত হয়, এবং সবশেষে ব্রেন্ডেনের ওপর পুনরায় এই পরিবর্তিত রক্তের স্টেম সেলগুলি প্রয়োগ করা হয় যাতে, এই পরিবর্তিত রক্তের স্টেম-সেলগুলি সংক্রমণ থেকে লড়াই করে জয়ী হতে পারে এবং একটি প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতে পারে। ব্রেন্ডেন এখন পুরোপুরি সুস্থ। সেও ভবিষ্যতে একজন ডাক্তার হতে চায়।

অন্যদিকে, ড্যানভিলের জ্যাক জেভিয়ার তার হাইস্কুল থেকে উত্তীর্ণ হবার আগেরদিন একটি পুল-পার্টিতে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা হল সেই পার্টিতে, তা সত্যি বিভীষিকাময়। একটি অ্যাক্সিডেন্টে জ্যাকের মেরুদণ্ড এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে সে হাত ব্যবহার করার ক্ষমতা হারায় এবং বুক থেকে অবশ হয়ে যায় তার সমস্ত শরীর। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার ঠিক কয়েক সপ্তাহ পরে, বৃহস্পতিবার, ৭ জুলাই, ২০১৬ সিআইআরএম-অর্থায়িত ক্লিনিকাল পরীক্ষায় স্টেম-সেল ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয় জ্যাকের ওপর। তাকে সান হোসের সান্তা-ক্লারা-ভ্যালি মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার গলায় ১ কোটি স্টেম-সেল প্রতিস্থাপন করা হয়। এই পরীক্ষার পর জ্যাক পুনরায় তার বাহুগুলিতে সাড় ফিরে পায় এবং ব্যবহার করতে শুরু করে। এক্ষেত্রে আমি এটাই বলতে পারি, শুধু চিকিৎসা বিজ্ঞান নয়, জ্যাকের অসম্ভব মনোবল, বাঁচার ইচ্ছে আর কঠোর পরিশ্রম তাকে আজকে ১২ ফুট গভীর সুইমিংপুলের নিচে নেমে গিয়ে স্কুবা-ডাইভিং-এর গিয়ার লাগাতেও সাহায্য করেছে। এমনকী সে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার জন্যও প্রস্তুত করছে নিজেকে।

এবার যার কথা বলব তার নাম আহমেদ। আহমেদ জন্ম থেকেই থেলাসেমিয়াতে আক্রান্ত। থেলাসেমিয়া এমন একটি রোগ যেটিকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত রক্তরোগ বলা যায়। এই রোগে দেহ হিমোগ্লোবিন তৈরি করতে পারে না, যার ফলে মারাত্মক রক্তাল্পতা, অবসন্নতার শিকার হতে হয় আহমেদকে। এমনকী এই রোগ গুরুতর আকার ধারণ করলে মানুষ পঙ্গুত্ব এবং মৃত্যুর সম্মুখীনও হতে পারে। এমত অবস্থায় একদিন আহমেদের আম্মি ও আব্বু জানতে পারেন যে তাঁরা তাঁদের দ্বিতীয় সন্তানের প্রত্যাশা করছেন। আর ঠিক তখনই তাঁরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তাঁরা তাঁদের দ্বিতীয় সন্তানের মূল্যবান স্টেম-কোষ সংগ্রহ (স্টেম-সেল ব্যাঙ্কিং) করবেন যেটি তাঁদের বড় ছেলে আহমেদের থ্যালাসেমিয়ার চিকিৎসার সাহায্যে আসতে পারে। যখন আহমেদের বোন অ্যালানাউড জন্মগ্রহণ করলেন ঠিক সেই সময় চিকিৎসকরা তার নাড়ির থেকে স্টেম-কোষ সংগ্রহ করেন এবং আহমেদের ওপর স্টেম-কোষ প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়াটির অভাবনীয় সাফল্যে আহমেদ ছয় মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে। আহমেদের এখন সাত বছর বয়স। অন্যান্য শিশুদের মতো আহমেদও ঠিকঠাক বেড়ে উঠছে। আহমেদকে এখন আর ওষুধ খেতে হয় না, সে স্কুলেও যাচ্ছে এবং অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলোও করছে।

শুধু ব্রেন্ডেন, জ্যাক বা আহমেদ নয়, ম্যাজিক-কোষের এইরকম অনেক সত্যিকারের গল্পের কথা তোমরা নিজেরাও খুঁজে নিতে পারো গুগল সার্চ দিয়ে। আমি আশা রাখি যে এই সব অনুপ্রেরণামূলক সত্যিকারের গল্পগুলি অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করবে যারা বিভিন্ন রকম বিরল রোগে ভুগছেন।

ঋণ: ১। Y Jung , G Bauer and J A Nolta. Concise Review: Induced Pluripotent Stem Cell‐Derived Mesenchymal Stem Cells: Progress Toward Safe Clinical Products. STEM CELLS 2012; 30:42–47; ২। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট ফর রিজনেটিভ মেডিসিন (https://www.cirm.ca.gov/our-progress/stories-hope-cirm-stem-cell-four); ৩। https://www.smartcells.com/baby/