Categories
পুজোর খাতা ২০২৪ |

রথীন মাহাতোর কেরামতি

65 |
Share
| ২ অক্টোবর, ২০২৪
তরুণকুমার সরখেল

চিত্রবিন্যাস/ কমলাকান্ত পাকড়াশী

পরিচালক তারাপদবাবু তাঁর ছবি নির্মাণের সময় হঠাৎ ঘটে যাওয়া কিছু মুহূর্ত বা ঘটনাকেও তাঁর ছবিতে জুড়ে দিতে ভালোবাসেন। এটা তাঁর একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য বলা যেতে পারে।

একবার চাতামঘুটুর ডুংরি ঘেরা অঞ্চলে তিনি ‘দুষ্টুলোক’ সিনেমার কয়েকটি শট নেবার সময় নিতাই নামের একটা লোককে পছন্দ করে ছিলেন। লোকটি রং-চটে-যাওয়া একটি ছেঁড়া ছাতা নিয়ে ডুংরির ওপরে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ ওই লোকটির উপর নজর চলে যায় তারাপদবাবুর। লোকটিকে ছাতা সমেত খেদন দাসের ভূমিকায় দিব্যি মানিয়ে যাবে। গ্রামের ধুরন্দর মোড়লকে উচিৎ কথা বলতে সকলেই ভয় পায়। কিন্তু খেদন দাস নামের লোকটি ভয় পায় না মোটেই। তারাপদবাবু সেই নিতাই নামের লোকটিকে দিয়ে সুন্দর অভিনয় করিয়ে নিতে পেরেছিলেন। নিতাই ছাতা মাথায় দিয়ে হাত নেড়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে মোড়লকে গালাগালি দিতে দিতে দূরের একটা মহুল গাছ পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে তার অভিনয় শেষ করেছিল। তার অভিনয় দেখে অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন তারাপদবাবু।

আরেকবার ‘উশুলডুংরির রাজা’ সিনেমার শুটিং-এ ঘটেছিল একটা অদ্ভুত ঘটনা। রাত্রে তিনি তাঁর দলবল নিয়ে যেখানে ছিলেন তার পাশেই একটি টোলায় আগুন লেগে যায়। বনের শুকনো ঘাস-পাতার মাধ্যমে সেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছিল এখানে সেখানে। আগুন নেভাতে যারা এগিয়ে এসেছিল আগুনের লেলিহান শিখায় তাদের চোখ-মুখ ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সারা গায়ে মাথায় কালো ছাই মেখে বিধ্বস্ত সেই সৈনিকরা খোলা মাঠে শুয়ে পড়েছিল ভোরের দিকে। সেই দৃশ্য দেখে তিনি ছবিটাকে নতুনভাবে সাজিয়ে নেন। কঠিন বাস্তবের সঙ্গে কিছুটা রং মিশিয়ে তিনি ‘উশুলডুংরির রাজা’ সিনেমাটা বানিয়ে ভীষণভাবে তৃপ্ত হন।

সেই তারাপদবাবু কুশলডির মাঠে তাঁর লোকলস্কর এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ছোট ছোট তাঁবু খাটিয়েছেন। কুশলডির ফাঁকা মাঠটা তারাপদবাবুর আগমনে গমগম করতে শুরু করেছে। রঙিন তাঁবু আর রংবেরঙের পাতাকায় সেজে উঠেছে চারপাশটা। বড় বড় কয়েকটি বাস আর লরিও দাঁড়িয়ে রয়েছে একপাশে। আর এই সব দেখতে পাশাপাশি গ্রাম থেকেও লোকজন এসে ভিড় করেছে এখানে। সকলেই শুটিং দেখতে চায়। তারাপদবাবু এর আগেও তাঁর দলবল নিয়ে এদিকটায় শুটিং করতে এসেছেন। এখানের দুর্দান্ত সিনিক বিউটি তাঁকে মুগ্ধ করে। ক্যামেরায় চোখ রেখে যেদিকেই তাকাও সেদিকেই চমৎকার ল্যান্ডস্কেপ পাওয়া যায়।

রথীন মাহাতোর ছৌ-নাচের আসরে থাকে নিত্য নতুন পালা। মা দুর্গার দ্বারা অসুর বধ অনেকেই অনেকবার দেখেছে বলে রথীন বেশ কিছু সামাজিক পালা ঢুকিয়ে দিয়েছে ছৌ-এর ভেতরে। সেরকমই একটি পালায় রথীন নিজে ভল্লুক সেজে আসর মাত করে দেয়। বেঁটেখাটো ও মোটাসোটা চেহারায় ভল্লুক হিসেবে তাকে বেশ মানায়।

গতকাল ভোরবেলা পর্যন্ত ছৌ-নৃত্য জমেছিল কুশলডি হাই স্কুলের মাঠে। মোট চারটি দল ছৌ-নাচে অংশগ্রহণ করেছিল। রথীন মাহাতোর দল তাদের পালা যখন শেষ করে, তখন আকাশে একটু একটু করে আলো ফুটতে শুরু করেছে।

ক্লান্ত ছৌ-শিল্পীরা গাড়িতে করে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। মুখোশ ছাড়া গায়ের পোশাক গায়েই রয়েছে তাদের। পায়ের পাতায়, হাঁটুতে ও কনুইয়ে শক্ত করে কাপড় জড়ানো রয়েছে তাদের। এগুলো শক্ত মাটিতে লাফাঝাঁপার জন্য দরকার হয়। রথীন মাহাতোর নির্দেশে গাড়ি এসে থামল একটা বড় অর্জুন গাছের নীচে। পাশেই একটা পুকুরও রয়েছে। এখান থেকে তারাপদবাবুদের তাঁবুগুলো চোখে পড়ছে।

অর্জুন গাছের নীচে একপাশে রান্নার আয়োজন হচ্ছে। ছৌ-শিল্পীরা এখানে স্নান সেরে খাবার খেয়ে তারপর রওনা দেবে। সারারাত জেগে সকলেরই খিদে পেয়েছে প্রচণ্ড। রান্নার দায়িত্বে যারা রয়েছে তারা তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। দলের ম্যানেজার রথীনের এখন আর কোন কাজ নেই। তাই রথীন পুকুরে হাত-মুখ ধুয়ে তাঁবুগুলোর দিকে এগিয়ে চলল। সক্কাল সক্কাল ওখানে কীসের ভিড় জমেছে এটা জানতেই রথীনের এত আগ্রহ।

তারাপদবাবু মাথায় একটা ঢেউ খেলানো সাদা টুপি পরে স্থানীয় লোকজনদের ভালো করে পরখ করে দু’-এক জনকে অভিনয়ে সুযোগ দিচ্ছেন দেখে রথীনও সামনের দিকে খানিকটা এগিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু সে তারাপদবাবুর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারল না। রথীন লোকটি মোটা হওয়ার কারণে তারাপদবাবু তাকে অভিনয়ের জন্য নিতে পারলেন না। আসলে একটু লম্বা চওড়া গোছের লোকজন সংগ্রহ করে তাদের তিনি হিরোর সঙ্গে বিশেষ ফাইটিং সিনে কাজে লাগিয়ে দিতে পারতেন। হিরো একটি বাইক নিয়ে সরু পিচের রাস্তা ধরে দ্রুত এগিয়ে যাবে। তখনই তার রাস্তা আটকে জোর ফাইটিং শুরু হবে। এই সব লোকজনদের তিনি কীভাবে ফাইটিং করতে হবে তা শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে পারবেন।

রথীনের অনেক দিনের ইচ্ছে— সিনেমার পর্দায় একবার হলেও যদি তাকে দেখা যেত। কিন্তু তারাপদবাবু তাকে বাতিল করে দিলেন বলে সে মনমরা হয়ে আবার অর্জুন গাছের কাছে ফিরে এল। ভাত সেদ্ধ হতে এখনো দেরি আছে দেখে রথীন হাত পা ছড়িয়ে শুকনো ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। আর ভাবতে লাগল কীভাবে তারাপদবাবুকে খুশি করে সিনেমায় ঢুকে পড়া যায়। অর্জুনগাছের শীতল ছায়ায় বেশ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়ার পর রথীন উঠে দাঁড়াল। তারপর মনে মনে বলল, “যা হবে দেখা যাবে। এই সুযোগটা কাজে লাগাতেই হবে।”
দলের অন্য শিল্পীরা রথীনের কান্ড দেখে অবাক হয়ে গেল।

একটু পরেই তারাপদবাবুর দল রাস্তায় এসে শুটিং-এর কাজ শুরু করে দিলেন। তিনি তাঁর নতুন লোকজনদের ভালো করে বুঝিয়ে দিতে লাগলেন কীভাবে হিরোর বাইক আটকে ফাইটিং শুরু করবে। আসলে নায়কের শহরে ফেরার প্রচণ্ড তাড়া থাকবে। কিন্তু এই সব বাধা অতিক্রম করে সে কিছুতেই শহরে যেতে পারবে না ।

ক্যামেরাম্যান তৈরি হতেই তারাপদবাবু চিৎকার করে উঠলে—‘অ্যাকশন’! হিরো ওদিক থেকে রয়েল এনফিল্ড চড়ে রাস্তা ধরে গাড়ি ছোটাতে লাগল। রাস্তার দু’দিকেই সবুজ গাছ-গাছালি আর মাঝখানে সরু পিচ রাস্তা। সেই রাস্তায় হিরো এগিয়ে আসছে লাল টি-শার্ট গায়ে। দর্শকদের জন্য সুন্দর একটা দৃ্শ্য উপহার দিতে চলেছেন তারাপদবাবু। কিন্তু সিনেমার নামটা এখনো তিনি ঠিক করতে পারেন নি। অনেকগুলো নাম তাঁর মাথায় এসেছে। কিন্তু কোনোটাই ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। আউটডোর শুটিং সেরে ঠান্ডা মাথায় একটা নাম তিনি ঠিক করে নেবেন । আগের সিনেমাগুলোর মতো এই সিনেমার নামটাও যাতে জমজমাট হয় সেটা তাঁকে মাথায় রাখতে হবে।

কিন্তু এদিকে নিমেষের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। পাশের ঝোপঝাড় থেকে ভয়ানক মোটাসোটা একটা ভাল্লুক ছুটে এসে প্রায় মুখোমুখি পড়ে গেল সেই রয়েল এনফিল্ডের। ভাল্লুকটাকে দেখেই গাড়ির গতি কমিয়ে ফেলল ছবির নায়ক শুভাঞ্জন। তারপর ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে গাড়ি সমেত রাস্তার এক পাশে কাত হয়ে পড়ে গেল সে। তবে ভাল্লুকটা কিন্তু তাকে ছেড়ে দিল না। লাফ-ঝাঁপ দিয়ে হিরোকে আক্রমণ করতে গেল এবার। হিরো বেচারা এরকম ভাল্লুকের মুখোমুখি পড়ে যাবে তা ভাবতে পারেনি। নিশ্চয়ই কোনোদিন কোনো বাইক আরোহী এই ভাল্লুকের ছানাপোনাদের মেরে পালিয়েছিল। তাই ভাল্লুকটা বাইক দেখলেই তাড়া করে আসে । শুভাঞ্জন আবার ভাবল তার টকটকে লাল টি-শার্টের জন্য ভাল্লুকটা খেপে যায়নি তো! অনেক সময় লাল রং তাদের উত্তেজিত করে দেয়। এটা ভেবে শুভাঞ্জন
টি-শার্ট খুলে ফেলল দ্রুত। তারপর রাস্তা ধরে পেছেন দিকে ছুটতে শুরু করল।

তারাপদবাবু উল্লসিত হয়ে বলে উঠলেন, ‘সুন্দর দৃশ্য। এই তো চাই। এরকম ন্যাচারল একটা ব্যাপার ছবিতে জুড়ে গেলে মন্দ কী?’
ওদিকে ভাল্লুকও বসে নেই। পিছনের দু-পা দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে হিরোকে সামনের দু-পা দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে এবার। আর ঠিক তখনই শুভাঞ্জন দেখতে পেল ভাল্লুকের হাত-পাগুলো ঠিক মানুষের মতো।
নায়ক তো নায়কই হয় তাকে তো হেরে গেলে চলবে না। তারাপদবাবু নিশ্চয়ই তাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্যই এই ভাল্লুকের দৃশ্যটি রেখেছেন। আসলে তারাপদবাবুর এটাই বৈশিষ্ট্য। তিনি তাঁর ছবিতে এরকম দু-একটি চমক জুড়ে দিতে চান সবসময়।

এরপর শুরু হল সিনেমার নায়ক শুভাঞ্জনের সঙ্গে ভাল্লুকের ছদ্ম লড়াই। কেউ কাউকে আঘাত না করে সংকীর্ণ পিচ রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে লাগল দুজনেই। মনে হচ্ছে গড়াগড়ি খেতে খেতে দুজনেই পাশের জঙ্গলে ঢুকে পড়বে এবার। এটা ভেবেই ভয় পেলেন তারাপদবাবু। তিনি ভীষণ জোরে ‘কাট’ ‘কাট’ বলতে লাগলেন। ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা বন্ধ করে দিলেন। যারা পাশে দাঁড়িয়ে সিনেমা শুটিং দেখছিল তারা এরকম একটি জ্যান্ত ভাল্লুকের সঙ্গে হিরোর ফাইটিং দেখে উল্লাসে ফেটে পড়ল। যে সব লোকজন নায়কের সঙ্গে ফাইটিং করবে বলে তৈরি ছিল তারা এবার হিরোকে ভাল্লুকের হাত থেকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এল।

লোকজনদের কাছে এগিয়ে আসতে দেখেই ভাল্লুক এবার শুভাঞ্জনকে ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। তারপর ভাল্লুকের মুখোশটা খুলে তারাপদবাবুর কাছে এসে কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘স্যার আমি রথীন মাহাত। ‘হাসাপাথর ছৌ-নৃত্য দল’-এর ম্যানেজার আমি। আসরে ভাল্লুক সেজে অভিনয় করি। আপনার ছবিতে একটুখানি স্থান পেতেই আমার ভল্লুক সেজে আগমন। আমাকে ক্ষমা করে দেবেন।’
তারাপদবাবু হাসতে হাসতে বললেন, ‘এ তো দারুণ অভিনয়। আমি তো একটি সত্যিকারের ভাল্লুকই ভেবেছিলাম আপনাকে প্রথমে।’

নায়ক শুভাঞ্জন হাজরা রথীনের কাছ থেকে ভাল্লুকের মুখোশটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। তারপর বিস্ময়ের সঙ্গে বলল, ‘কে বলবে সাজানো ভাল্লুক! আমি তো আর একটু হলেই আপনাকে গাড়ি চাপা দিয়ে ফেলতাম!’

তার কথায় রথীন মাহাত লাজুক হেসে বলল, ‘ছবিতে সুযোগ পেতে গেলে একটু ঝুঁকি তো নিতেই হবে!’
এ কথা শুনে তারাপদবাবু অভয় দিয়ে বললেন, ‘ভাল্লুকের সঙ্গে শুভাঞ্জনের আই মিন . . . হিরোর পুরো লড়াইটা ক্যামেরাবন্দি হয়েছে। এরকম একটা রিয়েল ফাইটিং আমি অত সহজে হাতছাড়া করব ভেবেছেন? তাছাড়া এই সিনেমার পোস্টারে হিরোর সঙ্গে যুদ্ধরত একটা ভালুকের বড় ছবি থাকলে পুরো বিষয়টা একেবারে জমে যাবে।’

এই বলে তিনি রথীন মাহাতোকে মাঝখানে রেখে তাঁর দলবলকে হাঁক দিলেন। রথীন অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ভাল্লুক সেজে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। ক্যামেরাম্যান তৈরি হতেই তারাপদবাবু আবার চেঁচিয়ে উঠলেন—
‘অ্যাকশন’। অমনি ক্লিক ক্লিক শব্দে পুরো টিমটাই ঢুকে পড়তে লাগল ক্যামেরার ছোট্ট লেন্সের ভেতরে।