১
আবছায়া দিন। রোদ ওঠেনি। মেঘলা আকাশের ছাই রঙে মিশে আরও গোমড়া হয়ে আছে জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে কালচে-সবুজ জলাজমিতে ঝুপ করে কী যেন পড়ে। ভাঙা ডাল বোধহয়। পচা পাতা আর শ্যাওলায় বাতাস ভারী হয়ে আছে। জঙ্গলের মধ্যে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়।
যতদূর চোখ যায় শুধু ঘাসজমি। মাথা নিচু করে সেখানে লুকিয়ে থাকা যায় স্বচ্ছন্দে। দুরের পাহাড়-সীমানায় জমাট-বাঁধা মেঘের দলের দিকে ঘাড় উঁচু করে তাকায় ওরা। কী যেন দেখে। অজানা কোনও সংকেত? কীসের আশঙ্কা? সারাদিনের আগুনঝরা রোদে অভ্যস্ত ওরা। সূর্যের আলো ক্ষীণ হয়ে এলে ওরা ভয় পায়। আজকাল বড় ঘন ঘন আঁধার হয়ে আসে। মাঝেমধ্যে পায়ের তলার মাটি কেঁপে ওঠে। তখন দৌড়য় ওরা। প্রাণভয়ে ছোটে। কেউ কেউ ভারী শরীর নিয়ে ধীরগতিতে। হালকা ছোটরা তীরের মতো ছিটকে যায়। পালাতে চায় সকলেই। ওদের সকলের পায়ের ভারে মাটি আরও কাঁপতে থাকে। ওদের মধ্যে একটা বড় প্রাণী দলছুট হয়ে দৌড়য়। তৃণভূমি বাঁক নিয়ে যেদিকে উপত্যকায় মিশেছে, সেইদিকে একা ছুটতে থাকে। তার বড় বড় পায়ের চাপে জমিতে কাঁপন। উঁচুনিচু উপত্যকায় একা এসে দাঁড়ায় একবার। আকাশের রঙ ঘোলাটে। পৃথিবীটা বড় অচেনা হয়ে যাচ্ছে আজকাল। বিশাল চেহারার প্রাণীটা চুপ করে দাঁড়ায়। যেন অপেক্ষা। সময়ের অপেক্ষা। নতুন কোনও আলোর জন্য সে আরও একবার গলা তুলে তাকায় আকাশের দিকে।
প্রতিবার ঠিক এই সময় ঘুমটা ভেঙে যায়। আবছা আলোয় প্রাণীটাকে আর ভালো করে দেখা হয় না। চেনা স্বপ্ন। রু জানে, এই স্বপ্নটা ওর কাছে আবার আসবে। আধোঘুমে রু বুঝতে পারল বাইরে বরফ পড়ছে।
শীত জাঁকিয়ে বসেছে। উত্তর দিক থেকে কনকনে হাওয়া হু হু করে হাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়তে চায়। রুয়ের ফারের কোট আর দস্তানাগুলোর ফাঁকফোঁকর গলে ঠিক খুঁজে নেয় যাওয়া আসার পথ। মিহি তুলোর মতো বরফ পড়লে রুয়ের কিচ্ছু ভালো লাগে না। আশেপাশের সব কিছু হারিয়ে যায় একটা তুহিন ঝিলিমিলির মধ্যে—পাক খেয়ে খেয়ে ঝরতে থাকে বরফের সাদা সাদা টুকরো। সারাদিন নিঃঝুম। চারপাশ বেরঙিন। আকাশ, পাহাড়, জল, মাটি সব একাকার। একটানা ঘরে বসে থাকা। খেলাধুলো সব বন্ধ। ধুস।
বছরের অন্যদিনগুলো বেশ হই হই করে কাটে। প্রায় বাইশটা পরিবার থাকে এই ছোট্ট গাঁয়ে। দূরে ঝকঝকে নীল আকাশের গায়ে সাদা বরফমোড়া পাহাড়ের সীমানা। পায়ের কাছে ঘন সবুজ মখমল ঘাস। যতদূর চোখ যায় উঁচুনিচু জমি। রু একটা কাপড়ে মোড়ানো মস্ত বল নিয়ে ছুটোছুটি করে রোজা আর ইলানার সঙ্গে। বাকি বাচ্চারা বল নিয়ে লোফালুফি খেলে না। উইলোকাঠের একটা ঠেলাগাড়ি নিয়ে খেলে। রুয়ের থেকে অবশ্য তারা বয়সে বেশ ছোট।
ভোরের আলো ফুটতে ঢের দেরি। এখন আবছা অন্ধকার। ঘোড়াগুলোর পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে খটাখট। ভেড়ার দল খামারের মধ্যে রয়েছে। ঘাড় গুঁজে ছটফট করছে সব। কাঠের দরজা খুলে দিলেই হয়ত পিলপিল করে ছুট লাগাতে চাইবে। ওদের খুব মজা। গায়ে পুরু লোমের প্রাকৃতিক সোয়েটার। এই ঠাণ্ডায় ওরা কিন্তু একটুও কাবু হয় না। তবে বেরিয়ে যাবে কোথায়? যতদূর চোখ যায়, সব ঘাসজমি বরফে ঢাকা। বেরিয়ে খাবে কী? কাজেই ওরাও বন্দি।
রু জানে, ঘরে আগুন জ্বালানোর কাঠ নেই। গতকাল রাতেই নিচু গলায় জানিয়েছে মা। বাবা তখন চুপ করে বসেছিল। হঠাৎ রু’কে ডেকে বলল, “রু, তোকে এবার ঘোড়ায় চড়া শেখাব। শীতটা কাটুক। ঘোড়ায় না চড়তে পারলে একা দূরের গাঁয়ে যেতে পারবি না। এরপর তুইও ভেড়া চরাবি। ওদের পাহারা দিবি। দেখিস, মজা লাগবে।”
রু হাসে। ও জানে, বাবা এসব বললেও আসলে বাবা স্বপ্ন দেখে রু অনেক পড়াশোনা করুক। শহরে গিয়ে হাইস্কুলে পড়ুক। আবার মাঝেমধ্যে ফিরে এসে এই গ্রামেও থাকুক। বাবা খুব মজা করে কথা বলে। বছরের অনেকটা সময় রুয়ের বাবা জুরিন কাছের ওশ কিংবা জালালাবাদ শহরে থাকে। বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্মের অনেকটা সময়। সেখানে বিদেশিদের অনেক শহর ঘুরিয়ে দেখায়। তাদের এই দেশের গল্প বলে। ভীষণ সুন্দর করে গল্প বলতে পারে বাবা। এই দেশটার ইতিহাস, যাযাবরদের গল্প, কেমন করে অন্য দেশের মানুষ ব্যবসাবাণিজ্য করতে এসেছে এই দেশে, সিল্ক রুট দিয়ে যাওয়া-আসা করতে করতে কেমন করে মিলেমিশে গেল তারা এই অঞ্চলের সঙ্গে, চীন আর মোঙ্গল শাসকদের কথা . . . সব গল্প জুরিন খুব মিষ্টি করে বলে। বিদেশি পর্যটকরা হাঁ করে শোনে। বাবাকে নানান প্রশ্ন করে। তারপর তারা ছবি তোলে। অনেক ছবি। পাহাড়ের ছবি, নদীর ছবি, উঁচুনিচু উপত্যকার ছবি। বাবা যখন ঘরে ফিরে এসে সেসব বলে, রুয়ের খুব গর্ব হয় নিজের দেশটার জন্য। কি অপূর্ব ওদের দেশ! আর গর্ব হয় বাবার জন্য। ওর বাবার মতো ট্যুরিস্ট গাইড এই গাঁয়ে আর কেউ নেই।
বাবার তামাটে গালে চেরা দাগ। বয়সের আঁচড়। নানীরও আছে অমন। আর উলানকাকার। কিন্তু রু দেখেছে ওর মায়ের গালটা কী মসৃণ। মায়ের টকটকে ফর্সা মুখে যেন একদলা মাখন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। মায়ের দু’হাতে পিছলে পড়ে নরম আলো। মা ওই দুটো হাত দিয়ে চিনেমাটির বড় বড় কাপে সকলের জন্য টী-পট থেকে গরম চা ঢালে। কালো কড়া চা। সঙ্গে বড় রুটি। মাঝেমধ্যে শুকনো মাংস। আলুপোড়া। ঠাণ্ডার দিনে এছাড়া তেমন কোনও খাবার এখানে পাওয়াও যায় না।
ইলানাদের কয়েকটা গরু আছে। ওরা নিজেরা গরুর দুধ খায়। গরুর বাড়তি দুধ বিক্রিও করে। কিন্তু প্রতিদিন একই বাড়িতে বিক্রি করে না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেয়। একদিন রোজা আর উলানদের দেয়। পরদিন হয়ত পিটারদের দিল। পরিবারগুলো সবাই সবাইকে দেখে। জাঁকিয়ে শীত পড়লে যখন খাবারের ভাঁড়ার ফুরিয়ে আসে, তিন-চারটে পরিবার জড়ো হয়ে খেতে বসে একসঙ্গে। ভাগাভাগি করে খাওয়াদাওয়ার দিনগুলোর জন্য অপেক্ষা করে থাকে রু, ইলানা, রোজা . . . সবাই। খুব হুটোপাটি করে ওরা। ঘোড়ার দুধ, ভেড়ার কলজে ভাজা, রুটি, কড়া চা দিয়ে দারুণ খাওয়া জমে যায়। তখন খাবারের থেকে বড় হয়ে ওঠে পাশে বসে খুনসুটি। সবার প্লেটে সমান ভাগ, সবাই হাসিমুখে গল্প করছে, রুয়ের মন ভালো করা মুহূর্ত সব।
বাইরে ঘোড়াগুলোও আনন্দে ছটফট করে।
ওতুন আর বাকিয়েভ রুয়ের বাবার সঙ্গে আড্ডা দেয়।
“ও জুরান, কোথায় গেসলে এবার?”
“আমাদের এভিসেনা ইন্টারন্যাশনাল কলেজ, যেখানে ডাক্তারি পড়ানো হয়, সেইখানে এসেছে অনেক ছাত্র-ছাত্রী। তাদের নিয়ে শহর ঘোরাতে হল। পড়া শুরু করার আগে তারা এই দেশটা দেখতে চায়, চিনতে চায়।”
“কিন্তু অত অল্প সময়ে তুমি কী দেখালে ওদের?”
রু এই সময় কান খাড়া করে শোনে। এই চারণভূমির বাইরের পৃথিবী তার অদেখা, অচেনা। বাবার মুখে গল্প শোনার জন্য সে হাঁ করে বসে থাকে। রু জানে, বাবা যেদিন গল্প বলার মেজাজে থাকবে, সেদিন বাবা একদম অন্য মানুষ। কোথায় যেন হারিয়ে যায় সে।
“বিশকেক শহরটাই ভালো করে ঘুরে দেখল ওরা। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সব . . . খুব ছটফটে। ভালো লাগছিল, জানো, সবাই ডাক্তার হবে। এদেশে পড়তে এসেছে . . .।”
“তুমি এবার বিশকেকে ছিলে নাকি?”
“হ্যাঁ গো। নিয়ে গেল আমাদের। সব ঘুরিয়ে ওশ অবধি নিয়ে এলাম।”
রু আর ইলানার মা দুজনে মিলে আজ নুডলসের মধ্যে ঘোড়ার মাংসের টুকরো মিশিয়ে রান্না করেছে। দারুণ গন্ধ। ওতুন ছটফটিয়ে ওঠে, “উঃ, কতদিন নুডল খাইনি।”
বাবা হাসে, “খাও খাও। শহর থেকে অনেকটা এনেছি এবার। দিন পনেরো ভালোভাবে খেতে পারব সকলে।”
রু আর ইলানা চোখাচোখি করে হাসে একবার। গরম গরম খেয়ে নিতে হবে। উনুন থেকে নামানো মাত্র ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। ঠাণ্ডা হলে খাবারের মজাটাই মাটি।
রু ভেবে নেয়, আজ রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সকলে চলে গেলে ওই অন্য দেশের ছেলেমেয়েদের গল্প শুনবে বাবার কাছে। বাবা ওকে বলেছে, ওরা অনেক দূরের সব দেশ থেকে এখানে পড়তে আসে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল . . . রুয়ের কাছে সব অচেনা জায়গা। নাম শুনেছে কেবল। দেশগুলোর কথা কিচ্ছু জানে না রু। ওদের গ্রামের ছোট্ট স্কুলের ভূগোল বইতে শুধু ওদের এই দেশের চারপাশের সীমানার দেশগুলোর নাম লেখা। চীন, উজবেকিস্তান আর কাজাকস্তান। বাকিটা বাবার মুখে শুনে নিতে হবে।
তারার আলোয় বাবার কাছ ঘেঁষে বসে রু।
“বাবা, ওই দেখো।”
মিহি পেঁজা তুলোর মতো বরফে ঢাকা তৃণভূমিতে এক আশ্চর্য আলো। তারার আলো। শীতের গভীর অন্ধকার রাতে হাজার তারার আলোয় ঝিকিয়ে ওঠে চারপাশ। কী এক অপার্থিব মায়াময় পরিবেশ।
“সেই গল্পটা বলবে বাবা?”
রুয়ের বাবা ছেঁড়া দস্তানা পরা অবস্থাতেই রুয়ের ছোট্ট নরম হাতদুটোকে যত্ন করে ডলে দেন। ঠাণ্ডায় ফ্যাকাশে শুকনো ঠোঁট। “কোন গল্পটা রে?”
“সেই যে, একটা রাখাল ছেলে ভেড়া চরাতে চরাতে গিরিখাত বেয়ে চলে গেল . . . ফেরার সময় অন্ধকার . . . অথচ অনেকদূরের পথ . . .”
“ওঃ, সেই আলেক্সেই রাখালের গল্পটা? আর কতবার শুনবি রু?”
“অনেকবার শুনব বাবা, বলো না গো,” কোলের মধ্যে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ে রু।
বাবা ওর চুলের মধ্যে যত্ন করে বিলি কেটে দেন। বলেন, সেই রাখালের গল্প। যে রাখাল ছেলে আলেক্সেই আনমনে ভেড়ার পাল নিয়ে অনেকদূর চলে গিয়েছিল। আপনমনে সে চলছে তো চলছেই। কখনও সরু নদীর ধারে বসে পা ডোবায়, আঁজলা ভরে জল খায়, পুঁটলি থেকে শুকনো রুটি আর চীজের টুকরো বের করে চিবোয়। আর হাঁটতে থাকে। নদী পেরিয়ে দূরের পাহাড়ের একেবারে কাছে যখন গিয়ে পৌঁছল, তখন সন্ধে নেমেছে। ভেড়াগুলো অনেকদূরে। এদিক-ওদিক চরে বেড়াচ্ছে। আলেক্সেই খুব সাহসী। ভয় পায়নি একটুও। সে চুপটি করে একমুহূর্ত ভেবে নিল, এবার কী করবে সে। উঁচু পাহাড়ের কোলে ছোট-বড় গুহা অনেক। গুহাতে বন্য জন্তু থাকা বিচিত্র কিছু নয়। কোমরের ছুরিটা শক্ত করে ধরে আলেক্সেই ঠিক করল, একটা গুহাতে রাত কাটাবে। পরদিন ভোরের আলো ফুটলে আবার নিজের গাঁয়ের দিকে ভেড়ার পাল নিয়ে ফিরে যাবে।
“তারপর কী হল বাবা?”
বাবা তাকিয়ে দেখেন, রুয়ের আধবোজা চোখের ওপর ছায়া ফেলছে আলেক্সেই। যে আলেক্সেই গুহাতে ঢুকে দেখেছিল গুহার বিরাট দেওয়াল জোড়া অপূর্ব সব ছবি। হরিণ, ঘোড়া, ভেড়া আর মানুষের ছবি। যেমন তার রঙ, তেমন তার ভঙ্গিমা। মুগ্ধ হয়ে দেখতে দেখতে আলেক্সেই অনুভব করে বাইরে অন্ধকার হয়ে এলেও গুহার মধ্যেটা অল্প আলোয় ভরে উঠছে। সেই আলোয় ছবিগুলো সব জীবন্ত হয়ে উঠছে একটু একটু করে।
রু আধোঘুমে অস্ফুটে বলে, “বাবা, ওই পাহাড়টা পেরোলেই কী ওইসব দেশ?”
“কোন দেশ রু?”
“বাংলাদেশ নেপাল ইন্ডিয়া . . .।”
(ক্রমশ/ আসছে দ্বিতীয় পর্ব)