(প্রথম পর্বের পর)
২
গাঁয়ে প্রায় সবাই চাষবাস করে। এখন আলু আর গাজরের বীজ ছড়ানো চলছে। মাটি কুপিয়ে বীজ ছড়াতে হাত লাগিয়েছে সকলে। ঢালু জায়গায় জল গড়িয়ে যায়, তাই সমতল অঞ্চল দেখে বীজ বুনছে বাড়ির মেয়েরা। আগের দু’দিন ছেলেরা মাটি কুপিয়ে দিয়েছে। ঘোড়াগুলো এখন অনেক বেশি তরতাজা। সকাল হলেই খামার থেকে ভেড়ার পাল গম্ভীরমুখে দল বেঁধে চরতে যায়। রু ওদের হাঁটা দেখে আর ভাবে, সব গোমড়ামুখো বুড়ো মানুষ নির্ঘাত চলল কোনও জটিল আলোচনা সারতে। একটা কিছু সিদ্ধান্ত আজ নিয়েই ফিরবে! রুয়ের গ্রাম ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা দূরে হেঁটে গেলে নাতালিয়াদের বাড়ি। এক উপত্যকা দূর। নাতালিয়ার ওই বাড়িটাই এখন এই অঞ্চলের একমাত্র ইস্কুল। শীতের সময় ইস্কুল বন্ধ। শীত চলে যাওয়ার সময় রু ছটফট করে ওঠে নাতালিয়ার কাছে যাওয়ার জন্য। শুধু নাতালিয়ার জন্য নয়। নাতালিয়ার বড় ভাই আসিমভের জন্যও। যতক্ষণ ক্লাস চলে, পড়াশোনা চলে, ততক্ষণ একরকম। আর যেই ক্লাস শেষ হয়, আসিমভের পাশে গিয়ে বসে পড়ে রু। ও হল গল্পের খনি।
রুয়ের ছোট্ট গ্রামটা ছাড়িয়ে এলে নাতালিয়াদের গ্রামে অধিকাংশই রুশি। এখানে কিরগিজ আর রুশ দুটো ভাষাই শেখে ওরা। আসিমভ আরও ভাষা জানে। চীনা ভাষা বলতে পারে অনর্গল। আর জানে ইংরেজি। রু ওর পাশে বসে বসে অনেক শব্দ শিখে নিয়েছে। বাবাকে বলে। রুয়ের বাবা অবশ্য ভাঙা ভাঙা ইংরেজি দিয়ে দারুণ কাজ চালিয়ে নেয়। মাঝেমধ্যেই গ্রাম থেকে একেবারে উধাও হয়ে যায় আসিমভ। কোথায় যে যায়, কেউ জানে না। নাতালিয়াও কেমন নির্বিকার। একা একা চুপচাপ মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয়। কোনও অভিযোগ নেই, দুশ্চিন্তা নেই, সবসময় হাসিমুখ। মনে মনে জানে, ভাই ঠিক ফিরে আসবেই।
হালকা সোনালি রোদ্দুর মেখে আজ নাতালিয়া ইতিহাস পড়াচ্ছিল। কিরগিজস্তানের ইতিহাস। মোঙ্গলরা কেমন করে এই দেশ শাসন করেছিল। তুর্কীদের কথা। কিছু টুকরো টুকরো গল্প। এর কিছু গল্প রু বাবার কাছে শুনেছে। সেই কোন আদিকালে ওদের পূর্বপুরুষ ছিল যাযাবর। তাদের রোমাঞ্চকর কাহিনি শুনতে শুনতেই ওরা বড় হয়। কিন্তু আজ আসিমভ ওদের খোলা মাঠের ক্লাসের একদম কাছাকাছি এসে বসেছে। আসিমভ ইস্কুল চলাকালীন ক্লাসের ধারেপাশে আসে না। বহুদিন পরে ইস্কুল শুরু হল বলেই কি আসিমভ এসে বসল? আসিমভ থাকলে রুয়ের সব গোলমাল হয়ে যায়। নাতালিয়ার পড়ানো তখন আর ভালো লাগে না। উসখুস করছিল রু।
আসিমভ ওকে দেখে চোখ দিয়ে ইশারা করল একবার।
নাতালিয়া ভাগ্যিস তাড়াতাড়ি ছুটি দিল আজ! এক ছুট লাগাল রু।
“এই রু, কোনদিকে দৌড়চ্ছিস? বাড়ি যাবি না?” ইলানা ডাকল।
“তুই এগো। আমি পরে আসছি।”
আসিমভের পাশে গিয়ে আলগোছে বসে রু।
আসিমভ হাসে।
“কেমন আছ ক্ষুদে দোস্ত?”
“আমি যেমন থাকি। তুমি কোথায় পালিয়েছিলে এতদিন?”
“অনেকদূর গিয়েছিলাম। এক ফকিরের সঙ্গে আলাপ হল এবার। তার শাকরেদি করছিলাম বলতে পারো।”
বলতে বলতে আসিমভ তার লম্বা ঢোলা জামার পকেট থেকে বের করে দেখায় একটা ছুরি। পাথরের ছুরি। তেমন কারুকাজ নেই। বেশ ভারি। হাতলটা মসৃণ। একদিকটা ধারালো।
“কোত্থেকে পেলে? কী দারুণ!”
“সেই যে সেই ফকিরের কথা বলেছিলাম। সে এটা দিল। জানিস, তিয়েন শান পাহাড়ের অনেকটা ও ঘুরে এসেছে পায়ে হেঁটে।”
“একা একা গিয়েছিল?”
আসিমভের ফর্সা গালে লাল আভা। হাতের আঙুলে ফুটিফাটা দাগ। পায়ে কড়া পড়েছে। স্পষ্ট বোঝা যায়, শুধু ফকির নয়, সেও ওই একই পথের পথিক।
রুয়ের খুব আশ্চর্য লাগে। একজন মানুষ একা একা কেমন করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়? তার যখন খাঁ খাঁ রাস্তায় মনকেমন করে, তার যখন হলুদ পাতার আড়ালে পাখির শিস শুনে মন ভালো হয়, তার যখন নদীর জলে পা ডুবিয়ে পাথরে বসে চেঁচিয়ে কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করে, তার একার গলা যখন পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে নিজের কাছেই ফিরে ফিরে আসে, সে তখন কী করে?
আসিমভ বলে, “একা ছাড়া আবার কী? আসলে কিন্তু আমরা সব্বাই একা। খুব ভালো করে ভেবে দেখ। তুই, আমি, নাতালিয়া, ওই রোজা, উলান… সবাই।”
“ফকির তোমাকে এই পাথরের ছুরিটা কেন দিল আসিমভ?”
“ফকির আমাকে অনেক কিছু দেয়। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়। আর আমার জন্য ভেবেচিন্তে নিয়ে আসে। জানিস রু, ফকির বলেছে, এই পাথরের ছুরিটা অন্তত হাজার দশেক বছরের পুরনো। বা তার বেশিও হতে পারে। সেই যখন হয়ত মধ্য সাইবেরিয়ার ইয়েনিসেই নদীর উপত্যকায় থাকত আমাদের পূর্বপুরুষেরা। সেই সময়কার হয়ত। তারা তখনও কির্গিজ হয়ে ওঠেনি। তখন তাদের নাম জিয়ানকুন। সেই সময়ে কোনও শক্তসমর্থ তাগড়া জোয়ান হয়ত পাথর ঘষে বানিয়েছিল এই ছুরি। এতে নিশ্চই লেগে রয়েছে বুনো শেয়ালের কাঁচা রক্ত, ভেড়ার লোম, উটের চামড়া…” আসিমভ আনমনা হয়ে যায়।
রু ছুরিটাতে ধীরে ধীরে হাত বোলায়। যাযাবর শ্রেণির পায়ে পায়ে শুধু অনিশ্চয়তা আর রোমাঞ্চ। পাথুরে রাস্তা বেয়ে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড় পেরিয়ে ওরা দল বেঁধে যাচ্ছে নতুন আস্তানায়। এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লা। সেখানে নতুন খাবার, নতুন জলবায়ু আর হয়ত নতুন বন্ধু। এক মরসুম সেখানে ঘাঁটি গেড়ে থাকবে, তারপর আবার অন্য পথে পাড়ি।
রু বাবার কাছে শুনেছে কেমন করে সিল্ক রুট বেয়ে বাণিজ্য করতে এসেছে দলে দলে বিদেশি। শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দেয়। আসিমভের কাছেও অমন সব মানুষের গল্প ঠাসা।
“জানিস রু, তোর চোখে আমি ওই ফকিরকে দেখতে পাই।”
আসিমভের কথায় কেঁপে ওঠে রু। আসিমভের গলার স্বরের মধ্যে, একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকার মধ্যে, কথার মধ্যে কেমন অচেনা সুর।
“কী যে বলো। আমি অমন ফকির-টকির হব না। তবে হ্যাঁ, বাবার মতো গাইড হতে আমার খুব ইচ্ছে করে। জানো আসিমভ, বাবা আর ক’দিন পরেই শহরে চলে যাবে। বিদেশ থেকে যারা আসবে, তাদের নিয়ে সব ঘুরে ঘুরে দেখাবে। আমার ভাবতে বেশ লাগে…। আচ্ছা আসিমভ, তুমি তো এতগুলো ভাষা জানো, তুমি কেন অমন কোনও কাজ করো না? বেশ রোজগার হয়। তাহলে তো নাতালিয়াকে ক্ষেতখামার সব সামলে একা একা ইস্কুল চালাতে হয় না। বেচারি কত কষ্ট করে বলো তো!”
“আমার ওই ধরাবাঁধা গতের কাজ ভালো লাগে না রে। জানি, নাতালিয়ার বড্ড কষ্ট হয়। ওরই বা কী আর এমন বয়স! পেট চালাতে হয়। আমি ভবঘুরে রু। আমার একজায়গায় থাকতে একটুও ভালো লাগে না। ওই ফকিরের মতো সব ছেড়ে ঘুরে বেড়াতে পারলে… সেও আর পারি কই? ক’দিন পরেই নাতালিয়ার জন্য মনকেমন করে। ছুটে বাড়ি চলে আসি। বাপ-মা মরা ছোট বোন। আমি ছাড়া আর ওর কেই বা আছে বল!”
“এই তো তুমি এখন কেমন নাতালিয়ার কথা ভাবছ।”
“ভাবব না? বা রে, বোন হয় যে আমার! শুধু নাতালিয়া নয় রে, আমি তোর কথাও ভাবি।”
“আমার কথা?” রু অবাক বিস্ময়ে তাকায় আসিমভের দিকে।
“হ্যাঁ রে। তোর কথা। ওই যে তোর কপালের ঠিক মাঝখানে একটা লম্বা দাগ টানা… ওটা কী জানিস?”
“কী আসিমভ?”
“ওটা হল তোর পথ। তোর রাস্তা। তোর কপালে আঁকা রয়েছে অনেক দূরের পৃথিবী। দেখিস, ফারঘানার এই পুঁচকে গ্রাম ছেড়ে একদিন তুই অনেকদূরের দেশে পাড়ি দিবি। সব পাহাড় পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে… আমি স্পষ্ট দেখতে পাই।”
আসিমভের কথা শুনে গায়ের মধ্যে শির শির করে রুয়ের। সে তো যেতে চায়। সে যাবেই। কিন্তু কবে আর কীভাবে, কেউ জানে না।
“জানিস, আত্মারা আজকাল আমার কাছে নিয়মিত আসে রু। এই উপত্যকার সব মৃত আত্মারা। আসে, কথা বলে, পরামর্শ দেয়।”
চুপ করে শোনে রু। আসিমভ অনেকরকম চর্চা করে। বিভিন্ন জায়গা থেকে রোগ সারানোর পদ্ধতি শিখে আসে। ও সব বলতে পারে। কারাকোলের গরম ঝর্নার জলে কী আছে, সেই নুন ভর্তি জলাশয়ের জলের কী উপকারিতা…। অনেক গাছপালার নাম জানে, চেনে, গড়গড় করে বলতে পারে তাদের বীজ ছাল বা পাতার গুণাগুণ। কিছুদিন হল আসিমভ পরলোক নিয়ে চর্চায় মেতেছে।
“ওই আত্মারা তোমাকে কী বলে আসিমভ?”
“ওরা… ওরা অনেকে আসে। ওরা আমাকে বলে, আখরোট বনের পাশ দিয়ে সোজা হেঁটে যেতে, তারপর বিরাট উঁচু খাড়া পাহাড়। পেরোনো বড় শক্ত। সেটাই নাকি সোজা গিয়ে মিশেছে এক বিরাট জলাশয়ে। অনেক উঁচুতে সেই হ্রদ। মুক্তোর মতো স্বচ্ছ তার জল। হাড়কাঁপানো ঠান্ডাতেও সেই হ্রদের জল জমে বরফ হয় না।”
“ওদের তুমি ভয় পাও না?”
“নাঃ। ভয় পাব কেন? ওরা যে সব তোর আমার পূর্বপুরুষ। এই উপত্যকাকে, এই গ্রামকে ওরা রক্ষা করছে, আগলে রেখেছে। সবদিকে ওদের নজর। ওরাই তো সাবধান করে দেয় আমাকে… বলে দেয় কখন কোথায় যেতে হবে… সবসময় সঙ্গে থাকে আমার।”
“ওরা ওখানে তোমাকে যেতে বলে কেন?”
“ওই জল বড় পবিত্র রু। একবার যদি ওই জল বয়ে নিয়ে আসতে পারি…”
আসিমভের কথা শেষ হয় না। “আর একবার তুই এই গাঁয়ের বাইরে পা দিয়ে দেখ, কী অবস্থা করি তোর।”
নাতালিয়া কখন ওদের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, ওরা কেউ লক্ষ্যই করেনি। নাতালিয়ার হাতে একটা ঘাস তোলার নিড়ানি। রোদের আঁচে নাতালিয়ার কপালে লেপটে থাকা কোঁকড়ানো লাল চুলের গুছি ঝকমক করে।
নাতালিয়ার দিকে তাকিয়ে একসঙ্গে হেসে ফেলে দুজন। রু আর আসিমভ।
৩
“বন্ধুর পথ দিয়ে ঘোড়া দৌড়ায়,
তুষারের স্তূপ তারা ক্ষুরেতে মাড়ায়…
হেথা হতে অদূরেতে দেখা যায় নাকি
উপাসনা মন্দির দাঁড়িয়ে একাকী।
……
সহসা ঘনিয়ে এল বরফের ঝড়,
নেমে এল তুষারের খই ঝাঁকে ঝাঁক,
ডানার ঝাপট মেরে কালো দাঁড়কাক,
নেমে আসে ধাবমান স্লেজের উপর।
ডাকে তার অমঙ্গল ভনে চরাচর!
ছুটন্ত ঘোড়ারা যেন চমকিয়ে চায়
আতঙ্কে খাড়া হয়ে উঠেছে কেশর
বিষণ্ণ সুদূরে তারা সভয়ে তাকায়।”
নাতালিয়ার কাছে ভাসিলি জুকোভস্কির এই ‘পল্লীগাথা’ কবিতাটি বহুবার শুনেছে রু। নাতালিয়া ভারি সুন্দর বলে। ছন্দের তালে ওর কোঁকড়াচুলে ঢাকা মুখখানা অল্প অল্প দুলতে থাকে। প্রতিবার রু এই কবিতাটির সুরের মধ্যে হারিয়ে যায়। ছন্দের মধ্যে কেমন যেন আবেশ জড়ানো। নিজেকে মনে হয় গভীর রাতে তুষার-ঝঞ্ঝায় অচেনা রাস্তায় হারিয়ে যাওয়া এক পথিক। বারবার সে বরফের ঝড়ের মধ্যে দিয়ে বাড়ির রাস্তার দিকে ফিরে যাবার চেষ্টা করে, আর প্রতিবার কোথায় যেন ধাক্কা খায়। তার বাদামী ঘোড়াটা যতই এগোয়, ততই গিয়ে পড়ে তুষারস্তূপে, কখনও হুমড়ি খেয়ে পড়ে গর্তের মধ্যে। তার কোমর পর্যন্ত ডুবে যায় বরফের মধ্যে। হাঁচড়পাচড় করে উঠে পড়ে রু। চারদিক অন্ধকার। তুষার-ঝড় থেমে গেলেও আকাশ পরিষ্কার হয় না। হয়ত অমাবস্যা। কিংবা চাঁদ ডুবে গেছে। নিজেকে এইসময় কক্ষনও অসহায় ভাবে না রু। একটুও ভয় করে না তার। সাহসী অভিযানের একজন সফল যাত্রীর মতো রু ঘোড়া নিয়ে ধীরে ধীরে শেষ পর্যন্ত বাড়ির রাস্তা খুঁজে পায়। তখন রাতভোর।
অবসর সময়ে চুপচাপ বসে এইসব কল্পনা করে সে অনেকটা সময় কাটিয়ে দেয়। আসিমভকে বলে কখনও-সখনও। কিন্তু আসিমভকে নিজের কাল্পনিক গল্প বলার চেয়ে ওর অভিজ্ঞতার সত্যি কাহিনি শুনতেই বেশি ভালো লাগে।
এপ্রিল মাস পড়লেই উৎসবের সুর। নরুজ পালিত হল মার্চের শেষে। নাতালিয়া বলেছে, ফারসি ভাষায় নরুজ মানে নতুন দিন। উত্তর গোলার্ধে বসন্তের প্রথম দিন। ইরানি ক্যালেন্ডারে নতুন বছরের শুরু। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের প্রাচীন উৎসব। এই গ্রামে কয়েকদিন আগে পর্যন্ত ছিল সেই উৎসবের রেশ। চারপাশটা এমনিই ছবির মতো সুন্দর। কিন্তু এই সময়ে কেমন যেন সব ঝলমল করে ওঠে। সবাই নিজেদের বাড়িঘর ঝকঝকে করে ফেলে। আশেপাশের রাস্তাঘাট যেন আনকোরা নতুন। কোথাও এককণা ধুলো কি শুকনো পাতা পড়ে নেই। পুরনো টায়ার কেটে, প্লাস্টিকের বোতলের মাপসই টুকরো রং করে সাজিয়ে কে কত সুন্দর হাতের কাজ করতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলে। রুয়ের মা মারিয়া এইসব সাজানো গোছানোতে দারুণ পারদর্শী। তাঁর খুব সুনাম। প্রতিবার সকলের ঘরের সামনে অপূর্ব সব ফুলদানি, তীরধনুক আর পালক দিয়ে সাজানো হয়। সব চেয়ে সেরা রুয়ের মায়ের হাতের কারুকাজ। সকলে ভিড় করে দেখতে আসে। রুয়ের নানী রোজা আর ইলানাকে শিখিয়ে দেন কেমন করে সহজ সেলাই দিয়ে ফারের কোট বুনতে হয়।
রু একদৃষ্টে ওদের দেওয়ালে টাঙানো একটা সুন্দর তীরধনুক দেখছিল। পালক লাগানো তেকোনা টুপি, ফারের ধূসর কোট আর ওই একটা তীরধনুক… উফ! নিজের একটা বড় বাদামী ঘোড়া শুধু দরকার। বাবা বলেছিল, এই মাস থেকেই ওকে ঘোড়ায় চড়া শেখাবে।
বাবার একটা কথা হঠাৎ কানে আসতেই মনের মধ্যে থেকে নিজের অ্যাডভেঞ্চার সরিয়ে রাখে রু।
“বুঝলে মারিয়া, আমি এবার একটা হোম-স্টে শুরু করব। তোমাকে ক’দিন আগেই বলেছিলাম। ওশ শহরে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা হয়েছে। সরকারিভাবে ওরা খোঁজ নিয়ে জানিয়েছেন দূতাবাসগুলো রাজি। বিদেশি কেউ বেড়াতে এসে গ্রাম দেখতে চাইলে আমাদের এই গ্রামে এসে তারা আমাদের বাড়িতে অল্প কিছুদিন থাকতেই পারে। থাকার ভালো ব্যবস্থা চাই। আর আমরা যা খাই, অতিথিও তাই খাবেন। শুধু আমাদের নিজেদের ঘরানার খাবারের স্বাদ যেন বুঝতে পারেন।”
রু ছটফট করে ওঠে। আরেব্বাস। এই বাড়িতে এবার বিদেশের লোকজন মাঝেমধ্যে এসে থাকবে? তবে তো দারুণ ব্যাপার!
রুয়ের মা কয়েকটা কাপড় জোড়া দিয়ে নিজের জন্য একটা বড় কেনেল পোশাক সেলাই করছিলেন। চোখ না তুলেই বললেন, “অনেকদিন ধরেই তো চেষ্টা করছ, দেখো এবার যদি তেমন কাউকে পাও। একটু পয়সার সুরাহা হয়। আরেকটা বড় ঘর তবে চটপট গুছিয়ে তুলতে হবে। বাইরে ইয়াটের কাঠের ফ্রেমটা তো মোটামুটি ঠিকঠাক আছে।”
“হ্যাঁ। ওই তাঁবুর কাঠগুলো মেরামত করে নিতে হবে। কোথাও কোথাও নড়বড়ে হয়ে গেছে। দেখতে হবে। আর বাইরের ফেল্টের ওপরটা এবার সুন্দর করে সাজাতে হবে। তুমি আর মা তো আছই। তোমরা সুন্দর হাতের কাজ দিয়ে ঘরটা চমৎকার করে সাজিয়ে ফেলো।”
“জুরিন, এই এত দূরের গাঁয়ে এসে থাকতে চাইবে কেউ?”
“নিশ্চই আসবে,” খুব প্রত্যয়ী হয়ে বলেন রুয়ের বাবা জুরিন।
“ওশ শহর থেকে আমাদের এই গ্রাম কতটাই বা দূর… এসে এখানে চাষবাস দেখবে, আলু, গাজর, আখরোট… হাতে হাতে আমাদের চাষের কাজে সাহায্যও করতে পারে। আমাদের ভেড়ার খামার, ঘোড়ার আস্তাবল… আমাদের এই অঞ্চলে এই এত বড় পাহাড়, এত বিশাল চারণভূমি, পাথরে পায়ের শব্দ করে বয়ে চলা কারাদরিয়া নদীর শাখা… এখান থেকে কিছুক্ষণ গেলেই উজগেন শহর। এমন চমৎকার জায়গা দেখাও দেখি একটা! উজগেন অবধি কিন্তু বহু পর্যটক আসেন। মনে আছে তোমার, গত বছরের আগের বছর এমন বসন্তের সময়ে উজগেনের স্নানঘর আর মিউজিয়ম দেখতে একপাল ছেলেপুলে এসে পড়ল। সবাই ওরা ইতিহাস নিয়ে পড়ছে। সিল্ক রুট আর তুর্কিদের ইতিহাস নিয়ে কত জানে ওরা! আমাকে কিছু বলতেই দিচ্ছিল না। ওদের শুধু জায়গা চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, দেখিয়ে দিচ্ছি, আর ওরা নিজেদের মধ্যে কলকল করে কথা বলে যাচ্ছে। ওদের সেই ভাষা আমি আর বুঝতে পারলাম না। শুধু বুঝেছিলাম, ওরা আমার দেশটাকে আমার চেয়েও বেশি চেনে আর বেশি ভালোবাসে। কত কিছু জানে ওরা…। আমার খুব ইচ্ছে করছিল ওদের কাছ থেকেও একটু ইতিহাসের অজানা গল্প শিখে নিই…”
“উজগেন শহরটা কত পুরনো বাবা?” রু এতক্ষণে ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে বড়দের কথার মধ্যে।
“উজগেন… উজগেন বহু পুরনো। এই সিল্ক রুট যতদিনের, প্রায় ততদিনের। যীশুর জন্মের কত আগেকার শহর। পরে অনেককাল তুর্কীদের রাজধানী ছিল। যারা এই রাস্তা ধরে বাণিজ্য করতে যাওয়া-আসা করত, তাদের জন্য পথের ধারে একের পর এক গোসলঘর তৈরি করা রয়েছে। মসজিদ তো আছেই। প্রায় কুড়ি-বাইশটা মসজিদ। পথ চলতে চলতে বিশ্রাম নেবার জন্য কত সরাইখানা। লাল ইঁটের গাঁথনি, উঁচু খিলান। অনেক কিছুই রয়েছে হুবহু সেই সময়কার মতো। খুব যত্ন করে রাখা। তাই বিদেশি পর্যটকরা সেইসব দেখতে আসেন। আমার মুখস্থ হয়ে গেছে রে… ওশ, জালালাবাদ, উজগেন, কোথায় কী…।”
রু চোখ বুজে ফেলে। ওদের গ্রামের বাড়িতে কেউ থাকতে এলে ও তাকে চিনিয়ে দেবে জুনিপার আর বাদাম গাছ। ওদের বাড়ি থেকে নেমে তিনটে ঢাল পেরিয়ে গেলে যে ছোট্ট ঝোপের ধারে বসে ও ফ্লুট বাজায়, সেইখানে একটা একশো বছরের পুরনো জুনিপার গাছ আছে। তার গুঁড়িতে হালকা নখের চাপে রু নিজের নাম লিখতে চেয়েছিল একদিন। স্পষ্ট শুনেছে, গাছটা ফিসফিস করে বারণ করল ওকে। ব্যথা লাগে না বুঝি! তার পাশ দিয়ে নেমে যাওয়া ক্ষেতের ধারে ঝাঁপিয়ে টিউলিপ ফুল ফোটে। নদীর কাছাকাছি লম্বা লম্বা ফেরুলে ঘাসের জঙ্গল হলুদ ফুলে ভরে যায় মাঝেমধ্যে। ছ’বছর অন্তর ওই ফুল ফোটার কথা। আসিমভ বলেছে, ওইখানে থাকেন এক মৃত্যুর দেবদূত। এই উপত্যকায় যিনি বেঁচেছিলেন কত হাজার বছর আগে। তাঁর তিন-তারওলা কোমুজের সুর নাকি কান পাতলেই শোনা যায় আজও। ফেরুলে ঘাসে ফুল ফুটলে তিনি একবার অন্তত আসবেন। ঘোড়ায় চড়ে তৃণভূমিতে একা একা হারিয়ে যাওয়ার সেই গান শোনার জন্য রু চুপটি করে ওখানে গিয়ে বসে থাকে প্রায়ই। একদিনও শুনতে পায়নি। শুধু পাথরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর কুলকুল শব্দ, ঝোপের ভিতর দিয়ে বাতাসের ভেসে যাওয়ার শোঁ শোঁ আওয়াজে রু মিশিয়ে দেয় তার বাঁশি। অনেক দূরের স্তব্ধ পাহাড় কান পেতে শোনে।
আসিমভ বলে, “আত্মা যদিও বা আসেন, দেবদুত অত সহজে ধরা দেন না। তার জন্য চাই আরও অনেক অনেক সাধনা। দেবদূতের সেই স্বর্গীয় সুর শুনতে পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা?”
সেই সাধনা কেমন, তা’ আর বলেনি আসিমভ।
রু ঠিক করল, ওদের গ্রামের বাড়িতে বিদেশিরা থাকতে এলে ও নিজেই হবে তাদের গাইড। বাবা শহরের জন্যই ভালো। বাবা তাদের শহর ঘুরিয়ে নিয়ে এলে তারপর তার ছুটি। এই গ্রাম রুয়ের অনেক বেশি চেনা, অনেক আপন। তার মাটির কণায় প্রতি ঋতুর আলাদা গন্ধ রু চোখ বুজে চিনে নিতে পারে।
৪
বালির ওপর দিয়ে এগোনোর চেয়ে পাথুরে পথই ভালো।
দলপতি এমনই নির্দেশ দিলেন। দলের কয়েকজন অনিচ্ছুক। সমরখন্দ থেকে খুজান্দ হয়ে ওশে পৌঁছেছে সকলে। কিছুদূরেই কাশগর। তিয়েনশান পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ওদের এগোনোর কথা। তাকলামাকান যতটা সম্ভব এড়ানো যায়। কিন্তু রেশমের জন্য গোবি মরুভূমির পাথুরে পথের দিকে যেতে অনেকেই রাজি নয়। অতদূর ঘুরপথে যাবেই বা কেন? আর তাছাড়া, গোবি মরুভূমির পাথুরে পথ মানেই জলের অভাবে নিশ্চিত মৃত্যু!
মোটামুটি পনেরোজনের দল। অধিকাংশের বয়স তিরিশ থেকে চল্লিশের কোঠায়। দুই কুঁজওয়ালা উটও রয়েছে প্রায় কুড়িটি। এখনও সুস্থ, তেজি প্রত্যেকেই। জালের মতো পথ বেয়ে গিয়ে সংগ্রহ করা হবে রেশম তন্তু। পথে আরও কত বণিকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। বিনিময়ে কাচের বাসন, ধাতু, অস্ত্র… কত কী!
এই শহরে পৌঁছনোর আগেই দূর থেকে দেখা যায় সুলায়মান পর্বতমালা। ওশ এই অঞ্চলের সবথেকে বড় বাণিজ্যকেন্দ্র। বিশাল বাজার। এখানকার সরাইখানায় কত রকম মানুষ আসেন নিয়মিত। বিশ্রাম নেন। রাত কাটান। তাদের নানা ভাষা। কথাবার্তা যদিও বহুক্ষেত্রেই হয় আভাসে ইঙ্গিতে। পোশাক দেখে মালুম হয় কে কোন অঞ্চলের। জেমা বাজারের এক সরাইখানায় এখন যেমন আড্ডা জমেছে তিন ব্যবসায়ীর। তারা কেউ কারও ভাষা বোঝে না। অথচ ঘন্টার পর ঘন্টা খাবার আর পানীয় নিয়ে তাদের কথা চলছে ইশারা-ইঙ্গিতে, নিজেদের নিজস্ব ভাষায়। কয়েক ঘন্টার মধ্যে পৃথিবীর তিনটি দেশের তিন নাগরিক কত মত বিনিময় করে ফেলল।
“এই নাও দোস্ত। এই রইল আমার ছুরি। হাতলের কাজখানা দেখো একবার। হাতির দাঁতের।”
ছুরিটির জন্য হাত বাড়ায় দু’জন। কিন্তু ছুরি তো মাত্র একটি। কুছ পরোয়া নেই। জোব্বার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একটি আতরদান। সে আতরের এক ফোঁটায় বেহেশতের খুশবু। কয়েক মাইল অবধি ছড়িয়ে থাকে তার রেশ। পারস্যের ব্যবসায়ী তাঁর ছুরি আর আতর দিলেন দুই নতুন বন্ধুকে। ভারতীয় বণিক দিলেন রূপোর পিকদান আর পাঁচ রকম সুগন্ধি মশলার এক বিরাট বাক্স। সেই কাঠের বাক্সটির কারুকাজও দেখার মতো। জুরিন কী দেবেন ওদের? জুরিন তার পাশে রাখা চামড়ার ঝোলাটা হাতে নিতে গিয়ে দেখেন, ঝোলাটা নেই! কী আশ্চর্য ঝোলাটা গেল কোথায়? এই তো এখানেই আড্ডা দিচ্ছে সকলে। তেমন ভিড়ও নেই সরাইখানায়। তাহলে? চেঁচিয়ে উঠল জুরিন, “আমার ঝোলা?”
“কিছু বলছেন স্যার?”
ধড়মড় করে উঠে বসে জুরিন। এয়ারপোর্টের এক রক্ষী ঝুঁকে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। দেখেছ কাণ্ড! বিমানবন্দরে বসে অপেক্ষা করতে করতে কখন ঝিমুনি এসেছিল একটু। আর তার মধ্যেই কত স্বপ্নও দেখা হয়ে গেল। উট নিয়ে হেঁটে কত পথ এইটুকু সময়ে পাড়ি দেওয়া হয়ে গেল! সরাইখানার জায়গায় ঝাঁচকচকে বিমানবন্দর। সোজা হয়ে বসে হাই তোলে জুরিন।
গত পাঁচ বছরের মধ্যে ওশ বিমানবন্দরে বারদুয়েক দুর্ঘটনা ঘটেছে। যাত্রীদের মধ্যে তেমন মারাত্মক হতাহত হয়নি কেউ। একবার প্লেনের ডানদিকের মেইন গিয়ার গেল বিগড়ে; ডানদিকের ডানাটাই ছিটকে গেল। কুয়াশায় প্লেন পুরো লাট খেয়ে পড়েছিল সেবার। ভাগ্যি ভালো কারও প্রাণহানি হয়নি। রানওয়ে থেকে প্রায় দশ মিটার দূরে ছিটকে গেল। সামান্য আগুন লাগতে না লাগতেই নেভানো গেছে। বছর চারেকের মধ্যেই আবার; তবে এবার হার্ড ল্যান্ডিঙের জন্য আটজন জখম। জুরিন প্রত্যেকবার এই ওশ এয়ারপোর্টে এসেই এইসব চিন্তা করতে থাকে। এইসব চিন্তার কোনও মানে নেই। কিন্তু ট্যুরিস্টদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে জুরিন আনমনা হয়ে যায়। সেই সিল্ক রুট মনে পড়ে। তখন না ছিল এরোপ্লেন, না ট্রেন, না বাস।
হয় উট, কিংবা ঘোড়া। কোথাও খচ্চর। মাল বইতে কখনও ঘোড়ায় টানা গাড়ি। নিজেদের ব্যবসার মালপত্র সুরক্ষিত রাখতে আর বাণিজ্যে একাধিপত্য বজায় রাখার জন্য চীন পরে একটা আস্ত পাঁচিল বানিয়ে ফেলল!
ঝিমুনি আসে জুরিনের। সে কি আজকের কথা! খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতক। আজকের এই ওশ শহরের মধ্যে দিয়েই হয়ত এগিয়েছে এক বিস্তৃত পথ। প্রায় চার হাজার মাইল রাস্তা। প্রাচ্যের মসৃণ ঝলমলে পালকের মতো ফুরফুরে রেশমসুতোর আকর্ষণে দলে দলে আসছে বিদেশি বণিক। সোনা, হাতির দাঁত, পশম, ঘোড়ার বদলে নিজের দেশে নিয়ে যাচ্ছে চীনের রেশম। মধ্য এশিয়া, মধ্য প্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকারও কিছু দেশ থেকে রেশমের জন্য এই পথে আসা। শুধু কি রেশম? এরপরে রপ্তানি হবে কাগজ, দেশে দেশে পৌঁছে যাবে বারুদ। কাগজে লেখা হবে সভ্যতার ইতিহাস। আবার বারুদ মুছে দেবে একের পর এক সভ্যতা।
“স্যার, প্লেন কিন্তু ল্যাণ্ড করে গেছে।”
সেই রক্ষীটি আবার এগিয়ে আসে। জুরিনের মুখচেনা। নিয়মিত ট্যুরিস্টদের নিতে ওশ বিমানবন্দরে জুরিনকে আসতে হয়, কাজের সূত্রে অনেকেই চেনে ওকে। গলায় একটা কার্ড ঝোলানো। সচিত্র পরিচয়পত্র। হাতে প্ল্যাকার্ড। প্ল্যাকার্ডে নাম লেখা থাকে। ওটি দেখেই বিদেশি ট্যুরিস্ট তাকে চিনে নেন। আজকাল অধিকাংশ সময়ে জুরিন কিরগিজের সরকারি দপ্তর থেকে অনুমতি নিয়ে আসে। দপ্তরের ঠিক করে দেওয়া ট্যুরিস্টদের নিয়ে তাকে ঘুরে বেড়াতে হয়। এক্ষেত্রে ঝামেলা অনেক কম। সবটাই আগেভাগে ঠিকঠাক করা থাকে। কে বা কারা কোথায় যাবেন, কতদিন থাকবেন, কী কী দেখবেন। গাড়ির ব্যবস্থা করে শুধু সঙ্গে থাকা। তবে জুরিন নিজের গ্রামে হোম-স্টে খোলা নিয়ে খুব চিন্তাভাবনা করছে। তার গ্রামটিও এবার প্রচারিত হোক বিদেশিদের কাছে। এটা ঠিক যে, তাদের গ্রামে এখনও টেলিফোনের নেটওয়ার্ক পৌছয়নি। আর পৌঁছয়নি বলেই কোলাহলমুক্ত, অহেতুক দুশ্চিন্তা ওদের ক্লান্ত করে না। সকলে ধৈর্য ধরে সকলের জন্য অপেক্ষা করেন। সকলের মঙ্গলের জন্য একযোগে প্রার্থনা করেন।
জুরিন আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। যাত্রীরা আসছেন। নিজেদের লাগেজ ঠেলে ঠেলে একে একে বেরিয়ে আসছেন শান্তমুখে। ভিড় নেই তেমন। জুরিন পকেট থেকে কাগজপত্র বের করে অপেক্ষা করে। আজ যারা দুজন আসবেন, তাদের মধ্যে একজনের বয়স দশ। সে একেবারে রুয়ের বয়সী। তারা ওশ শহরে থাকবেন দিন দশেক। সেই দশদিন তাদের সব দায়িত্ব জুরিনের। ওকে পর্যটন দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে ইণ্ডিয়া থেকে যিনি আসছেন, তিনি একজন বেশ বড়সড় কেউ। সব পরিচয় বিস্তারিত জানানো হয়নি। সবটা কাগজে লেখা থাকে না। শুধু নাম, বয়স আর পেশা। ইনি পেশায় ডাক্তার। অন্তত পরিচয়পত্রে নামের পাশে তাই লেখা রয়েছে। কিন্তু একজন ডাক্তার শুধু একটি ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে এতদূরের দেশে কী করতে আসছেন?
জুরিন নিজের মনকে সংযত করল। ট্যুরিস্ট গাইডকে এত কথা জানতে নেই। অল্প কয়েকদিনের চলাফেরায় তাঁরা নিজেরা যতটুকু বলেন, ততটুকুই।
দূর থেকে একজন ভদ্রলোককে দেখে মনে হল, ইনিই হবেন। কাগজে নাম লেখা, ডাঃ বি চৌধুরী। বয়স বেয়াল্লিশ। যিনি এগিয়ে আসছেন, তাঁর মুখ দেখে অমন বয়সই মনে হচ্ছে। খুব আস্তে হাঁটছেন। ও আচ্ছা ওনার সঙ্গে সেই দশ বছরের ছোট্ট ছেলে। আর লাগেজের একটা ট্রলি। ছেলেটি আসলে একটু আস্তে আস্তে হাঁটছে। একটা পা সামান্য একটু টেনে টেনে। সেইজন্যই ভদ্রলোকও ক্ষুদেটির সঙ্গে তাঁর হাঁটার গতি কমিয়েছেন। জুরিন দূর থেকে হাত নাড়তে থাকল। আরেক হাতে উঁচু করে তুলে রইল প্ল্যাকার্ড। দূর থেকেই দেখতে পান যেন।
ভদ্রলোক ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। হাসিমুখ।
“হ্যালো, মিস্টার জুরিন। নাইস টু মীট ইউ।”
ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন জুরিনের দিকে।
“আই অ্যাম বিকাশ চৌধুরী। ফ্রম ইণ্ডিয়া। অ্যাণ্ড দিস ইজ মাই সান।”
জুরিনও হাত বাড়িয়ে দেয়। কিরঘিজ প্রথায় করমর্দন করে। “স্যার, ওয়েলকাম টু আওয়ার কানট্রি।”
ছোট্ট ছেলেটি আনমনা হয়ে অনেক দূরের দিকে তাকিয়ে। “বাবা, আমরা কি এখন উটে চড়ে যাব?”
“না বাবা। আমরা এখন গাড়িতে যাব, এটা তো শহর। এখানে উট চলে না।”
“তাহলে ঘোড়া? তাও চলে না?”
“না বাবা। এই রাস্তায় ঘোড়া চড়া বারণ।”
“কলকাতায় কিন্তু চলে। গড়ের মাঠে, ময়দানে। সেই যে, ভিক্টোরিয়ার পাশে…। ওই রাস্তায় বাসও চলে, গাড়িও চলে, ঘোড়াও চলে…”
“হ্যাঁ, তুমি একদম ঠিক বলেছ। কিন্তু এখন আমাদের গাড়ি চড়ে হোটেলে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে স্নান করে খেয়ে…”
“তারপর তুমি একটা ঘোড়া বুক করবে? বাবা, অ্যাপে ঘোড়া বুক করা যায় না?”
জুরিন বুঝতে পারে না ওদের নিজস্ব কথোপকথন। জিগ্যেস করে, “এনি প্রবলেম স্যার?”
“নো প্রবলেম অ্যাট অল। অ্যাকচুয়ালি মাই সান ওয়ন্টস টু গো বাই হর্স অর ক্যামেল… লেটস গো,” ভদ্রলোক ছোট্ট ছেলেটির চুল ঘেঁটে দিয়ে বলেন, “ভানু, তোকে আমি ঘোড়ায় চড়াবই চড়াব। শুধু চড়াব না। ঘোড়ায় চড়া শেখাব। আগে চল দেখি।”
(চলবে)