Categories
গল্পগ্রাম |

রু। পঞ্চম পর্ব।

160 |
Share
| ১১ ডিসেম্বর, ২০২৩
শ্যামলী আচার্য

ছবি: ইন্টারনেট থেকে গৃহীত

(দ্বাদশ অধ্যায়ের পর)

১৩

ভানুর অল্প জ্বর আসছে বারে বারে। রু ঠায় বসে আছে ওর মাথার ধারে। একটুও নড়ছে না। কপালে হাত রেখে গুন গুন করে গান গাইছে। ওদের দেশের গান। ওদের দেশের প্রাচীন সেই মহাকাব্যের নায়ক ‘মানস’-এর গান। মানস-এর জীবন, তার যুদ্ধ . . . মোঙ্গল দস্যুদের হাত থেকে কিরগিজকে রক্ষা করার লোককাহিনি। ভানু মাঝে মাঝে শুনছে, মাঝে মাঝে চোখ বুজে শুয়ে আছে চুপ করে। আজ সন্ধেতে ভানু একটু বেশিই চুপচাপ।

আসিমভ ফেরেনি এখনও। রু জানে, আসিমভ অনেকরকম ওষুধ জানে। সে ঠিক একটা ব্যবস্থা করবেই। শুধু ওর ফেরার অপেক্ষা।

বিকাশ অস্থির হয়ে পায়চারি করেন। তাঁর মন বলছে, কাল রওনা হতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু ইরিন আজও না ফিরলে আরও পিছিয়ে যাবে সব। একটু আগেই জুরিনের সঙ্গে বিস্তারিত কথা হয়েছে তাঁর।

জুরিন নিজেই এসেছিল।

জুরিন নিজে থেকে কিছু বলার আগেই বিকাশ বলে ওঠেন, “আমাদের ফেরার ব্যবস্থা করো জুরিন। ভানুকে নিয়ে শহরে যেতে চাই।”

জুরিনের মুখে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ার আগেই বিকাশ তাড়াতাড়ি বলে ওঠেন, “ভানু সুস্থ হয়ে উঠুক, আমরা বরং আবার আসব তোমাদের গ্রামে . . .  কিন্তু ছেলেটার পায়ের ব্যথা, জ্বর নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে আমার। তুমি মনখারাপ কোরো না জুরিন।”

জুরিন চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে বলে, “সেই ভালো। অনেকেই বলছে ওই উপত্যকায় যাওয়া একদম উচিত হয়নি। মানে, গিয়ে ছবি তুলে চলে এলে ঠিক ছিল, কিন্তু প্রতিদিন যাওয়া, তার ওপর মাটি তোলপাড় করা . . . আমার মা তো খুবই বকছেন আমাদের।”

বিকাশ আর জুরিনের কথার মধ্যেই দূর থেকে দেখা যায় আসিমভ আসছে। একা। তাকে একা ফিরতে দেখেই গম্ভীর হয়ে যান বিকাশ। জুরিন অপ্রস্তুত হয়ে জিগ্যেস করে, “আসিমভ, একা ফিরলে?”

“হ্যাঁ জুরিন। এখনও কাজ বাকি আছে। ইরিন কাল ফিরবে।”

“আসিমভ, কাল সকালেই গিয়ে ইরিনকে ফিরিয়ে আনতে হবে, যে করে হোক। ভানুর জ্বর কমেনি, ব্যথাটাও রয়েছে। এবার চিন্তা হচ্ছে আমার। এখানে না থেকে শহরে গিয়ে একটা ডাক্তার দেখানো উচিত।”

বিকাশের উদ্বে‌গ স্পষ্ট বুঝতে পারে আসিমভ। ঘোড়া থেকে নেমে ততক্ষণে স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছে সে।

“যদি আপত্তি না থাকে, আমি ভানুর কাছে থাকব আজ। সারা রাত। আর, আমি সামান্য কিছু ওষুধপত্র জানি, খেতে হবে না, লাগালেই চলবে। যদি অসুবিধে না থাকে, আমি ওর ব্যথার জায়গায় প্রলেপ দিতে চাই।”

আসিমভের ধীর স্থির গলার মধ্যে একটা প্রত্যয় রয়েছে। সেই বিশ্বাস আর আস্থাকে বিকাশ অস্বীকার করেন না। কিন্তু তাঁর নাগরিক মন এই প্রাকৃতিক উপকরণকে মেনে নিতে পারে না পুরোপুরি। আবার আসিমভকে সরাসরি অপ্রিয় কথা বলতেও ইচ্ছে করে না।

“আচ্ছা বেশ। ওষুধ থাক, আমি রাতে ওর পাশে বসে থাকলে আপত্তি নেই তো?”

আসিমভের কথায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন বিকাশ। রু সারাদিন পাশে বসে থাকায় অসম্ভব খুশি হয়েছে ভানু। ও ভাবতেই পারেনি এক নতুন বন্ধু ওকে এত ভালোবাসতে পারে। সারাদিন ভানুর হাত ধরে বসেছিল রু। আসিমভ থাকলে আরও নিশ্চিন্ত। ওদের তিনজনের মধ্যে এক মায়ার টান রয়েছে। ওরা যেন অনেকদিনের চেনা।

“না না, বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। ভালোই হল, ওরা গল্প শুনতে শুনতে ঘুমোবে।”

পূর্ণিমার পরের দিনেও উপত্যকা ধুয়ে যায় এক অপার্থিব মায়াময় আলোয়। আসিমভ ভানুর কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করে একমনে প্রার্থনা করে। পৃথিবীর জীবজগতের আড়ালে যে অলৌকিক দুনিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ আসিমভের, সেই জগত থেকে সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে নিয়ে আসতে চায় ভানুর জন্য। রু গান করে, মায়ের বানানো গরম স্যুপ আর দুধ এনে খাইয়ে দেয় ভানুকে। নিয়ে আসে ঝাঁঝালো গন্ধের গরম চা। একটু একটু করে চুমুক দিলে গায়ে জোর পাবে, ব্যথা কমবে, জ্বর সারবে।

“ভানুস্কা, তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো। কেউ এমন শুয়ে থাকলে আমার ভারি বিরক্ত লাগে। অনেক জায়গা ঘুরিয়ে দেখাব তোমায়। ছুটে ছুটে আর খেলবে না। দেখেছ, আমি তোমাকে বারণ করেছিলাম, তুমি শুনলে না।”

“রু, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও?”

“আমি, আমি বাবার মতো গাইড হব। সারাদিন ট্যুরিস্টদের নিয়ে ঘুরে বেড়াব, তাদের সব চেনাব, দেখাব, গল্প বলব। তুমি কী হবে ভানুস্কা?”

“আমি ভূ-পর্যটক হব। গ্লোব-ট্রটার। ঘুরব, শুধু ঘুরে বেড়াব। সারা পৃথিবীতে যেখানে যা আছে, শুধু দেখে বেড়াব।”

আসিমভ ওদের দুজনের কথার মধ্যে দোভাষী হয়ে বসে। মনে মনে ভাবে, পর্যটক তো আমিও। তোদের মতোই আমারও যে কেবল দেশ দেখে বেড়ানোর নেশা।

ইরিন বহুদূর থেকে শুনতে পান, কলকল করে কথা বলে যাচ্ছে দুটো ছোট্ট ছেলে। তার অনর্গল কথার স্রোতে পাহাড়িয়া মেঠো সুর। সুরের মায়ায় ভেসে যায় চারদিক।

পরের দিন আসিমভ গিয়ে নিয়ে আসে ইরিনকে। ভানুকে নিয়ে শহরে যাওয়াই ভালো। যদিও আগের থেকে সে অনেকটাই সুস্থ এখন।

ইরিন উত্তেজনায় ছটফট করছেন। বিকাশ জিগ্যেস করেন, “তোমার কাজ কতদূর?”

“আমি সফল বিকাশ। ওখানে আমার ধারণাই সঠিক। ভার্টিব্রেট প্যালেন্টোলজির যে শাখায় আমি এতদিন কাজ করেছি, আমার অভিজ্ঞতা বলছে একটু খুঁজলেই ডাইনোসরের ডিম, হাড় পাওয়া যাবে ওই গোটা অঞ্চল জুড়ে। সমস্ত জিওলজিক্যাল পিরিয়ডের ফসিল পাওয়া যাবে ওখানে। কিন্তু সরকারি স্তর থেকে অনুমতি দরকার, ফাণ্ড চাই, আর ইন্সটিট্যুটের সাহায্য ছাড়া এই কাজটা অসম্ভব। তবে একটা চমৎকার জিও-পার্ক তৈরির সমস্ত সম্ভাবনা রয়েছে ওখানে,” উত্তেজনায় হাঁফাতে থাকেন ইরিন, “ভানু আগে সুস্থ হোক, আমি সব ছবি আর এভিডেন্স দেখাই গাইডকে . . . ।”

আসিমভ ঘোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল কাছেই। হঠাৎ বলে ওঠে, “ওই ঘেরা জায়গায় জন্তুটার পায়ের বিরাট বড় একটা হাড় আছে। আপনি যখন খুঁজে পাবেন, তখন আমার কথা মিলিয়ে নেবেন।”

ইরিন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকায়। পুরোপুরি খুঁড়ে বের করতে মাসখানেক তো লাগবেই। তারপর নিশ্চিত বোঝা যাবে, কংকালের কোন অংশটা চাপা পড়ে রয়েছে ওই জায়গাটুকুতে। আগে থেকেই আসিমভ এইসব বলছে কী করে?

“আসিমভ, তুমি এত নিশ্চিত?”

আসিমভ সামলে নেয় নিজেকে।

সে আর কথা বাড়ায় না। মাটির তলার ওই জন্তুকে আবার ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে সে। তার পায়ে বেকায়দায় চোট লাগলে ভানু এখন কিছুতেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। শহুরে মানুষেরা এইসব কথা বিশ্বাস করবেন না। ওদের না বলাই ভালো। ওদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতের মধ্যে এই অনুভূতি অর্থহীন।

রু সকাল থেকেই মনকেমনের মধ্যে ডুবে আছে। ওর কেমন মনে হচ্ছে, ইরিন আবার আসবে তাদের এই গ্রামে, কিন্তু ভানুর সঙ্গে আর দেখা হবে না তার। ভানুর জন্য সে একটা উপহার নিয়ে আসে। একটা রঙিন টুপি, ফেল্টের তৈরি। তাতে ঈগলের পালক লাগানো। ভানুকে দিয়ে বলে, “মাই ফ্রেণ্ড, ভানুস্কা। মী রুস্কা।”

ভানু ওর হাতে দেয় একটা ছবি আঁকার খাতা। কানে কানে বলে, “এটা শুধু তোমার”।

ভানুর ঘোড়ায় ভানুর সঙ্গে চড়ে আসিমভ।

হাত নাড়ে দুজনেই। চোখে চোখে কথা হয়।

তিনটে ঘোড়া যতক্ষণ না চোখের আড়ালে যাচ্ছে, রু একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। মায়ের ডাকেও সাড়া দেয় না।

দূরে বিন্দুর মতো মিলিয়ে গেলে রু খুলে বের করে ভানুর ছবি আঁকার খাতা। অনেক ছবি। ফুল, পাহাড়, আকাশে চাঁদ . . . সবই প্রায় ল্যাণ্ডস্কেপ। পাতা উল্টোতে উল্টোতে মাঝামাঝি এসে থমকে যায় রু। একটা ঢাল দিয়ে দুহাত তুলে নেমে আসছে একটা ছোট্ট ছেলে। আর তার দিকে হাত বাড়িয়ে রয়েছে আরও একজন। ঢালু বেয়ে যেন গড়িয়ে না পড়ে যায়, এইভাবে দুহাত বাড়িয়ে রয়েছে সে।

তলায় ইংরেজিতে কীসব লেখা। রু ইংরেজি পড়তে পারে না। সে লেখার ওপর আঙুল বুলোয়। বেশ বুঝতে পারে, লেখা রয়েছে, “মাই ফ্রেণ্ড রুস্কা”।

 

সমাপ্ত