এক দম্পতির অনেকদিনের বাসনা ছিল একটি সন্তানের৷ বহুকাল হয়ে যায় কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর মনের ইচ্ছা পূর্ণ হয় না৷ তাদের একটা ছোট্ট বাড়ি ছিল৷ সেই বাড়ির পেছনে একটা জানলা ছিল, যেটা দিয়ে দেখা যেত একটা অপূর্ব ফুল-ফলে-ভরা বাগান৷ কিন্তু এই বাগানের চারপাশে ছিল উঁচু দেওয়ালের পাঁচিল৷ কারোর সাহস ছিল না সেই বাগানে ঢোকার কারণ সেই বাগানটি ছিল এক ডাইনির, যাকে সকলে ভয় পেত৷ একবার গ্রীষ্মকালে সেই বাগান ভরে গেল টাটকা র্যাম্পিয়ান বা র্যাপুঞ্জেল গাছে৷ র্যাম্পিয়ান বা র্যাপুঞ্জেল হল একধরনের শাক জাতীয় গাছ৷ এর শিকড় আবার শালগমের মতো, খেতে খুবই সুস্বাদু৷
এই র্যাপুঞ্জেল গাছ দেখে বৌ-টির খুব লোভ হয়৷ তার র্যাপুঞ্জেল পাতা দিয়ে স্যালাড করে খেতে ইচ্ছে করে৷
সে তার বরকে অনুরোধ করে— ‘যাও না গো ঐ কচি কচি র্যাপুঞ্জেল পাতা তুলে নিয়ে এসো৷ ওটা না পেলে আমার বেঁচে থাকাই বৃথা৷’ সেই শুনে তার বর সন্ধের অন্ধকারে বেরিয়ে পড়ল৷ পাঁচিল টপকে সে কোনোরকমে একগোছা র্যাপুঞ্জেল পাতা নিয়ে আসে তার বৌয়ের কাছে৷
বৌ খুশিতে পাগল হয়ে যায় এবং আরও পাবার আশা করে৷ পরের দিন আবার যায় তার বর৷ কিন্তু এ কী কাণ্ড! লোকটির সামনেই দাঁড়িয়ে সেই ডাইনি৷ হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় তার৷ সে ডাইনিকে বলে, ‘আমার বৌয়ের খুব র্যাপুঞ্জেল পাতা খাওয়ার শখ, তাই আমি এই বাগানে এসেছি’— এই শুনে জাদুকরী খুব চটে যায়! সে বলে, ‘আমাকে ভয় পায় সারা পৃথিবী! আমার বাগানে চুরি করার সাহস কী করে হয় তোমার?’
লোকটি ভয়ের চোটে কাকুতি-মিনতি করতে থাকে৷
খানিকক্ষণ এরকম চলার পর জাদুকরীর রাগ একটু কমে যায় এবং সে এক অদ্ভুত শর্ত রাখে৷
সে বলে, ‘তোমার যত ইচ্ছে র্যাপুঞ্জেল পাতা তুমি নিতে পারো৷ আমি বাধা দেব না৷ কিন্তু জেনে রাখো, তোমার স্ত্রীর কয়েকদিনের মধ্যেই সন্তান হবে৷ সেই সন্তান আমাকে দিয়ে দিতে হবে৷ চিন্তা কোরো না, আমি তাকে মায়ের মতোই ভালোবাসব৷’
লোকটি জাদুকরীর শর্ত মেনে নেয়৷
এর কিছুদিন পরে দম্পতির একটা ফুটফুটে মেয়ে হয়৷ শর্ত অনুযায়ী সেই মেয়েকে তাদের ডাইনির হাতে তুলে দিতে হয়৷ কষ্টে তাদের বুক ফেটে যায়৷ ডাইনি এই মেয়ের নাম রাখে র্যাপুঞ্জেল৷ মেয়ে বড় হতে থাকে৷ সে হয়ে ওঠে অপরূপ সুন্দরী৷ তার মাথায় এক ঢাল সোনালি চুল৷ তার যখন বারো বছর বয়স হল, তখন ডাইনি তাকে এক জঙ্গলের ভিতর উঁচু মিনারে রেখে এল৷ সেই মিনারে নেই কোনো দরজা বা সিঁড়ি৷ আছে শুধুমাত্র একটা ছোট্ট জানলা৷ ডাইনি মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলে নীচ থেকে বলত—
‘র্যাপুঞ্জেল, র্যাপুঞ্জেল, ওগো মিষ্টি ফুল
নামাও তোমার সোনারবরণ চুল!’
এই কথা শোনামাত্র র্যাপুঞ্জেল তার সোনালি চুল খুলে দিত৷ এরকম চুল কেউ কখনো দেখেনি৷ যেন সোনালি রোদ ঝলমলিয়ে উঠত তার বিনুনিতে৷ র্যাপুঞ্জেলের ছয় হাত লম্বা চুলের বিনুনি বেয়ে সেই ডাইনি উঠে যেত৷
একদিন হয়েছে কী, জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে চলে এল এক রাজপুত্র৷ তার কানে ভেসে এল সুন্দর এক গানের সুর৷ সে সেই সুরের সূত্র ধরে এগিয়ে গেল সেই মিনারের কাছে, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না৷ সে মিনারের চারপাশে ঘুরেও কোনো দরজা খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ল, কিন্তু তার কানে বাজতে লাগল সেই সুর৷
পরের দিন আবার এল রাজপুত্র৷ সে বুঝতে পারল যে ঐ মিনারে কেউ একটা রয়েছে, কিন্তু মিনারে ওঠার কোনো ব্যবস্থা নেই৷ সে তখন একটা গাছের আড়ালে চুপ করে বসে রইল৷ এমন সময় এল ডাইনি৷ রাজপুত্র দেখল, কী করে ডাইনি একটা বিনুনি বেয়ে ওপরে উঠে গেল৷ সে খুব অবাক হল৷
পরদিন বিকেলবেলায় রাজপুত্র এল মিনারের নীচে আর ঠিক জাদুকরীর মতো করে বলল—
‘র্যাপুঞ্জেল, র্যাপুঞ্জেল, ওগো মিষ্টি ফুল
নামাও তোমার সোনারবরণ চুল!’
এই কথা বলামাত্র র্যাপুঞ্জেল তার চুল ঝুলিয়ে দিল৷ সেই চুল বেয়ে উঠে গেল রাজপুত্র৷ র্যাপুঞ্জেল তো রাজপুত্রকে দেখে ভয় পেয়ে গেল৷ রাজপুত্র তাকে বলল, ‘কোনো ভয় নেই৷ তোমার গান শুনে আমি মুগ্বূ হয়েছি৷ তাই তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি৷’
র্যাপুঞ্জেল খুব খুশি হল রাজপুত্রর কথা শুনে৷ তারা কত গল্প করল৷
রাজপুত্র রোজ আসতে লাগল৷ একদিন রাজপুত্র তাকে বলল, ‘তুমি কি আমায় বিয়ে করবে?’
র্যাপুঞ্জেল বলে, ‘করব৷ কিন্তু তার আগে তো আমাকে এখান থেকে বেরোতে হবে! তুমি এক কাজ করো, তুমি যখন এখানে আসবে, তখন রোজ খানিকটা করে সিল্কের দড়ি নিয়ে এসো৷ ঐ দড়ি জুড়ে আমি মই তৈরি করব৷ তারপর সেটা তৈরি হয়ে গেলে তুমি একদিন ঘোড়া নিয়ে এসো, আমি তোমার সঙ্গে ঘোড়ায় করে পালিয়ে যাব৷’
এই কথামতো রাজপুত্র রোজ সিল্কের দড়ি আনতে লাগল৷ অল্প-অল্প করে তৈরি হতে থাকে মিনার থেকে নামার সিঁড়ি৷
কিন্তু এর মধ্যেই একদিন ঘটল মহাবিপদ৷
র্যাপুঞ্জেল তার ডাইনি মা-কে বলল, ‘মা, চুল বেয়ে উঠতে তোমার এত সময় লাগে, অথচ দ্যাখো, রাজপুত্র কেমন ঝটপট উঠে পড়ে৷’
র্যাপুঞ্জেলের কথা শুনে ডাইনি তো রেগে অস্থির৷ সে বলল, ‘আমি তোকে সবার থেকে আড়াল করে রেখেছি আর তুই কিনা পালাবার কথা ভাবছিস! তুই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিস’— এই বলে সেই ডাইনি র্যাপুঞ্জেলের বিনুনি কাঁচি দিয়ে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে কেটে ফেলল৷ কান্নায় ভেঙে পড়ল র্যাপুঞ্জেল৷
ডাইনি রেগেমেগে তাকে পাঠিয়ে দিল একটা মরুভূমিতে৷
পরদিন বিকেলে রোজকার মতোই এল রাজপুত্র৷ সে এসে ‘র্যাপুঞ্জেল, র্যাপুঞ্জেল’— বলে ডাক দিতেই মিনারের ওপর থেকে নেমে এল সোনারবরণ বিনুনি৷ সেই বেয়ে রাজপুত্র ওপরে উঠল৷ কিন্তু, একী! র্যাপুঞ্জেল কোথায়? তার জায়গায় র্যাপুঞ্জেলের কাটা-বিনুনি হাতে দাঁড়িয়ে আছে সেই ডাইনি৷ তার চোখ জ্বলজ্বল করছে৷ সে বলল, ‘তুমি এসেছ যার জন্যে, সেই পাখি তো উড়ে গেছে৷ তুমি আর র্যাপুঞ্জেলকে পাবে না’— এই বলে সেই ডাইনি রাজপুত্রকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল ওপর থেকে৷ নীচে পড়ে ছেলেটির চোখে মুখে কাঁটা ফুটে গেল৷ সে অন্ধ হয়ে গেল৷
অন্ধ হয়ে রাজপুত্র বনে বনে ঘুরে বেড়াতে লাগল৷ একদিন ঘুরতে ঘুরতে সেই রাজপুত্র সেই মরুভূমিতে গিয়ে উপস্থিত হল৷ সেইখানে শুনতে পেল কে যেন গান গাইছে! কে গাইছে? এ তো চেনা গলা৷ সুর লক্ষ করে অন্ধ রাজপুত্র এগিয়ে গেল এবং সেইখানে র্যাপুঞ্জেল দেখতে পেল রাজপুত্রকে৷ সে রাজপুত্রকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল৷ কী আশ্চর্য, যেই র্যাপুঞ্জলের দু-ফোঁটা চোখের জল গিয়ে পড়ল রাজপুত্রর চোখে, অমনি রাজপুত্র আবার দৃষ্টি ফিরে পেল৷
রাজপুত্র আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল৷
রাজপুত্র র্যাপুঞ্জেলকে নিয়ে ফিরে গেল তার রাজ্যে৷ সারা জীবন খুব আনন্দে কাটল তাদের৷
জার্মান দেশের রূপকথা মূল লেখা/জ্যাকব ও উইলহেল্ম গ্রিম, ইংরিজি অনুবাদ/ মে সেলার