এবার আমরা লিওনার্দোর আর একটি বিশ্ববিখ্যাত সৃষ্টির কথা আলোচনা করব, এটি একটি মুরাল বা দেয়াল চিত্র— ‘দ্য লাস্ট সাপার’ বা ‘শেষ নৈশভোজ’। মিলান শহরের সান্টা মারিয়া ডেলে গ্রাৎসি কনভেন্টের বিস্তৃত ডাইনিং হলের একদিকের দেয়ালে ছবিটি আছে। লম্বায় প্রায় নয় ফুট, আর চওড়ায় প্রায় তিরিশ ফুট (৩৫০ ইঞ্চি) এক দেয়াল থেকে আর এক দেয়াল অবধি, নিঃসন্দেহে বিরাট মাপের ছবি। এর কাজ শুরু হয় ১৪৯৫ সালে, আর শেষ হয় ১৪৯৮ সালে।
ছবিটি নির্মাণকালেই এত সাড়া ফেলে যে মিলানের শিল্পীরা তখনই এর কপি এঁকে রাখেন, যা পরবর্তীকালে খুব কাজে লেগেছে। লিওনার্দোর মূল ছবিটি দুর্ভাগ্যবশত তাঁর জীবৎকালেই খারাপ হতে শুরু করে। তার কারণ লিওনার্দো বড় বেশি পরীক্ষামূলক পদ্ধতি নিয়ে ফেলেছিলেন। সাধারণত দেয়ালচিত্রের ক্ষেত্রে ফ্রেসকো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে কাঁচা প্লাস্টারের উপর জলে গোলা রং দিয়ে দ্রুত ছবি আঁকা হয়। এর ফলে ছবি খুব উজ্জ্বল হয় এবং কয়েকশ বছর দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু এই পদ্ধতিতে রঙের বিভিন্ন শেড আনা যায় না, বা এক রং থেকে অন্য রঙে ধীরে ধীরে উত্তরণ হয় না। লিওনার্দোর পছন্দ ছিল রঙের ঘন হাল্কা খেলা, আলো আঁধারি সৃষ্টি করা— যা নাহলে অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় না। তাই তিনি তেল রং ব্যবহার করেন। এর ফলে প্রথমে ছবিটি সুন্দর হলেও অচিরেই তাতে ক্ষয় শুরু হয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যের এইখানেই শেষ নয়। ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিমান থেকে ফেলা বোমার আঘাতে সান্টা মারিয়া কনভেন্ট বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সৌভাগ্যক্রমে যে ঘরটিতে লাস্ট সাপার আছে, সেটি বেঁচে যায়। সম্ভবত তার আগে বা পরে কোনও সময় দেয়াল ফুটো করে একটি দরজা বানানো হয়েছিল, যার ফলে ছবিটির একটি অংশ (যিশুখ্রিষ্টের পা যেখানে ছিল) চিরতরে হারিয়ে গেছে।
যাই হোক, দুটি কারণে ছবিটি অবিস্মরণীয়। প্রথমটি কম্পোজিশন, দ্বিতীয়টি গল্প বলার নাটকীয় ভঙ্গি। যে কোনও শিক্ষানবিশ চিত্রশিল্পীর কাছেই পার্সপেক্টিভ স্টাডি করার জন্যে এর চেয়ে ভাল ছবি হয় না।
পার্সপেক্টিভ বিষয়টি কী? ধরা যাক আমরা একটা লম্বা হলঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। এখন আমাদের দৃষ্টিতে মেঝের দুই প্রান্ত থেকে দুটি সরলরেখা কাছ থেকে দূরে চলে যাবে। এই দুটি লাইন আমরা জানি সমান্তরাল, অর্থাৎ তারা কখনও মিলবে না। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে দূরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুটি লাইনের মধ্যে দূরত্ব ক্রমাগত কমতে থাকবে। একই ভাবে ছাদের দুটি লাইনও দূরে গিয়ে মিলে যাওয়ার চেষ্টা করবে, যদিও বাস্তবে লাইন দুটি সমান্তরাল। আমাদের মস্তিষ্ক কিন্তু এতে বিভ্রান্ত হয় না, সে বোঝে বাস্তবে আমরা একটি আয়তক্ষেত্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। আসলে কাছের ও দূরের জিনিসকে বোঝার জন্য আমাদের মস্তিষ্কের এটা একটা কৌশল। শিল্পীকে দৃষ্টির এই ‘বিভ্রমকে’ যথাযথ আঁকতে হবে, যাতে দর্শক বুঝবে আমরা সমতলে দাঁড়িয়ে আছি, না পাহাড়ের উপর; যাতে ছবিতে আঁকা বিভিন্ন বস্তু বা মানুষের দূরত্ব সঠিক বোঝা যায়। এটাই হচ্ছে পার্সপেক্টিভ বা প্রেক্ষাপটের বিষয়। আমরা আর একটু আগ বাড়িয়ে ভাবতে পারি, আমাদের উদাহরণে হলঘরের অন্য প্রান্তের দেয়ালটি যদি না থাকত, তাহলে মেঝের (এবং ছাদেরও) লাইন দুটি একটা সময় এক অপরকে স্পর্শ করত। এই বিন্দুটিকে বলা হয় ভ্যানিশিং পয়েন্ট বা দূরত্ব বিলীন হওয়ার বিন্দু। আমাদের মস্তিষ্ক আমাদের অজান্তে যে কোনও পরিস্থিতিতেই— সে ঘরের মধ্যে হোক বা রাস্তায় হোক বা পাহাড়ে অথবা সমুদ্রে হোক— এই ভ্যানিশিং পয়েন্ট খোঁজে; এইখানেই স্বভাবগত ভাবে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়।
চিত্র: ভ্যানিশিং পয়েন্ট; চিত্র সৌজন্য: উইকিপিডিয়া, www.vertice.ca
লাস্ট সাপার ছবিতে ভ্যানিশিং পয়েন্ট হচ্ছে যিশুখ্রিষ্টের মুখমণ্ডল। ছাদের সিলিং এবং দেয়ালে আঁকা দরজার যে ওপরের অংশের লাইনগুলি আছে, তারা গিয়ে যেখানে মেশে, ঠিক সেইখানে যিশুখ্রিষ্টের মুখ আঁকা হয়েছে, যাতে কিনা দর্শকদের নজর প্রথমেই গিয়ে পড়ে যিশুখ্রিষ্টের উপর। এটাও দেখবার যে যিশুখ্রিষ্টকে একদম মধ্যিখানে বসানো হয়েছে এবং তাঁর দুপাশে ছয়জন করে বারোজন শিষ্যকে (apostle) বসানো হয়ছে এবং দু’দিকেই ছয়জনকে আবার তিন তিন করে দুই ভাগে সমান ভাগ করা হয়ছে। এই সাযুজ্যের ফলে ছবিটির একটি চমৎকার ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে। বোঝার সুবিধার জন্যে আমি লাস্ট সাপারের একটি হুবহু নকল ছবিও দিয়েছি। এটা জিয়ামপিয়েত্রিনোর আঁকা, ১৫২০ সালে। এই ছবিটির ভিত্তিতে লিওনার্দোর ছবিটির সংস্কার করা হয়েছে বেশ কয়েকবার।
চিত্র: ‘শেষ নৈশভোজ’-এর নকল, শিল্পী জিয়ামপিয়েত্রিনো, ১৫২০, ক্যানভাসে তেল রঙে আঁকা, রয়্যাল অ্যাকাডেমি অফ আর্টস, লন্ডন; চিত্র সৌজন্য: উইকিপিডিয়া
দ্বিতীয় অভিনবত্ব লাস্ট সাপারের গল্প বলার ভঙ্গিতে। বাইবেলের গল্প অনুযায়ী যিশুখ্রিষ্ট তাঁর শেষ নৈশভোজে বারো জন শিষ্যের কাছে ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে তাঁদের মধ্যে একজন বেইমানি করবে এবং সে যিশুর সঙ্গে একই সময়ে (নিজের অজান্তে) পাউরুটিতে হাত রাখবে। লিওনার্দো বারোজন শিষ্যের প্রতিক্রিয়া নাটকীয় ভাবে ধরেছেন। এক একজনের হাতের ভঙ্গি ও মুখের অভিব্যক্তি দর্শকের মনে নানা কৌতূহল জাগায়। দুর্ভাগ্যবশত মূল ছবিটির গুণগত ক্ষয়ের জন্য এই মূল্যবান ডিটেলগুলি আর সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। কিন্তু তাঁর জীবনকালে অন্য শিল্পীদের আঁকা নকল (যেমন উপরের জিয়ামপিয়েত্রিনোর ছবিটি) থেকে আমরা তাঁর গল্প বলার ভঙ্গিটি ভাল করে বুঝতে পারি।
বাইবেলের গল্প অনুযায়ী জুডাস বেইমানি করেন এবং যিশুখ্রিষ্টের মৃত্যু ডেকে আনেন। লিওনার্দো জুডাসকে বাঁদিক থেকে চতুর্থ স্থানে বসিয়েছেন (যিশুর ডানদিকে তৃতীয় ফিগার)। জুডাসই একমাত্র যার কনুই টেবিলের ওপর ভর দেওয়া, যার বাঁ-হাতটি যিশুর সঙ্গে সঙ্গেই পাউরুটির কাছে এগিয়ে এসেছে। জুডাসের সামনে একটা লবণদানি উলটে পড়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন লিওনার্দো এর মধ্যে দিয়ে ‘নমকহারাম’-এর ইঙ্গিত দিয়েছেন। নমকহারাম বা ‘betray the salt’ কথাটির উৎপত্তি সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যে। ইতালিয় লোকাচারে নুন উলটে ফেলা খুবই অশুভ ব্যাপার বলে ধরা হয়।
জুডাস ছাড়াও আরও একটি ফিগার নিয়ে নানা রহস্য এবং কৌতূহল আছে। যিশুখ্রিষ্টের ডানদিকে প্রথম ফিগারটি হল সর্বকনিষ্ঠ শিষ্য অ্যাপোস্টল জনের। অনেকেই মনে করেন লিওনার্দো সুকৌশলে পুরুষ নয়, একটি নারী মূর্তি এঁকেছেন, এবং সম্ভবত এটি মেরি ম্যাগদালেনের। কথিত আছে ম্যাগদালেন যিশুর অবিবাহিত স্ত্রী ও তাঁর সন্তানের মা। বিষয়টি ক্যাথলিকরা মানেন না, এ-নিয়ে বিতর্কও অনেক। এই বিষয়টি নিয়ে লেখা ঔপন্যাসিক ড্যান ব্রাউনের ‘দা ভিঞ্চি কোড’ উপন্যাসটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে। এই সব কারণে লাস্ট সাপার নানা জল্পনা কল্পনার জনক এবং এক রহস্যময় আকর্ষণ।