Categories
লোকশ্রুতির ঘাট |

সতী জয়মতী

1100 |
Share
| ১৯ অক্টোবর, ২০২০
নীতীন্দ্র রায়

১৮৯৬–১৯৬২। ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের স্বনামধন্য শিক্ষক।

(বাঁদিক থেকে) প্রথম চিত্র: জয়মতীর ওপর অত্যাচার করা হচ্ছে; চিত্র সৌজন্য: sandiptalukdar.blogspot.com, শিল্পী: অজ্ঞাত; দ্বিতীয় চিত্র: শিবসাগরে জয়দৌল মন্দির; সৌজন্য: Online Sivasagar

ষোলশো শতাব্দীতে আসামকে আহোম রাজ্য বলা হত। এই শতাব্দীর শেষের দিকে দেশে একেবারে শান্তি-শৃঙ্খলা ছিল না। রাজারা দুর্বল ছিলেন, মন্ত্রীরা ইচ্ছেমতো রাজাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন। ন’বছরের মধ্যে ছ’জন রাজা এই মন্ত্রীদের চক্রান্তে নিহত হন। ষষ্ঠ রাজার নাম ছিল লরা।

লরা রাজা হয়ে দেখল যে কবে তার প্রাণ চলে যাবে তার ঠিক নেই। আহোম রাজ্যে নিয়ম ছিল যে কারও কোনও অঙ্গহানি থাকলে সে রাজা হতে পারবে না। লরা এক বুদ্ধি বের করল— রাজবংশে যেখানে যত যুবক ছিল সবাইকে ধরে এনে তাদের অঙ্গচ্ছেদ করতে লাগল। দেহ নিখুঁত না থাকলে তো আর রাজা হতে পারবে না!

রাজবংশের একটি শাখার নাম ছিল তুংখুং। এই বংশে গদাপাণি নাম একজন বুদ্ধিমান বীরপুরুষ ছিলেন। ওকে নিয়েই লরার ভয় ছিল বেশি। কিন্তু গদাপাণিকে সবাই খুব ভালবাসত, বহু যুবক তাঁর পক্ষে ছিল। তাঁর অঙ্গচ্ছেদ করা অত সহজ নয় দেখে লরা তাঁকে হত্যা করবে বলে ঠিক করল।

গদাপাণির পত্নী জয়মতী যখন জানতে পারলেন যে লরা তাঁর স্বামীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করছে, তখন তিনি স্বামীর প্রাণরক্ষা করবার জন্য উতলা হয়ে উঠলেন। বুদ্ধিমতী জয়মতী স্বামীকে নাগা পর্বতে আশ্রয় নেওয়ার উপদেশ দিলেন। গদাপাণি তার স্ত্রী-পুত্রকে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে পালাতেই চাননি। কিন্তু জয়মতী বারবার অনুরোধ করায় তিনি পালাতে বাধ্য হন। লরা যখন জানতে পারল যে গদাপাণি ফেরার হয়েছেন, সে তখন জয়মতীকে বন্দি করল। তারপর জয়মতীর ওপর খুব অত্যাচার করতে লাগল। বেতের আঘাতে জয়মতীর দেহ ক্ষতবিক্ষত হল। নানা রকমের শাস্তি, কারাবাস, অনশন ইত্যাদি কোনও কিছুর দ্বারাই লরা জয়মতীর কাছ থেকে তাঁর স্বামীর খবর জানতে পারল না। শেষে জয়মতীকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হল। জল্লাদের খাঁড়ার সামনে দাঁড়িয়েও জয়মতী তাঁর স্বামীর ব্যাপারে একটা কথাও বলল না। সে মারা গেল।

জয়মতীর ওপর এই নিদারুণ অত্যাচারে দেশে বিদ্রোহের সৃষ্টি হল। মানুষের তো সহ্যের একটা সীমা আছে! সতীর প্রতি এই অকথ্য অত্যাচারে মেষপালের মতো অসহায় প্রজারাও ক্ষেপে উঠল। বিদ্রোহীরা নাগা পর্বত থেকে গদাপাণিকে নিয়ে এল। প্রজারা লরাকে তাড়িয়ে দিয়ে গদাপাণিকে সিংহাসনে বসাল।

গদাপাণি রাজা হয়ে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলেন। গদাপাণির মৃত্যুর পর জয়মতীর পুত্র রুদ্রপাণি রাজা হলেন। রুদ্রপাণি মায়ের স্মৃতি রক্ষার জন্য শিবসাগরে জয়দৌল নামের একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন এবং জয়মতীর বধ্যভূমিতে জয়সাগর নামে একটি দীঘি কাটালেন। আজও এই দুটো স্থান জয়মতীর স্মৃতি বহন করছে।

ঋণ: পুরাকথিকা। চলিত করেছেন ঝিলমিল বসু।