Categories
ভাষাপুকুর |

সত্যজিতের লেখায় দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সন্ধান

418 |
Share
| ৩০ এপ্রিল, ২০২৩
সর্বজিৎ মিত্র

লেখক ইতিহাস গবেষক, SOAS University of London

চিত্রঋণ: archive.org

‘আমি হলাম যাকে বলে বইয়ের পোকা। ব্যাঙ্কে কাজ করে প্রতি মাসে যা রোজগার হয়, তার অন্তত অর্ধেক টাকা পুরনো বই কেনার পিছনে খরচ হয়। ভ্রমণকাহিনী, শিকারের গল্প, ইতিহাস, আত্মজীবনী, ডায়রি কতরকম বই না গত পাঁচ বছরে জমে উঠেছে আমার। পোকায় কাটা পাতা, বার্ধক্যে ঝুরঝুরে হয়ে যাওয়া পাতা, ড্যাম্পে বিবর্ণ হওয়া পাতা এসবই আমার কাছে অতি পরিচিত এবং অতি প্রিয় জিনিস। আর পুরনো বইয়ের গন্ধের জুড়ি নেই। অগুরু, কস্তুরী, গোলাপ, হাসনুহানা মায় ফরাসি সেরা পারফিউমের সুবাস এই দুটো গন্ধের কাছে হার মেনে যায়।’

এটা সহজেই অনুমেয় যে ওপরের অংশটি সত্যজিৎ রায়ের নিজের বয়ানে লেখা নয়। সত্যজিৎ রায় ব্যাঙ্কে কাজ করেননি কোনওদিন, কাজেই সেই রোজগার বাঁচিয়ে পুরনো বই সন্ধানের প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু তাও কোথাও যেন মনে হয়, সত্যজিতেরই লেখা ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’ গল্পের কথক রঞ্জন ব্যানার্জীর মাধ্যমে এখানে নিজেরই পুরনো, দুষ্প্রাপ্য বইয়ের প্রতি ঐকান্তিক টান যেন প্রকাশ পেয়েছে। বিশেষ করে পুরনো বইয়ের পাতার রকমফের বা গন্ধের বিশেষত্বের বর্ণনা যেন এক ব্যক্তিগত ভাললাগার প্রতিই নির্দেশ করে।

একদিক দিয়ে অবশ্য বইয়ের প্রতি এই টান বা আকর্ষণ রায় পরিবারের এক সদস্যর পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। তাও একথা বলাই যায় যে সত্যজিতের মতো একজন বহুল আলোচিত ব্যক্তিত্বের এই একটা দিক, তাঁর বইয়ের পড়া বা সংগ্রহের দিকটা নিয়ে হয়তো আরও চর্চার অবকাশ রয়ে গেছে। এই নিয়ে চর্চার একটা প্রধান অন্তরায় অবশ্যই সত্যজিতের নিজের বয়ানে এই বিষয়ে যথেষ্ট উপাদান না থাকা। যে কারণেই আমাদের লেখার সূচনায় নির্ভর করতে হয়েছে সত্যজিতের সৃষ্ট এক চরিত্রের ওপরে।

সত্যজিতের বিভিন্ন সময়ে নেওয়া সাক্ষাৎকারেও সেই ভাবে সত্যজিতের নিজস্ব বইপড়ার বা বইয়ের সংগ্রহের বিষয়টা সেই অর্থে উঠে আসেনি। যেটুকু এসেছে তা বলা যায় খুবই সামান্য। সত্যজিৎ নিজেও এই ধরনের সাক্ষাৎকারে খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের কাজের বিষয়ে কথা বলতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছেন। যখন ব্যক্তিগত আগ্রহের বিষয়টা উঠে এসেছে, তখন উনি বেশি উৎসাহ দেখিয়েছেন সঙ্গীত নিয়ে কথা বলতে, বা নিজের রেকর্ড সংগ্রহের কথা তুলে ধরতে। এতদসত্ত্বেও একথা বলাই যায় যে সত্যজিতের পুরনো বই সংগ্রহের কিছু কিছু চিত্র বিভিন্ন লেখায় বা সাক্ষাৎকারেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।

সত্যজিৎ নিজেই একাধিক জায়গায় জানিয়েছেন পথের পাঁচালির শুটিং যখন অর্থাভাবে বার বার আটকে যাচ্ছে, তখন তিনি বাধ্য হয়েছেন নিজের রেকর্ড সংগ্রহের সঙ্গে আর্টের বইও বিক্রি করে দিতে। অরুণ বাগচীকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন, ম্যাগাজিন সংগ্রহের ভীষণ বাতিক আছে তাঁর। বিশেষ করে পুরনো শিশুসাহিত্য পত্রিকার প্রতি একটা আগ্রহের কথা তিনি উল্লেখ করেছিলেন। মৌচাক, রামধনু প্রভৃতি পুরনো পত্রিকার একটা সংগ্রহ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। সত্যজিৎ এই ধরনের পত্রিকা সংগ্রহের দরকার অনুভব করেছিলেন কারণ তিনি নিজে একটি শিশুসাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এই ধরনের পত্রিকা ফিরে দেখা দরকার, শুধুমাত্র একটা সুস্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলতেই নয়, খামতিগুলোও বুঝতে, যাতে সময়ের সঙ্গে তিনি তাঁর নিজের সম্পাদিত পত্রিকাকে আরও খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। এই প্রসঙ্গে সত্যজিতের নিজেরই লেখা ‘অক্ষয়বাবুর শিক্ষা গল্পের একটা অংশ উল্লেখযোগ্য। গল্পে উল্লিখিত ছোটদের পত্রিকা ফুলঝুরির সম্পাদক সুনির্মলকে এক জায়গায় উৎসাহী লেখক অক্ষয়বাবুকে বলতে দেখা যায়,
‘আপনি যে আজকাল ছেলেমেয়েদের মন জানেন, তার কোনও পরিচয় আপনার গল্পে নেই। আমার কাছে সেকালের বাঁধানো সন্দেশ-মৌচাক আছে; তাতে যেরকম গল্প বেরত, আপনার গল্প সেই ধাঁচের। আজকের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি বুদ্ধি রাখে, অনেক বেশি জানে, অনেক বেশি স্মার্ট।’

পুরনো, দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সন্ধান দরকারি হয়ে পড়েছিল পিরিয়ড ফিল্মের গবেষণার জন্যেও। রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তাঁর ‘জোড়াগির্জার নির্মলকুমার’ লেখায় জানাচ্ছেন, সত্যজিৎ অনেক সময়ে শরণাপন্ন হতেন প্রখ্যাত পুরনো বইয়ের সংগ্রাহক নির্মলকুমারের কাছে পিরিয়ড ফিল্মের প্রয়োজনীয় রেফারেন্স খুঁজতে গিয়ে। শতরঞ্জ কে খিলাড়ির স্ক্রিপ্ট লেখার সময়ে নির্মলকুমারের সাহায্যের কথা নির্মলকুমারের পুত্র অলোককুমারও উল্লেখ করেছেন তাঁর বাবা সম্বন্ধে একটি লেখায়। শুধু ছবি নয়, লেখালেখির কাজেও অনেক সময়ে পুরনো বই সংগ্রহ করা দরকার হয়ে পড়ত। রাধাপ্রসাদ গুপ্তই উল্লেখ করেছিলেন গোরস্থানে সাবধান’ লেখার সময় সত্যজিতের বিশেষ সহায় হয়ে উঠেছিল ১৮৫১ সালে হোমস অ্যান্ড কোম্পানী প্রকাশিত দুষ্প্রাপ্য ‘বেঙ্গল অবিচুয়ারি’ গ্রন্থটি। সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রি ও বাংলায় অবস্থিত অন্যান্য সমাধিক্ষেত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ছিল বইটিতে।

অনুমান করা যায় কলকাতার দুষ্প্রাপ্য বইয়ের বিভিন্ন আস্তানায়, মূলত কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে সত্যজিতের নিশ্চয়ই যাওয়া আসা ছিল। সত্যজিতের বই সংগ্রহের অভিজ্ঞতা ও রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, নির্মলকুমারদের মতো বই সংগ্রাহকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কাজে আসে তাঁর বিভিন্ন লেখাতে এবং অবশ্যই সিধুজ্যাঠার চরিত্রচিত্রণে। আমরা লেখার শুরুই করেছি, ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’ দিয়ে। যদিও ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’র প্রধান উপজীব্য কোনও ছাপা বই নয়, একটা হাতে লেখা ডায়েরি। গল্পের কথক রঞ্জন ব্যানার্জী অবশ্য ডায়েরিটির খোঁজ পান এক পুরনো বই বিক্রেতার কাছেই। ‘ব্রাউন সাহেবের বাড়ি’-কে সরিয়ে রাখলেও আমরা দেখি দুষ্প্রাপ্য বই, পত্রিকা বা বইয়ের সংগ্রহ বেশ কিছু গল্পের প্লটের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ উল্লিখিত বই বা লেখাই কাল্পনিক। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই মনে আসে ফেলুদার ‘বাক্স রহস্য’ উপন্যাসটি। ‘বাক্স-রহস্য’তে মূল ক্রাইম অর্থাৎ বাক্স বদল ইচ্ছাকৃতভাবে ঘটানোই হয়, একটি মূল্যবান পাণ্ডুলিপিকে আত্মসাৎ করার উদ্দেশ্যে। গল্পের ভিলেন নরেশ পাকড়াশিও কোনও সাধারণ চোর বা খুনি নন, তিনি একজন গ্রন্থ সংগ্রাহক। নরেশ পাকড়াশির মতো ভ্রমণকাহিনির সংগ্রহ বিরল। ফেলুদা নিজেও বিস্ময় প্রকাশ করে নরেশ পাকড়াশির ভ্রমণকাহিনির সংগ্রহ দেখে। ‘বাক্স রহস্য’তে পাকড়াশিকে মরিয়া হয়ে উঠতে দেখা যায় বিংশ শতকের গোড়ায় রচিত এক বাঙালির তিব্বত ভ্রমণকাহিনির পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করার জন্যে।

তিব্বত- প্রসঙ্গ সত্যজিতের লেখায় বেশ কয়েকবার ঘুরে ফিরে এসেছে। ফেলুদারই ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ উপন্যাসের ডক্টর বৈদ্য নামক চরিত্রটির মাধ্যমে তিব্বতকে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। পরবর্তীকালে রচিত ‘একশৃঙ্গ অভিযান’ শঙ্কুকাহিনির মূল ঘটনাকেন্দ্রই তিব্বত। অতএব অনুমান করা যায় সত্যজিৎ নিজেও তিব্বত অভিযান, তিব্বতের ইতিহাস নিয়ে কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন। বিংশ শতকের গোড়ায় একজন বাঙালির পক্ষে তিব্বত-ভ্রমণ কতটা দুষ্কর তিনি নিশ্চয়ই জানতেন। অতএব বুঝতে অসুবিধে হয় না। যে তিব্বতের ভ্রমণকাহিনি, বিশেষত এক বঙ্গসন্তানের কলমে, সংগ্রাহকদের কাছে কেন এক বিশেষ মূল্য বহন করবে।

এখানে একটা সম্ভাবনার কথা এসে যায়।
সত্যজিতের সৃষ্ট শম্ভুচরণ বোস চরিত্রটির বা বলা ভাল এক বাঙালির রচিত ইংরেজি ভাষায় তিব্বতের ভ্রমণকাহিনির অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন হয়তো এক বাস্তব চরিত্রের রচিত এক ভ্রমণ বিবরণ থেকে।
শম্ভুচরণ বোসের প্রায় চার দশক আগেই শরৎচন্দ্র দাশ নামে দার্জিলিং-এর এক বাঙালি স্কুল শিক্ষক সরকারি এক মিশনের অংশ হিসেবে দু’বার তিব্বত সফর করেন। শরৎচন্দ্র দাশের জীবনস্রোত যদিও শম্ভুচরণ বোসের থেকে অন্য খাতেই বয়েছিল এবং বলাই যায় তার গতিমুখ ছিল আরও বেশি-মাত্রায় রোমাঞ্চকর।
তিব্বত সেই সময়ে ছিল বহির্জগতের কাছে অগম্য।
শরৎচন্দ্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রায় গুপ্তচরবৃত্তি করেই তৎকালীন ইংরেজ সরকারের হয়ে তিব্বতের বিভিন্ন জায়গার সার্ভে করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

শরৎচন্দ্রের সার্ভের কাজ পরবর্তী সময়ে ইংরেজ সরকারের তিব্বত অভিযানে খুবই কার্যকরী হয়ে ওঠে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ঔপনিবেশিক সরকারের কর্মচারী শরৎচন্দ্রের এই অভিযানের নৈতিক দিক দিয়ে অবশ্যই প্রশ্ন উঠতে পারে। তবুও বলা যায় তিব্বতকে বহির্বিশ্বের কাছে পরিচিত করতে শরৎচন্দ্র দাশের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। শরৎচন্দ্র তিব্বত থেকে বহু মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য পুঁথি সংগ্রহ করে নিয়ে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রথম তিব্বতি ও ইংরেজি ভাষার অভিধানের অন্যতম কারিগরও ছিলেন তিনি। কাজেই এই শরৎচন্দ্র দাশের ছায়া অবলম্বনে শম্ভুচরণের চরিত্রটি আধারিত এই দাবী করা অমূলকই হবে। তবে একটি ব্যাপারে শম্ভুচরণ বোসের সঙ্গে শরৎচন্দ্র দাশের মিল সুস্পষ্ট। শরৎচন্দ্র দাশও প্রথমবার দেশে ফেরার পরে তিব্বতের ভ্রমণ কাহিনি নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ‘জার্নি টু লাসা অ্যান্ড টিবেট’ বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় বেঙ্গল গভর্নমেন্ট প্রেস থেকে ১৮৮১ সালে। বর্তমানে ইন্টারনেটের কল্যাণে সহজলভ্য হলেও বহুবছর বইটি ছিল দুষ্প্রাপ্য। তার একটি কারণ অবশ্য, ইংরেজ সরকার বইটির বহুল প্রচার চাননি। শরৎচন্দ্রের সংগৃহীত বিভিন্ন তথ্য জনসমক্ষে আসুক, সেটা সরকার বাহাদুরের একেবারেই কাম্য ছিল না। সত্যজিতের পক্ষে এই দুষ্প্রাপ্য বইটি সেই সময়ে দেখা সম্ভব হয়েছিল কিনা জোর দিয়ে বলা না গেলেও একথা বলাই যায় যে এই আকর্ষক বাঙালি চরিত্রটির পরিচয় নিশ্চয়ই তিব্বত নিয়ে বই ঘাঁটাঘাটির সময়ে পেয়ে থাকবেন।

আমাদের স্বল্প পরিসরে এখানে ইতি টানতে হলেও, উল্লেখ করাই যায় যে ‘বাক্স-রহস্যে’র মতো ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে না থাকলেও ‘গোরস্থানে সাবধান’ বা ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’র মতো ফেলুদা কাহিনিতেও দুষ্প্রাপ্য বই বা পত্রিকা গল্পের প্লটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফেলুদা গল্পের বাইরেও ‘ধাপ্পা’ ছোটগল্পটিতে দেখা যায় যে একটি দুষ্প্রাপ্য বই দুই বন্ধুর মধ্যে সময় ও সামাজিক অবস্থানের দূরত্ব কিছুটা হলেও দূর করতে পেরেছে।