যে সকল মনীষীরা ছোটবেলা থেকে আমাদের বিভিন্নরকম বিষয় নিয়ে ভারতে শিখিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সত্যজিৎ রায়। Parapsychology নিয়ে উৎসাহ হোক বা মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার খিদে, ছোটদের মনে জাগতিক এবং মহাজাগতিক বিষয়ে কৌতূহল জাগিয়ে তুলেছেন তিনি খুব সহজেই। যিনি একাধারে পরিচালক, লেখক, চিত্রশিল্পী, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, সুরকার— তাঁর মনের ব্যাপ্তি যে কতখানি, তা দেখার জন্য তাঁর হাতের লেখা নিয়ে একটু তো ‘কাল্টিভেট’ করতেই হচ্ছে। একটা কথা বলাই বাহুল্য যে, যে মানুষের মনের ব্যাপ্তি এই রকম তাঁর লেখা সম্পূর্ণভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে একটা উপন্যাসের সমান হয়ে যাবে। তাই আমরা আজকে তিনটে বিষয় নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব। প্রথম বিষয়— সত্যজিৎ রায়ের সৃজনশীলতা, দ্বিতীয় বিষয়— ওনার মানসিক স্বাস্থ্য, এবং তৃতীয় বিষয়— ওনার নীতিবোধ এবং মূল্যবোধ।
সৃজনশীলতা (Creativity):
সৃজনশীলতা কথাটা মানুষের এক বিশেষ ধরনের cerebral ক্ষমতাকে বোঝায়। সৃষ্টি করতে গেলে মানুষের বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী এই দুই বিপরীতধর্মী সত্তার পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার দরকার হয়। প্রথমে মানুষ গ্রহণ করে। গ্রহণ করে তার পাঁচ ইন্দ্রিয়, তার বুদ্ধি বিবেচনা সবকিছু দিয়ে। আর তারপর এই সবটুকু তথ্য নিয়ে সে ডুব দেয় তার অন্তরের অন্তঃস্থলে। তার নিজস্ব চেতনা দিয়ে নতুন রূপে সাজিয়ে তোলে তথ্যগুলো। সৃষ্টি হয় নতুনের। এইবার দেখা যাক সত্যজিৎ রায়ের হাতের লেখায় ঠিক কী কী ভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর সৃজনশীলতা।
(একটা কথা একটু উল্লেখ করা দরকার যে নীচের হাতের লেখার বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে যে-কোনও একটা থাকলেই কিন্তু কেউ সৃজনশীল হয় না। কিছু কিছু গুণ একসাথে জুড়ে গিয়ে তৈরি করে এই আশ্চর্য ক্ষমতা। দেখা যাক সত্যজিতের সেই গুণগুলি কী কী।)
(১) লেখার ঊর্ধ্বভাগের প্রসার—
কারোর হাতের লেখার ঊর্ধ্বভাগ যত প্রসারিত হয় মানুষ তত চিন্তাশীল হতে পারে, সে তার মস্তিষ্ককে গভীরভাবে নিয়োজিত রাখতে পারে। এই ক্ষেত্রে হাতের লেখার ঊর্ধ্বভাগ, লেখার মধ্যভাগের দ্বিগুণ কী আড়াই গুণ। মানে উনি যা কিছু দেখছেন, শুনছেন, নিজের ইন্দ্রিয় দিয়ে গ্রহণ করছেন সব কিছুই মস্তিষ্কের মধ্যে processed হচ্ছে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে।
(২) সংযোগকারী রেখা—
সৃজনশীলতা নিয়ে মনোবিজ্ঞানের মঞ্চে যত গবেষণা হয়েছে, প্রতিটা ক্ষেত্রেই একটা সত্যি উঠে এসেছে যে, সৃজনশীলতার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি হল Originality। দেখা যাক সত্যজিৎ রায়ের লেখায় কী ভাবে ফুটে উঠেছে এই Originality। দুটো অক্ষরকে যা দিয়ে জোড়া হয় তাকে Graphology-তে বলা হয় সংযোগকারী রেখা বা Connecting strokes। এই সংযোগকারী রেখা বা Connecting strokes যাদের খুব মৌলিক ধরনের হয় (অবশ্যই লেখাটাকে দুর্বোধ্য না বানিয়ে) তারা দুটো আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী বিষয়কে সুসম্পর্কে জুড়তে পারে।
ওপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে উনি k এবং h কীভাবে জুড়েছেন। এবার বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করে বলা যাক। লেখার ঊর্ধ্বভাগ যেমন আমাদের বুদ্ধি, আমাদের মূল্যবোধ, নীতিবোধ, বিবেক, আধ্যাত্মিক ভাবধারা ইত্যাদির প্রতিচ্ছবি, তেমনি লেখার মধ্যভাগ হল আমাদের মনের বাস্তবতার জমি। লেখার Baseline-এ দাঁড়িয়ে থাকা অক্ষরটিকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় বারবার অবলীলাক্রমে ছুঁড়েছেন ঊর্ধ্বভাগের সর্বোচ্চ শিখরে। মানে বাস্তবের জমিতে দাঁড়িয়ে তিনি যা যা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন এই পৃথিবী থেকে, সেই সমস্ত অভিজ্ঞতা জুড়েছেন তিনি তাঁর মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ স্তরের কার্যকলাপের সাথে। তাই বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা বা পরিস্থিতি তাঁর সিনেমায়, গল্পে রূপ পেয়েছে তাঁর নিজস্ব মূল্যবোধ ও চেতনার রঙে রঙিন হয়ে।
(৩) ওপরে ডানদিকে লেখার আচমকা টান—
এই ধরনের আচমকা ওপরের ডানদিকে লেখার টানে যখন আমরা ‘d’ অক্ষর দেখি, তখন বুঝি যে মানুষটার মনের ইচ্ছে অপরিসীম। আর সত্যজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে এই ধরনের টান শুধু ইংরেজির ‘d’ বা বাংলার ‘ই’-কারেই দেখা যায় না, সত্যজিতের সইতে ‘য’-ফলাও একই তীব্র খিদের সাথে ওপরের দিকে উঠতে চায়।
(৪) ঘন দাগের লেখা—
বেশিরভাগ সৃজনশীল মানুষের হাতের লেখা নিয়ে বসলেই দেখা যায় যে তাদের লেখার মধ্যভাগের জায়গায় জায়গায় কালির ঘনত্ব বেড়ে গেছে। William Shakespeare থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবধি, কেউ-ই এর ব্যতিক্রম নন। সত্যজিৎ রায়ের লেখাতেও দেখা যায় লেখার মধ্যভাগ বা Middle Zone-এ কালির ঘনত্ব বেড়ে গেছে। এই ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার ব্যাপারটাকে বলা হয় Pastiness। এই Pastiness রোমান্টিকতার পরিচয় দেয়। এই রোমান্টিকতার কারণ হল এঁরা ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতিগুলোকে episodic memory দিয়ে সাজাতে পারেন।
Episodic memory-র মানে সব কটা ইন্দ্রিয়ের দেওয়া তথ্য-ই জমা আছে। এইটা খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে ফেলুদার ও লালমোহনবাবুর একটা কথোপকথনে।
‘দশাশ্বমেধে ভাসান দেখে চোখ কান ধাঁধিয়ে গেসল এটা বেশ মনে আছে। . . . ওই তো চোখ আর কান। বর্ণনায় ওই দুটোর জন্য খোরাক চাই সম্ভব হলে নাকও . . . লেক মার্কেটের কাছে বেল ফুলের গন্ধ বা নিউ মার্কেটের পশ্চিম দিকে বার্ট্রাম স্ট্রিটের কোনও বিশেষ অংশে শুটকি মাছের গন্ধ . . . ‘
[জয় বাবা ফেলুনাথ]।
তবে, ঘন দাগ অরিজিন্যাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট না দেখলে বোঝা যায় না। তাই এইখানে কোনও ছবি দেওয়া গেল না।
সত্যজিৎ রায়ের ছোট লেখা সত্যজিৎ রায়ের মাঝারি লেখা
(৫) লেখার আকার—
যে-কোনও হাতের লেখার আকার মাপা হয় লেখার মধ্যভাগের আকার দিয়ে। সেই হিসেবে দেখা গেছে সত্যজিৎ রায় মাঝারি এবং ছোট এই দু’রকম আকারেই লিখতেন। মানুষ যখন অন্তর্মুখী হয়ে সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন বাইরের distraction কমে আসে। লেখার আকার হয়ে আসে ছোট। মনঃসংযোগ বাড়ে। আবার লেখার আকার মাঝারি হলে মানুষ তার পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে পারে। আমরা দেখেছি যখন সত্যজিৎ রায় কোনও গল্পের প্লট বা সিনেমার দৃশ্যের পরিকল্পনা করে লিখে রাখতেন তখন লেখার আকার থাকত ছোট বা কখনও কখনও ক্ষুদ্র (small to tiny) আবার যখন উনি একটা Final পাণ্ডুলিপি কারোর কাছে পাঠাচ্ছেন তখন সেই লেখার আকার থাকত মাঝারি। যাঁরা দু’রকম ভাবেই লিখতে পারেন, তাঁদের সৃজনশীলতার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিকূল পরিস্থিতির সাথেও মানিয়ে নেওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি থাকে খুব জোরদার।
তাছাড়া ক্ষুদ্র আকারের উপস্থিতির জন্য এরা খুব স্বল্প আয়োজনেই কাজ চালিয়ে নিতে পারে। ‘একেই বলে শুটিং’ পড়লে বোঝা যায় গুপী গাইন বাঘা বাইন-এ তালি মেরে শুন্ডি যাওয়ার দৃশ্য কী সুন্দর বুদ্ধি করে করা হয়েছিল সামান্য একটা মাচা ও ক্যামেরার সাহায্যে ।
মানসিক স্বাস্থ্য (Mental Health)—
পাতার বাঁদিক থেকে ডানদিকে যে ভাবে এগোয় লেখা, তাই দেখে বোঝা যায় যে একজন মানুষ কীভাবে তাঁর লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছেন। এই ধরনের Baseline-কে বলা হয় Roof Tile Baseline অর্থাৎ শব্দগুলো একটার পর একটা টালির মতো করে সাজানো। একটা শব্দ ঝুঁকে পড়েছে; তার পরের শব্দটাকে আবার তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই baseline-এ ধরা পড়ে সত্যজিৎ রায়ের কঠিন লড়াই অবসাদের সঙ্গে। তিনি বার বার অবসাদগ্রস্ত পড়েন এবং প্রত্যকবার তাঁর তীব্র মনোবলের সাহায্যে সেই অবসাদ থেকে বেরনোর চেষ্টা করেন। উনি চেষ্টা করেন যাতে অবসাদ দ্বারা প্রভাবিত না হন কিন্তু সেটা কিছুতেই সম্ভব হয় না। চেপে যাওয়া আকৃতির দেখে বোঝা যায় যে নানারকম উদ্বেগ নিয়ে চলতে হত ওনাকে।
নীতিবোধ ও মূল্যবোধ (Value and ethics)—
একবার এক যুবক সত্যজিতের সঙ্গে কাজ করবেন বলে এসে পৌঁছন তৎকালীন বম্বে শহর থেকে। পৌঁছে জানতে পারেন যে, যে-ছবিতে কাজ করার ইচ্ছে নিয়ে তিনি কলকাতায় এসেছেন, সেই ছবিতে যতজন Assistant director প্রয়োজন, তাদের নিযুক্ত করা হয়ে গেছে। সত্যজিৎ চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন কিন্তু সে চিঠি যুবকটি সময়মতো পায়নি। এদিকে সে এসে পৌঁছে গেছে দেখে সত্যজিৎ তাঁকে পরের দিন ডেকে পাঠান। যুবক ভাবে যে, দেখা করে ফিরে যেতে হবে; কিন্তু তিনি দেখেন যে, সত্যজিৎ প্রোডিউসারকে রাজি করিয়েছেন টাকা adjust করে ছেলেটাকে সাত নম্বর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে রাখতে। শুধু তাই না, বম্বের ছেলে বাংলা বুঝবে না বলে গোটা গুপী গাইন বাঘা বাইনের Synopsis ভোরবেলা উঠে ইংরেজিতে টাইপ করেন নিজে। সেদিনের সেই যুবক ভবিষ্যতের অভিনেতা ও চিত্রপরিচালক টিনু আনন্দ সম্ভ্রমের সঙ্গে জানিয়েছেন এই কথা, পরবর্তী সময়ে।
সত্যজিৎ রায়ের লেখায় প্রসারিত উর্ধ্বভাগ আর কিছু কিছু কৌণিক (angular) সংযোগকারী রেখা শুধু যে তাঁর এই বলিষ্ঠ নীতিবোধ ও মূল্যবোধের পরিচয় বহন করে তা নয়, এগুলো তাঁর বিচক্ষণতা ও স্বাধীন ভাবনার মূর্ত প্রতীক।
কৃতজ্ঞতা: Satyajit Ray Society, National Digital Library of India, পার্থরঞ্জন দাশ