Categories
গল্পগ্রাম |

সর্পিণী

857 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
পায়েল ঘোষ

গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী

সন্ধেবেলার হাওড়া স্টেশন লোকে থইথই করছে। মালপত্র, কুলি, যাত্রী সবার মধ্যে তুলকালাম ব্যস্ততা। মৈনাকও সেই ব্যস্ততায় সামিল। সুজাতা আর গুবলুকে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে তুলতে এসেছে সে। চার বছরের গুবলু বেজায় ব্যস্ত। সবসময় মুখে যেন কথার খই ফুটছে। সারা প্ল্যাটফর্মে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সে। আর তাকে সামলাতে নাজেহাল হয়ে যাচ্ছে সুজাতা আর মৈনাক।

কিছুক্ষণ আগে অবধিও সুজাতার মুখে ছিল মেঘের ছায়া। প্রতি বছর গুবলুর স্কুলে গরমের ছুটি পড়লে বাপের বাড়ি যায় ও। বছরের এই তিনটে সপ্তাহ সুজাতার বিশ্রাম। মৈনাক তো অফিস, বন্ধু, তাসের আড্ডা আর বইপড়া নিয়েই মেতে আছে। বাড়ির জুতো-সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ, সবেরই একটাই সমাধান— সুজাতা। প্রতিবার মৈনাক নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসে ওদের, কিন্তু এবার অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং পড়েছে ওই সময়। তাই এবার ওদের দুজনকেই যেতে হচ্ছে। তাই সুজাতার মুখে মেঘের ঘোর। অবশ্য আস্তে আস্তে তা কাটছে মনে হচ্ছে।

ট্রেন প্ল্যাটফর্মে দিয়ে দিয়েছে। গুবলুর টাটা, সুজাতার একগুচ্ছ নির্দেশাবলি আর তার সাথে আলগাভাবে চোখ দিয়ে আদর করার সাথে ট্রেন ছেড়ে দিল। বাড়ি ফিরে মৈনাকের বেশ ফাঁকা লাগছিল। প্রথম ক’দিন এরকম লাগে তার। বারোশো স্কোয়ার ফিটের বাড়িতে সে এখন একা। এখনকার ফ্ল্যাট বাড়িগুলো সদর দরজা বন্ধ করলেই যেন এক একটা নির্জন দ্বীপ। চিরকাল উত্তর কলকাতার প্রাণবন্ত পাড়ায় বড় হওয়া মৈনাকের প্রথম-প্রথম বেশ অসুবিধে হত। এখন অনেকটাই অভ্যাস হয়ে গেছে। যদিও ছুটিছাটা পেলেই এখনও বন্ধুরা মিলে হেদোর ধারে চুটিয়ে আড্ডা দেয়।

গুবলুর ঘরে একবার ঢুকল সে। খেলনাপাতি ছড়ানো-ছেটানো। অনেক দরকারি খেলনা নিয়েও গেছে সে। ড্রইং খাতা জুড়ে বিরাট সূর্য, রং নীল, নিচে বড় করে লেখা ‘সান’। ডিনার করতে করতে টিভি চালাল মৈনাক। চ্যানেলে কার্টুন নেটওয়ার্ক সেট করা আছে, যেখানে ‘ছোটা ভীম’ মনের সুখে শত্রুদের পিটিয়ে যাচ্ছে। গুবলুকে স্কুল ইন্টারভিউতে জিজ্ঞাসা করেছিল ওর প্রিয় খাবার কী। একমুখ হেসে বলেছিল ‘এমা তুমি জানো না! লাড্ডু হল আমার ফেভারিট। ছোটা ভীম খায় তো! খুব শক্তি হয় খেলে’।

ঘড়ি এগারোটার কাঁটা ছুঁই ছুঁই করছে। কাল থেকে জোর কদমে অফিস। শুয়ে পড়ল মৈনাক।

পর পর দুটো সপ্তাহ লাগামছাড়া কাজের চাপ চলল মৈনাকের। সেই সকালে বেরনো আর রাত দশটার আগে ফেরা নেই। এই রবিবার সে তাই চুটিয়ে বিশ্রাম নেবে আর গল্পের বই পড়বে ভেবেই রেখেছিল। শনিবার সন্ধের দিকে সে লাইব্রেরি গেল। বিডন স্ট্রিটের এই লাইব্রেরিতে তার কলেজ আমল থেকে যাওয়া আসা। বেশ ভাল আর অন্যরকম বইয়ের কালেকশন। বেশ কিছু বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে একটি বইয়ের দিকে নজর পড়ল ওর। মোটা সবুজ মলাটের বই, নাম ‘সর্পিণী’। ওপরের মলাটে একটি কাল কেউটের ফণা তোলা ছবি। ছবিটির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল মৈনাক, তারপর ওটা হাতে নিয়ে গুটি গুটি লাইব্রেরিয়ান ভূপতিবাবুর কাছে এল।

—কেমন বইটা? মোটা দাগের গল্প নাকি চলনসই?
—‘সর্পিণী’? কেউ কেউ শুনেছি ভয় পেয়েছে। আমি কোনওদিন পড়িনি। নিয়ে যান। একটা বই পড়ে কী আর ভয় পাবেন!
—নাহ্ ভয়-টয় পাবার কোনও চান্স নেই। ইস্যু করে দিন। এক সপ্তাহ তো?
—আরে রাখুন রাখুন। এক-দুই সপ্তাহ। আপনি আমাদের পুরনো মেম্বার। অত চাপ নেবেন না।

সবুজ সর্পিণীকে নিয়ে পাড়ার বিরিয়ানির দোকান থেকে এক প্যাকেট মাটন বিরিয়ানি কিনে ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি ঢুকল মৈনাক। জমিয়ে খেতে খেতে বইটা পড়া যাবে’খন।

রাত সাড়ে বারোটার মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশ শেষ হয়ে গেল সর্পিণীর। বেশ টান টান উত্তেজনায় ভরা বই। লেখার বাঁধুনি খুব উচ্চমানের না হলেও পাঠককে বইয়ের পাতায় বেঁধে রাখার ক্ষমতা রাখে ‘সর্পিণী’। জঙ্গল থেকে সাথীহারা হয়ে চলে আসে একটি কালকেউটে এক মফস্বল শহরে। প্রত্যেক সুখী দম্পতিদের বাড়ি সে হানা দেয়, আকুল হয়ে খোঁজে তার সঙ্গীকে। যখন ব্যর্থ হয় সেই বাড়ির সুখ শান্তি ধ্বংস করে চলে যায় সে। সুখী দম্পতিদের সুখ তার মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেয়। প্রতিটা উপচ্ছেদে তার এক এক রকমের ধ্বংসলীলা। বেশ একটা রহস্যময় মন নিয়ে শুয়ে পড়ল মৈনাক। পরদিন ছুটি, সকালে ওঠার বিন্দুমাত্র তাড়া নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে ডুবে গেল সে।

ঘুমটা ভেঙে গেল একটা শব্দতে। মোবাইল বালিশের পাশেই থাকে ওর। সময় দেখল রাত আড়াইটে। শব্দটা আসছে রান্নাঘর থেকে। কেমন যেন মৃদু সড়সড় শব্দ। কোনও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী যদি অসম কিছুর ওপর চলাফেরা করে, তাহলে তার যেমন শব্দ হবে, এ যেন তেমনই শব্দ! রান্নাঘরের আলোটা জ্বালিয়ে ভাল করে দেখল। ইঁদুর, আরশোলা কোনও কিছুরই হদিশ পেল না সে। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর খুব কাছে আছে, তার উপস্থিতি টের পাচ্ছে ও। এবার একটু ভয় ভয় করতে লাগল ওর। সর্পিণীর গল্পের সঙ্গে কীরকম যেন মিল পাচ্ছে ও। নিজেকেই নিজে ধমকাল মৈনাক। সে কি বাচ্চা ছেলে নাকি!

ঢকঢক করে কিছুটা জল খেয়ে বেডরুমের দরজাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল সে। কিন্তু ঘুম আর আসে না, কী যেন একটা অস্বস্তি রয়েই যাচ্ছে। কেউ যেন ওর গতিবিধি লক্ষ্য করছে। চোখের সামনে সকাল হয়ে গেল। প্রভাতী আলোয় বড্ড নিশ্চিন্ত হল সে। চোখ দুটো জড়িয়ে এল ঘুমে।

দিনের আলোয় রাতের অভিজ্ঞতা অনেকটাই চাপা পড়ে যায়। মৈনাকের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। দেরিতে ওঠার ফলে কিছু জমে থাকা কাজ সারতে সারতেই দুপুর। বন্ধু দেবাশিসের বাড়িতে তার দুপুরে খাওয়ার নেমন্তন্ন ছিল। ওদের বাড়িতে আড্ডা আর খাওয়াদাওয়া করে যখন ফিরল, ঘড়ির কাঁটা রাত দশটা ছুঁইছুঁই করছে। বাড়িতে ফিরে একপ্রস্থ গুবলু আর সুজাতার সঙ্গে ফোনে গল্প করে বিছানায় গেল প্রায় এগারোটা নাগাদ। আর দিন পাঁচেক পরেই ফিরবে ওরা। গুবলুটা না থাকলে বাড়িটা বড্ড ফাঁকা লাগে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে শুয়ে পড়ল মৈনাক। হঠাৎ মনে পড়ল অসমাপ্ত সর্পিণীর কথা। বইটা পড়ার জন্যে তীব্র আকর্ষণ হচ্ছিল তার। পরের দু’ঘন্টা সে সম্পূর্ণ ডুবে গেল সর্পিণীতে। বইয়ের শেষ পাতায় যখন সে পৌঁছল রাত তখন একটা।

গতরাতের মতন আবার মৈনাকের ঘুম ভেঙে গেল ঠিক রাত আড়াইটেতে। আবার সেই শব্দ। চকিতে গত রাতের অভিজ্ঞতার কথা মনে হতে লাগল। এবার সড়সড় নয়, হিসহিসে শব্দ। কান খাড়া করে শুনল মৈনাক। শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এবারে রান্নাঘর নয়, শব্দটা আসছে বেডরুম লাগোয়া বাথরুম থেকে। আলো জ্বেলে মৈনাক বাথরুমের আনাচে কানাচে দেখতে লাগল। হঠাৎ বাথরুমের জানলার কাছে গিয়ে তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। কুচকুচে কালো একটা লেজের শেষাংশ জানলার কার্নিশ দিয়ে চলে গেল! তাহলে কি সর্পিণীর প্রবেশ হল তার জীবনে! দরদর করে ঘামতে লাগল সে। কলকাতার বুকে সাততলা এই অ্যাপার্টমেন্টে কী করে আসতে পারে সাপ? সমস্ত ঘরের আলো জ্বালিয়ে বিছানার মাঝখানে বসে রইল মৈনাক। কী কুক্ষণে যে বইটা পড়তে গেছিল সে! আবার একটা আতঙ্কঘেরা বিনিদ্র রাত কাটাল মৈনাক। ভোরের আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে যখন ঢুকল, ঘুমের ঘোর ঘনিয়ে এল তার চোখে।

পরদিন অফিস যাওয়ার পথে সর্পিণীকে লাইব্রেরিতে জমা করে দিল সে। এসব আপদ ঘর থেকে বিদেয় হওয়াই মঙ্গল। কিন্তু সারাদিনই অন্যমনস্ক থাকল আগাম রাতের কথা ভেবে। একবার ভাবল ছুটি নিয়ে চলে যাবে গুবলুদের কাছে। কিন্তু সেটাও কার্যকর হল না একটা জরুরি মিটিং পড়ে যাওয়ায় আর নিজের বোধকে আবেগের ওপর স্থান দেওয়াতে।

সন্ধেবেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে লক্ খুলতেই কেমন যেন ভয় ভয় করছিল ওর। মৈনাক বুঝতে পারছিল এক অসহায় অবস্থায় পড়ে গেছে সে। মনের জোর নিয়ে ঘরের অন্দরে ঢুকে আলো জ্বেলে সশব্দে টিভি চালিয়ে দিল সে। সারারাত চলুক টিভি, আর কোনও শব্দই কানে আসবে না তার। দু’রাত না ঘুমনোর ফলে অজান্তেই চোখ জুড়িয়ে এল তার। রিমোটটা নিয়ে টিভি বন্ধ করে শুয়ে পড়ল সে। আহ্ শান্তির ঘুম আসছে এবার।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল শ্বাসকষ্টে। গলার কাছে কালো ঠান্ডা কী যেন পেঁচিয়ে আছে। আর সেই পেষণের অসম্ভব চাপ! অসম্ভব অস্বস্তিতে সে চিৎকার করতে শুরু করল, কিন্তু একটুও আওয়াজ বেরল না। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসতে লাগল একটা চেনা শব্দ। এ শব্দ ওর মোবাইলের অ্যালার্মের। ভয়ংকর একটি দু:স্বপ্নের থেকে জেগে উঠল মৈনাক।

ডা: সেনগুপ্ত বেশ হাসিখুশি মানুষ। দেখলেই যেন মনের জোর কিছুটা বেড়ে যায়। অফিস না গিয়ে আজ এই সাইকোলজিস্টের দ্বারস্থ হয়েছে মৈনাক। তিনটি রাতের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার পর সে নিশ্চিত, ফোবিয়ায় আক্রান্ত সে। আগামীকাল সুজাতা, গুবলু চলে আসছে, তার আগে নিজেকে ঠিক করে নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

ডা: সেনগুপ্ত মন দিয়ে শুনলেন ঘটনার বিবরণ।
—মৈনাকবাবু, আপনি আপনার পরিবারের বৃত্ত নিয়ে খুব সুখী। তাই আপনার অবচেতন মন সবসময় তা হারানোর ভয়ে ব্যাকুল থাকে। সর্পিণী আপনাকে সেটার ইন্ধন জুগিয়েছে মাত্র। চিন্তা করবেন না, একটা মাইল্ড ঘুমের ওষুধ দিচ্ছি, ডিনারের আগে খেয়ে নেবেন। আপনার সাউন্ড স্লিপের প্রয়োজন।

ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা ঘুমের ওষুধের স্ট্রিপটা নিয়ে ম্লানমুখে বাড়ি ফিরল সে। সুজাতাকে ফোন করল। মোবাইলটা বেজে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ পর গুবলু ফোন ধরল।
—কীরে মা কোথায়?
—বাবা তুমি! মা তো দিম্মার ঘরে বসে প্যাকিং করছে।
—তুই কী করছিলি?
—আমি কার্টুন দেখছি।
—তুমি কী করছ?
—আমি মাঝে মাঝেই ভয় পাচ্ছি, স্নেকের।
—এমা!! স্নেককে আবার কেউ ভয় পায় নাকি! সামনে এলে ওর লেজটা ধরে মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। আচ্ছা আমি কাল বাড়ি গিয়ে তোমায় দেখিয়ে দেব কীভাবে করতে হয়!
এবার সুজাতার গলা।
—কী গো অফিসে বসে এত গল্প করছ! কাজ কম নাকি?
—আজ চলে এসেছি তাড়াতাড়ি।
—শরীর ভাল আছে তো তোমার?
—ঠিক আছি।
—কাল তাহলে সময়মতো স্টেশনে চলে এসো কিন্তু। অ্যালার্ম দিয়ে রেখো। লাস্ট সপ্তাহটা খুব মিস করছিলাম তোমায়। আর এতদিনের জন্য তোমায় একলা রেখে আসব না।

ফোনটা রেখে মনটা বেশ শান্ত লাগল মৈনাকের। টিভিতে গুবলুর কার্টুন চ্যানেলটা অন করল! সত্যিই তখন দেখাচ্ছে গুবলুর হিরোর সর্পনিধন। সকালে ওঠা আছে। ট্রেন ইন করবে সাড়ে সাতটা নাগাদ। বেডরুমের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ল মৈনাক।

হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার। অভ্যেস মতো মোবাইলের ঘড়িতে চোখ চলে গেল। সকাল সাড়ে ছ’টা বাজে। একঘুমেই সকাল হল তার আজ। দিব্য বুঝতে পারল সর্পিণী বিদায় নিয়েছে তার জীবন থেকে। ঘুমের ওষুধের স্ট্রিপটা ডাস্টবিনে ফেলে দিল সে। সুজাতা সর্পিণীর ব্যাপারে না হয় নাই জানল।

ফুরফুরে মেজাজে স্টেশনে চলল সে। আজ সকালটা বড় ভাল লাগছে তার।