Categories
রূপকথাহাটি |

সাদা-কালো উপলখণ্ড

786 |
Share
| ২২ নভেম্বর, ২০২০
মণিশংকর বিশ্বাস

অলংকরণ: সৌরভ মিত্র

খুব ছোট্ট একটা গল্প। একে গল্প না বলে, বরং একটা ধাঁধাই বলা যায়। ছোট্ট গল্পটার শেষে, তোমাদের একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব। দেখি, তোমরা কী উত্তর দাও! তাহলে শুরু করি?

বহুদিন আগে চীন দেশে, এক প্রত্যন্ত গ্রামে এক দরিদ্র চাষি বাস করতেন। তার ছিল পরমা-সুন্দরী এক কন্যা। কিন্তু গরীব বাপের গরীব মেয়ে। তাই রূপ থাকলে কী হবে, খুব কষ্টে-সৃষ্টে তাদের দিন গুজরান হত। মেয়েটির মা ছিল না। তাই মেয়েটিকেই ছোট এক পাহাড়ি ঝর্ণা থেকে খাবার জল আনতে হত, যেতে হত জঙ্গলে কাঠ কাটতে, আবার বাড়ি ফিরে রান্নাও করতে হত। আর মেয়েটির বাবা ছোট্ট এক ফালি পাথুরে জমিতে বহু কষ্টে কিছু ফসল ফলাত। তাই-ই বিক্রি করে তাদের কোনোরকমে চলে যেত। সে বার গ্রীষ্মে কোথা থেকে এক ঝাঁক পঙ্গপাল এসে, চাষির সব ফসল খেয়ে নিল। এবার কী করে বাপ-বেটিতে? অনেক ভেবেচিন্তে চাষি, ওই অঞ্চলের যে মহাজন, তার কাছে গিয়ে বলল, কিছু টাকা ধার না দিলেই নয়। নয়তো না-খেয়েই মারা পড়ব বাবা-মেয়েতে। মহাজন টাকা তো দিল, কিন্তু শর্ত দিল একটা; টাকা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে হবে। না এটা শর্ত নয়। শর্তটা হল, নির্দিষ্ট দিনের ভিতর টাকা ফেরত না দিলে, মহাজন যা চাইবে, তাই-ই তাকে দিতে হবে। তখন তো আজকের মতো এমন লেখা-পড়া করে নেবার চল ছিল না। মহাজনের দু’-একজন মোসাহেবের সামনে কথা হল এবং এই শর্তে চাষিও সম্মত হল। চাষির তো আর কোনও উপায়ও ছিল না। তাছাড়া চাষি ভাবল আমার তো তেমন কিছু নেই, কীইবা চাইবে এই সুদের কারবারি। যে-সামান্য ভিটে-মাটিটুকু আছে, তা নিশ্চয়ই মহাজন চাইবে না। সে-টুকু চলে গেলে বাপ-মেয়েতে গিয়ে উঠবে কোথায়? চাষি ভাবল বহু-পুরুষ ধরে তারা একই গ্রামে বাস করছে, এতটা নিষ্ঠুর নিশ্চয়ই মহাজন হবে না। তাছাড়া ওই যে বললাম, চাষির টাকা ধার নেওয়া এ ছাড়া উপায়ই বা আর কী ছিল? মহাজনের কিন্তু উদ্দেশ্য ভাল ছিল না। কুৎসিত বয়োবৃদ্ধ মহাজন মনে মনে চাষির মেয়েকে বিয়ে করবার ফন্দি আঁটছিল। অর্থাৎ ধার শোধ না করতে পারলেই, কেল্লাফতে, মহাজন তার কার্যসিদ্ধি করে ফেলবে। শয়তান মহাজন এই ভাবেই নানারকম ফন্দি-ফিকির করে বহু মানুষের সর্বনাশ করেছিল। কিন্তু কেউই, মহাজনের অঢেল টাকা-পয়সা এবং সেই সঙ্গে টাকা-পয়সা ধার-বাকি দেবার ক্ষমতার সামনে মুখ খুলতে সাহস পেত না। কখন কার টাকার দরকার হয়! তাছাড়া তখন তো আর আজকের মতো ব্যাঙ্ক ছিল না। সে যাই হোক চাষি মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার এনে যথারীতি কষ্টে-সৃষ্টে কোনও রকম দু’বেলা দু’-মুঠো খেয়ে আবার ফসল ফলানোর কাজে লেগে পড়ল। ততদিনে পঙ্গপালও ওই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। দিন যায় ফসলের ক্ষেতে চাষি নিবিষ্ট মনে কাজ করে। মেয়েও আগের মতই ঘর-কন্যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেবার ফসল হয়তো ভালই হত, কিন্তু সেই ফসল ঘরে উঠবার আগেই কিন্তু টাকা ফেরত দেবার তারিখ চলে এল। মহাজন তো ওভাবেই হিসেব করে টাকা ফেরত দেবার তারিখ ঠিক করেছে, যাতে চাষি কিছুতেই টাকা ফেরত না-দিতে পারে। এবার চাষি কী করে!

যেদিন টাকা শোধ করবার শেষ দিন, চাষির মেয়েটি সকালে ঘুম থেকে উঠেই, বাবাকে বলল, বাবা, আমিও যাব তোমার সঙ্গে, মহাজনের সঙ্গে দেখা করতে। কী ভেবে চাষিও রাজি হয়ে গেল। প্রথমত চাষি জানত, তাঁর মেয়ে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী আর দ্বিতীয়ত ওই বয়সের কচি একটা মেয়েকে দেখে যদি মহাজনের একটু মায়া হয়। তাছাড়া বিপদে পড়লে তো মানুষ খড়কুটোটাও আঁকড়ে ধরে। যাই হোক, চাষি আর চাষির মেয়ে খুব ভোরে মহাজনের বিশাল বাগান-ঘেরা বাড়ি গিয়ে দেখল, মহাজন বাগানের ভিতর যে ছোট ছোট নুড়ি-পাথর দিয়ে তৈরি যে রাস্তা করা আছে, সেখানে পায়চারি করছে। আসলে ওই দুর্বৃত্ত সুদের কারবারিরও রাতে ভাল ঘুম হয়নি উত্তেজনায়। কেননা সে জানত, আগামীকাল সে গোটা তল্লাটের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে বিনা বাধায় বিয়ে করার কথা পাড়তে পারবে।

মহাজন তো ওদের দেখেই সোৎসাহে এগিয়ে এসে বলল, এত সকালেই তোমরা টাকা নিয়ে চলে এসেছ? মহাজন তো মনে মনে জানতই যে চাষি টাকা যোগাড় করতে পারেনি। এখন আরও সময় চাইতেই এসেছে। তখন চাষি মাথা-নিচু-করে হাতজোড় করে বলল, দয়া করে আমাদেরকে আর কয়েকটা দিন সময় দিন। কথা দিচ্ছি এবারে ফসল উঠলেই আপনাকে কড়ায় গণ্ডায় সব হিসেব চুকিয়ে দেব। মহাজন তো নারাজ, স্বভাবতই। অনেক কাকুতি-মিনতি করবার পর মহাজন বলল, একটা সুযোগ আমি দিতে পারি। ভেবে দ্যাখো এটা তোমরা নেবে কিনা। পকেট থেকে একটা ছোট থলে বের করে, মহাজন বলল, আমি এর ভিতর একটা সাদা পাথর, আর একটা কালো পাথর রাখছি। এখন চোখ বন্ধ করে একটা পাথর তুমি বা তোমার মেয়ে তুলবে। যদি সাদা পাথর তুলতে পারো, তোমাদের সব ঋণ মকুব এবং সেই সঙ্গে উলটে আমি তোমাদেরকে পাঁচটা ভেড়া, দুটো শুকর ছানা, এক ডজন বাচ্চা মুরগী আর তাদের সম্বৎসরের খাবার উপহার দেব। আর যদি কালো পাথর তোলো, তাহলেও তোমাদের সব ঋণ মকুব, কিন্তু তোমার মেয়েকে আমি বিয়ে করে আমার ঘরে নিয়ে আসব। এটা শুনে তো চাষির মন-হৃদয় একদম ভেঙে গেল। যদিও সম্ভাবনা ৫০ শতাংশ তবু মেয়েকে সত্যিই যদি ওইরকম একটা বদমাশের হাতে তুলে দিতে হয় শেষমেশ, তাহলে চাষির আর বেঁচে থাকার কোনও অর্থ থাকবে না। যার মুখের দিকে তাকিয়ে চাষির এই দারিদ্র-ক্লিষ্ট জীবনে বেঁচে থাকা, সেই একমাত্র আনন্দটুকুকেও বিসর্জন দিতে হবে ভেবে চাষির বুক ব্যথায় মুচড়ে গেল।

এর মধ্যে আরও তিন চার জন মোসাহেব, যাদের কাজই ছিল ওই সুদখোর মহাজনের তাঁবেদারি করা, এসে হাজির হয়েছে ততক্ষণে মজা দেখবে বলে। চাষির মেয়ে কিন্তু রাজি হয়ে গেল এই বাজিতে। বাবাকে বলল, বাবা, যাই হোক, আমাদের ঋণ তো শোধ হয়ে যাবে! তাছাড়া আমি তো আর মরে যাচ্ছি না! চাষি উপায়ান্তর না দেখে রাজি হয়ে গেল। মেয়েটি বলল সেই তুলবে পাথর খণ্ড ওই থলে থেকে, তার বাবা নয়। কিন্তু এর মধ্যে মেয়েটি আড়চোখে দেখে নিয়েছে শয়তান মহাজন, দুটোই কালো রঙের নুড়ি-পাথর ওই থলের ভিতর রেখে দিয়েছে। অর্থাৎ যে পাথরটিই তোলা হোক না কেন, সেটাই হবে কালো রঙের।

তোমাদের এখন বলতে হবে, মেয়েটি কী করবে? কালো রঙের পাথর তুলে ওই শয়তান মহাজনের ঘরণী হবে, ঋণ-ক্লিষ্ট বাবাকে বাঁচাতে? না-কি চিৎকার চেঁচামেচি করে আরও লোক জড়ো করবে এবং বলবে মহাজনটা কত বড় দুষ্কৃতী, দুটোই কালো রঙের পাথর রেখেছে থলের ভিতর! তবে দ্বিতীয় রাস্তাটি বেছে নিলে, আরেকটি অসুবিধে হতে পারে এই, যে ঋণ তো মকুব হবেই না, ভিটে-জমিও সব যাবে। উলটে রেগে গিয়ে মহাজন তার লোক দিয়ে বাপ-মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে কাল-কুঠরিতে নিক্ষেপও করতে পারে। আবার মন্দের ভাল, তাহলে অন্তত ঐ কুৎসিত শয়তানটার হাত থেকে মেয়েটি রক্ষা পায়। এবার তোমরা বলো তো কী করা উচিত মেয়েটির?

আজ যে এই গল্পটা আমি লিখছি এত বছর পরেও, তার কারণ মেয়েটি এসব কিছুই করেনি। মেয়েটি পাথর দুটির একটি পাথর তুলে টুপ করে ফেলে দিয়ে বলল, আমি খুবই দুঃখিত, আমি সাদা পাথরই তুলেছিলাম, কিন্তু হাত ফসকে পড়ে গেল! আমাকে বিশ্বাস না হয় দ্যাখো এই থলেতে, কী রঙের পাথর আছে। যদি কালো রঙের পাথর হয় তখন তো নিশ্চয়ই বিশ্বাস করবে, আমি সাদা রঙের পাথরই তুলেছিলাম। ধূর্ত মহাজনের তো মাথায় হাত। আর কিছু করার থাকল না, কেননা যে রাস্তার উপর এইসব ঘটছিল সেই রাস্তাটিও ওই একই রকম অজস্র সাদা-কালো নুড়ি-পাথর দিয়ে তৈরি। মেয়েটি যে কালো পাথরটি তুলে, হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল, সেটি তখন অজস্র সাদা-কালো নুড়ি-পাথরের সঙ্গে মিশে গেছে। আর বাপ-মেয়েও এই অন্যায় বাজি জিতে উল্লাস করতে শুরু করেছে। শেষে ব্যাজার-মুখে মহাজন তার লোকজনকে শর্ত মতো চাষি আর চাষির মেয়েকে উপহার দিতে বলে, ভিতর-বাড়ির দিকে তড়িঘড়ি রওনা দিল।

তাহলে বুঝলে তো ইংরেজিতে যে বলে ‘আউট অব দ্য বক্স’ ভাবতে, সেটা কী? জীবনে যখনই খুব মুশকিলে পড়ে যাবে, এই মেয়েটির কথা ভেবো। ভাববে কীভাবে ‘আউট অব দ্য বক্স’ চিন্তা করে মেয়েটি এই বিপদের সময়, নিজেকে ও বাবাকে রক্ষা করেছিল। তাহলে দেখবে ঠিক কোনও না কোনও রাস্তা পেয়েই গেছ।