Categories
আঁকানিকেতন |

সালভাতোর মুন্ডি

1153 |
Share
| ১১ মার্চ, ২০২১
বিভাস সাহা

অর্থনীতির অধ্যাপক, ডারাম ইউনিভার্সিটি, ইংল্যান্ড

সালভাতোর মুন্ডি, ১৫০০, কাঠের প্যানেলের উপর তেল রঙে আঁকা, ২৫.৮ ইঞ্চি x ১৯.২ ইঞ্চি, আবু ধাবির লুভের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত; চিত্র সৌজন্য: wikipedia.org

আমাদের শেষ আলোচ্য ছবি সালভাতোর মুন্ডি। যিশু খ্রিস্টের ছবি সালভাতোর মুন্ডি (Salvator Mundi), যার বাংলা মানে হল পৃথিবীর রক্ষাকর্তা, লিওনার্দোর পরিণত বয়সের এক অনন্য সৃষ্টি। তাঁর সমস্ত বিশেষত্ব এই ছবিটিতে আছে। প্রথম দর্শনে অনেকের চোখেই এক সুদর্শন তরুণের পোর্ট্রেট ছবি বলে মনে হবে। শরীরের উপর অর্ধাংশ নিয়ে পোর্ট্রেট আঁকার ধারা তিনি কয়েক বছর বাদেই অমর করে তুলবেন মোনা লিসায়। সালভাতোর মুন্ডি তারই পূর্বাভাস।

কিন্তু ছবিটি কোনও জীবিত মানুষের পোর্ট্রেট নয়, লিওনার্দো নিজের কল্পনায় যিশুকে এঁকেছেন। তাঁর মুখমন্ডল একই সঙ্গে মানবিক ও অলৌকিক। তার মুখে এক আশ্চর্য সৌম্যতা। তাঁর মুখের অভিব্যক্তি লিওনার্দোর স্বভাবোচিত দ্ব্যর্থময়। যিশু কি পৃথিবীর দুঃখ গ্রহণ করে বিষণ্ণ, নাকি এক মহাজাগতিক দূরত্বে দাঁড়িয়ে মানুষকে আশীর্বাদ করছেন? দর্শকের মনে এই মিশ্র অনুভূতি হয়। এই অনুভবের দোলাচল লিওনার্দোর মহত্ব। যিশুর ডান হাতের আশীর্বাদী ভঙ্গী (ক্রিশ্চান ধর্মে আশীর্বাদের ভঙ্গি এইরকম) শান্তি ও সৌম্যতার আবহকে আরও সংবদ্ধ করে। অন্যদিকে তাঁর বাঁহাতে ধরা একটি ক্রিস্টাল গোলক— পৃথিবী অথবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতীক। মনে রাখা উচিত তখনও মহাবিশ্ব সম্পর্কে ধারণাটি টলেমি প্রদত্ত হাজার বছরের বেশি পুরনো— পৃথিবীই সৌরমণ্ডল তথা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। কোপারনিকাস জন্মেছেন (তিনি পিসা শহরে জন্মান লিওনার্দোর পনেরো বছর বাদে), আর গ্যালিলিও জন্মাবেন বহু বহু বছর বাদে। তাই ক্রিশ্চান ধর্মাবলম্বীদের ভাবনায় তখন যিশু শুধু পৃথিবীর নয়, মহাবিশ্বের ত্রাতা। লিওনার্দো এমনই একটা ভাবনা দিতে চেয়েছেন স্বচ্ছ গোলকটি চিরতরুণ যিশুর বাঁ-হাতে বসিয়ে।

এখানে লক্ষণীয় যিশুর ডান হাতটি অত্যন্ত সুস্পষ্ট এবং মুখমণ্ডল তুলনায় একটু আবছা। এর কারণ কী? আসলে ডান হাতটি শরীর থেকে একটু এগিয়ে, অর্থাৎ দর্শকের একটু কাছে। নিখুঁতভাবে দূরত্ব বোঝানোর জন্যে হাতটিকে পরিষ্কার এবং মুখটিকে ঈষৎ আবছা করেছেন, যাকে ফোটোগ্রাফির ভাষায় ‘আউট অফ ফোকাস’ বলা হয়। অন্যদিকে কিছু সমালোচক প্রশ্ন তোলেন বাঁ-হাতে স্বচ্ছ গোলকটিতে পোষাকের কোনও প্রতিবিম্ব নেই কেন? কাচের ভিতর দিয়ে পোষাক কেন অবিকৃত দেখাচ্ছে? এটা কি আঁকার ভুল, নাকি লিওনার্দো নিজে না এঁকে কোনও নবিশের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন? এর উত্তরে বলা হয়, গোলকটি আসলে অপার্থিব, এটি পৃথিবীর প্রতীক। তাই লিওনার্দো এখানে বাস্তবতাকে ভেঙেছেন। যাই হোক এই অবাস্তবতা কিন্তু আমাদের দৃষ্টিকটু লাগে না। বরং সুন্দরই লাগে। যিশুকে তিনি যে পোষাকটি পরিয়েছেন, তাও চিরাচরিত প্রাচীন আরব দেশের জোব্বা নয়, বরং পঞ্চদশ শতাব্দীর ইতালির অভিজাত শ্রেণীর পোষাক। ব্যতিক্রম সৃষ্টি করাই লিওনার্দোর বিশেষত্ব ছিল।

নান্দনিক দিক দিয়ে অসাধারণ হলেও সালভাতোর মুন্ডি বিখ্যাত আর একটি কারণে। এটি চিত্রকলার ইতিহাসে বোধহয় সর্বাধিক বিতর্কিত, রহস্যময় এবং নাটকীয় ছবি। পাঁচশো বছর ধরে এই রহস্য ঘন হয়েছে। এটা নিশ্চিত ও তথ্যগ্রাহ্য যে লিওনার্দো ‘সালভাতোর মুন্ডি’ নামে একটি ছবি এঁকেছিলেন ১৫০০ খৃস্টাব্দে ফ্রান্সের রাজা দ্বাদশ লুই-এর জন্যে। দ্বাদশ লুই মিলান শহর সহ ইতালির বেশ কিছু অংশ দখল করেছিলেন। কিন্তু এটা জানা যায় না ছবিটি লিওনার্দো স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে এঁকেছিলেন, নাকি রাজার তরফ থেকে অনুরোধ এসেছিল। আমরা জানি এই সময় তিনি ফ্রান্সের রাজ পরিবারের সংস্পর্শে আসেন এবং ভবিষ্যতে (১৫১৫ সালে) ফ্রান্সে বরাবরের জন্যে চলে যাবেন। যাই হোক, সেই ছবিটি ফ্রান্স হয়ে অজ্ঞাত ভাবে একশো বছর বাদে ইংল্যান্ডে পৌঁছায় এবং বিভিন্ন ধনী ব্যক্তির মধ্যে হাতবদল করতে থাকে।

ইতিমধ্যে লিওনার্দোর আসল ছবিটির পাশাপাশি আরও কুড়িটি প্রায় একই রকম ছবি ইউরোপে বিভিন্ন জনের কাছে (ধনী বা রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যে) ঘুরতে দেখা যায়। এগুলির উৎপত্তি ইতালি থেকেই বলে অনুমান করা হয়। কয়েকটি লিওনার্দোর ছাত্র ও অনুগামীদের আঁকা বলে নির্ধারিত। যেহেতু লিওনার্দো অত্যন্ত বিখ্যাত শিল্পী ছিলেন, তাই তিনি যা আঁকতেন তাই নকল করা অন্য শিল্পীদের কাছে একটা শিক্ষার ব্যাপার ছিল। এর পিছনে যে সব সময় অসৎ উদ্দেশ্য থাকত, তা নয়। কিন্তু এই বিভিন্ন কপি বর্তমান থাকার জন্য একটা সময়ের পরে কোন ছবিটা আসল আর কোন ছবিটা নকল, তা গুলিয়ে যায়। তার উপর ছবির বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছবির মালিক বা সংগ্রাহকরা রক্ষণাবেক্ষনের জন্যে নতুন করে রঙের কোটিং দিতেন। এতে আসল ও নকলের তফাৎ আরও মুছে যায়। সন্দেহ ও বিভ্রান্তি এমন জায়গায় পৌঁছায় যে একশো বছর আগে শিল্পবোদ্ধা এবং ব্যবসায়ীরা একমত হন যে লিওনার্দোর আঁকা আদি ছবিটি চিরতরে হারিয়ে গেছে।

বর্তমান ছবিটি গত শতাব্দীতে এক ব্রিটিশ পরিবারের সংগ্রহে ছিল। ছবিটি ততদিনে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও অযত্নের শিকার হয়েছে। ঐ পরিবার ছবিটি লিওনার্দোর এক ছাত্রের আঁকা ভেবে (সবাই তাই ভেবেছিল) ১৯৫৮ সালে নিলামে বিক্রি করে দেন, দাম ওঠে মাত্র ৪৫ পাউন্ড। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে ছবির অতীত নির্ধারণ করার অনেক পদ্ধতি বেরিয়েছে। এক্স রে ক্যামেরার মাধ্যমে ছবির রঙের নিম্নবর্তী স্তর, এমনকি একদম প্রথম স্তর অর্থাৎ ড্রয়িং পর্যন্ত, দেখা সম্ভব। ২০০৫ সালে ছবিটি কয়েকজন আর্ট ডিলার মাত্র ১০,০০০ ডলার দিয়ে কিনে নেন এবং নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মডেস্টিনিকে কাজে লাগান ছবিটির স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে। মডেস্টিনি আবিষ্কার করেন যে ছবিটির প্রথম স্তরে যে ড্রয়িং ছিল, সেখানে যিশুর ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি দুবার আঁকা হয়েছিল— একটি সোজা, আর একটি ঈষৎ বাঁকা। পরের স্তরে সোজা আঙুলটি রঙ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়, এবং বাঁকা আঙুলটি রাখা হয়। মডেস্টিনি যুক্তি দেন যে এটাই নিশ্চয় প্রথম ছবি, কারণ প্রথম ছবিতেই শিল্পীর দোনামোনা থাকবে, যে নকল করছে তার কোনও দোনামোনা থাকার কথা নয়। অকাট্য যুক্তি। এই যুক্তিতে ২০১২ সালে ছবিটি লিওনার্দোর আঁকাই বলে সর্বসম্মত হয়। সে অর্থে সালভাটোর মুন্ডি শেষতম আবিষ্কৃত লিওনার্দোর ছবি এবং আবিষ্কারের হিসাবে মাত্র আট বছর বয়সী বলা যেতে পারে। মজার ব্যাপার হল ২০১৭ সালে ছবিটি নিউ ইয়র্কে ক্রিস্টির নিলামে ৪৫.৩ কোটি ডলারে বিক্রি হয়। অর্থাৎ ৩১০০ কোটি ভারতীয় টাকা, পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বোচ্চ দাম। কিনেছেন আবু ধাবির সরকার।

প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, সর্বাধিক দামের দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দুটি ছবি (দাম ৩০ কোটি ডলার)— পল গঁগ্যার ‘তাহিতি মেয়েরা’ এবং উইলেম ডি কুনিং-এর ‘ইন্টারচেঞ্জ’। তৃতীয় স্থানে রয়েছে পল সেঁজার ‘তাস খেলোয়াড়’ ছবিটি— দাম ২৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে গঁগ্যা এবং সেঁজার ছবির মালিক কাতারের সরকার। আরব দুনিয়া এখন ছবির বাজারে খুব বড় ক্রেতা। লিওনার্দোর সালভাতোর মুন্ডি আবু ধাবির মিউজিয়ামে রাখা হবে বলা হলেও, এখনও অবধি ছবিটি সাধারণ দর্শকদের দেখতে দেওয়া হয় না। অনেকে মনে করেন ছবিটি সৌদি আরবের রাজপুত্র মহম্মদ বিন সলমনের ব্যক্তিগত হেফাজতে রাখা আছে। তা যদি সত্যি হয়, তাহলে ছবিটি ঘুরে-ফিরে সেই ব্যক্তিগত সম্পত্তিই থেকে গেল। সাধারণ মানুষ কবে দেখতে পাবে কেউ জানে না।

কথিত আছে, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি একদা বলেছিলেন, ‘Simplicity is ultimate sophistication’। সারল্যের মধ্যেই সৌন্দর্যকে খুঁজে পাওয়া যাবে। এই বোধ যুগে যুগে সমস্ত মহৎ শিল্পী সাহিত্যিকের মধ্যেই দেখা গেছে। রবীন্দ্রনাথ, মোনে, পিকাসো, মাতিস ইত্যাদি সকলেই তাঁদের দীর্ঘ জীবনের শেষ পর্বে এই সারল্যের উপাসনা করেছেন। এক অর্থে মহান শিল্পীরা সারা জীবন অরূপরতন খুঁজে বেড়ান। লিওনার্দো বোধহয় এই দুর্লভ অরূপরতন খুঁজে পেয়েছিলেন এবং আমাদের সেই সৌন্দর্যের কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছেন, একটু দূরত্বে। এই সৌন্দর্য সন্ধান নিয়ে তিনি নিজের সাফল্য সম্পর্কে কী ভেবেছিলেন? আমরা জানি না। বোধহয় যাঁরা সোনার হরিণ খোঁজেন, তাঁদের খোঁজা কখনও ফুরায় না।

ঋণ: Douglas Manning (1981), The Art of Leonardo da Vinci, Optimum Books, London; www.wikipedia.org; David Alan Brown (1998); Leonardo da Vinci: Origins of a Genius, Yale University Press