বনবাসের সময় রাম, লক্ষ্মণ, সীতা কয়েকদিনের জন্য ফল্গুনদীর তীরে বসবাস করতেন। এইসময়ই এসে উপস্থিত হল তাদের পিতার শ্রাদ্ধের কাল। রাম শ্রাদ্ধায়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে লক্ষ্মণকে পাঠালেন কাছের গ্রামে। কিন্তু অনেক সময় কেটে যাওয়ার পরও লক্ষ্মণ ফিরে আসছে না দেখে, রাম নিজেই গ্রামের উদ্দেশে রওনা হলেন।
তারপরও পার হয়ে গেল অনেক সময়, কিন্তু রাম বা লক্ষ্মণ কেউই ফিরে এলেন না। বেলা প্রায় শেষ হয়ে আসছে দেখে সীতা ভাবলেন, তিনি নিজেই হাতের কাছে যা আছে তা দিয়ে দশরথের পিণ্ডদান করবেন। সেইমতো তিনি বন থেকে কিছু ফুল সংগ্রহ করে এনে, ইঙ্গুদি তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে নিয়মমতো পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করা মাত্রই শূন্যে কয়েকটা হাত সেইটি গ্রহণ করলেন। তারপর দৈববাণী হল— ‘হে জনকনন্দিনী, আজ আমরা পরম তৃপ্তি লাভ করলাম। তোমাকে আশীর্বাদ করি তুমি ভাল থেকো।’
সীতা বললেন— ‘আপনার আশীর্বাদ গ্রহণ করলাম, কিন্তু আপনি কি আমাদের পিতা?’
আবার দৈববাণী হল— ‘হ্যাঁ আমি তোমাদের পিতা দশরথ, আজ তোমার হাত থেকে পিণ্ড পেয়ে আমরা যারপরনাই শান্তি লাভ করেছি।’ তবু সীতার মনে সংশয় দেখে আবার দৈববাণী হল ‘আমরা নিজে এসে তোমার হাত থেকে পিণ্ড নিলাম, তবু তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি তাতেও খুশি হওনি।’ সীতা বললেন ‘আমি যে কতটা আনন্দ পেয়েছি তা বলে বোঝাতে পারব না, কিন্তু আমি ভাবছি রাম এবং লক্ষ্মণ ফিরে এসে যদি বিশ্বাস না করেন এইসব কথা?’ দৈববাণী হল ‘তবে তুমি কয়েকজনকে সাক্ষী রেখে দাও, যারা তোমার হয়ে সত্যি কথা বলবে।’ সীতা তখন ফল্গুনদী, অগ্নি, গরু আর কেতকি ফুলকে সাক্ষী রাখলেন।
এর কিছুক্ষণ পর রাম, লক্ষ্মণ ফিরে এসে সীতাকে বললেন ‘অনেক দেরি হয়ে গেল, তুমি তাড়াতাড়ি স্নান শেষ করে খাবারের আয়োজন কর। পিণ্ডদানের সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে, পিতা নিশ্চয়ই আড়ালে এসে উপস্থিত হয়েছেন।’ এই কথা শুনে সীতা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন রাম বললেন ‘তুমি কি আমাকে কিছু বলবে?’ সীতা এরপর সবকথা তাকে খুলে বললেন। কিন্তু রাম এসব শুনে অবাক হয়ে লক্ষ্মণকে প্রশ্ন করলেন ‘এও কি সম্ভব? যাকে শাস্ত্রমতে ডেকেও আমরা দেখা পাই না, সীতা কীভাবে এত সহজে তাঁর দেখা পেল?’ সীতা তখন রামকে বললেন ‘আমার কথা বিশ্বাস না হয়, আপনি ফল্গুনদী, অগ্নি, গরু বা কেতকি ফুলকে জিজ্ঞেস করুন।’ রাম ওদের জিজ্ঞেস করলে, ওরা পরিষ্কার বললেন ‘ওরা কিছুই দেখেননি।’
সীতা আর কোনও উপায় না দেখে করুণ মুখে ফিরে গিয়ে রান্না করা শুরু করলেন। রাম এবং লক্ষ্মণ স্নান সেরে বসলেন শ্রাদ্ধের কাজে। কিন্তু কাজের মধ্যেই দৈববাণী হল ‘আমাদের আবার কীসের উদ্দেশ্যে ডাকছ? আমরা তো সীতার হাত থেকে পিণ্ড পেয়ে যারপরনাই খুশি হয়েছি এবং আমাদের আত্মার শান্তি হয়েছে।’ রাম এসব শুনে বললেন ‘আপনারা কারা? আপনাদের একথা আমি মানি না।’ বলেই আবার তিনি শ্রাদ্ধের কাজ শুরু করলেন। এই দেখে সূর্য সেখানে এসে উপস্থিত হয়ে, রামকে সব ঘটনা খুলে বললেন। রাম তখন সীতাকে এসে বললেন ‘আমাকে তুমি ক্ষমা কর প্রিয়ে। তোমাকে পেয়ে আমি সত্যিই ধন্য। তোমার মতো পুত্রবধূর জন্য আজ শুধু আমি নই, আমার পূর্বপুরুষরাও গর্বিত।’
সীতা সব শুনে খুশি হলেন। কিন্তু তিনি মনে মনে চারজন সাক্ষীকে মিথ্যে সাক্ষী দেওয়ার জন্য ক্ষমা করতে পারলেন না। তাই তিনি ফল্গুনদীকে অভিশাপ দিলেন ‘আজ থেকে তোমার জল মাটির নীচ দিয়ে বইবে।’ অগ্নিকে বললেন ‘দেবতা হয়েও তুমি মিথ্যে বলেছ, তাই আজ থেকে তুমি সর্বভুক হবে।’ গরুকে বললেন ‘আজ থেকে তোমার মুখের অংশ অপবিত্র হল।’ আর কেতকি ফুলকে বললেন ‘এরপর থেকে শিবের পুজোয় তুমি আর কোনও কাজে লাগবে না।’
সেই থেকেই ফল্গুনদী অন্তঃসলিলা, অগ্নি সর্বভুক, কেতকি ফুল শিব পুজোর অযোগ্য এবং গরুর মুখ অপবিত্র আর লেজ পবিত্র হল দেশে।
ঋণ: পুরাণের গল্প, কুলদারঞ্জন রায়। চলিত করেছেন জয়তী ভট্টাচার্য।