Categories
খেলার মাঠ |

বিখ্যাত ন্যাটওয়েস্ট ফাইনাল

658 |
Share
| ৭ জুলাই, ২০২১
বিশ্বজিৎ দে

রেডিও উপস্থাপক ও ক্রীড়া উৎসাহী

চিত্র সৌজন্য: PTI

ক্রিকেটের মক্কা ইংল্যান্ডে ভারত গিয়ে বারবার কামাল দেখিয়ে এসেছে। লর্ডসের ব্যালকনিতে তৈরি হয়েছে ইতিহাস।

২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল অবধি ইংল্যান্ডের মাঠে পরপর অনুষ্ঠিত হয়েছে ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ। এটি একটি ‘One-day series’। এই সিরিজের বিশেষত্ব ছিল এই যে, এটি ছিল ত্রিদেশীয় সিরিজ। ২০০০ সালে প্রথমবার এই সিরিজে অংশগ্রহণ করেছিল ইংল্যান্ড, জিম্বাবয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ২০০২ সালে এই টুর্নামেন্টের আয়োজক-দেশ ইংল্যান্ডের সঙ্গে ভারত আর শ্রীলঙ্কাও এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল। এই সিরিজটি আরও বেশি স্মরণীয় হয়ে আছে ভারতের ক্ষেত্রে কারণ ২০০২ সালে তারা এই ট্রফি জয় লাভ করে অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলির নেতৃত্বে। শুধু তো জেতা নয়, একটি নাটকীয় ফাইনালের পরতে পরতে এমন সব মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল, যার জন্য এই ম্যাচটি হয়ে ওঠে সর্বকালের সেরা একদিনের ম্যাচ।

১৩ জুলাই ২০০২ সালে লর্ডসের মাঠে ভারত বনাম ইংল্যান্ড ফাইনালে মুখোমুখি হয়। টসে জিতে ইংল্যান্ড প্রথমে ব্যাট করে। তাদের স্কোর হয়ে দাঁড়ায় ৩২৫/৫। ইংল্যান্ডের দলের ক্যাপ্টেন নাসের হোসেন করেন ১১৫ রান আর গোড়াপত্তনকারি ব্যাটসম্যান মারকেস টেস্কথিক করেন ১০৯ রান। এই দুজনের শতরানের সঙ্গে অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ করেন ৩২ বলে ৪০ রান। ভারতীয় বোলাররা সেদিন ওয়াইড নো-বল ইত্যাদি মিলিয়ে ৩১ রান একস্ট্রা দিয়ে দেন। ভারতীয়দের হয়ে জাহির খান ৬২ রান দিয়ে ৩টি, আশিস নেহেরা ৬৬ রান দিয়ে ১টি আর অনিল কুম্বলে ৫৪ রান দিয়ে ১টি উইকেট নেন।

এখন ক্রিকেটে আকছার তিনশো রান করতে দেখা যায়; কিন্তু ওই ২০০০ সালের শুরুর দিকে যদি কোনও দল তিনশোর বেশি রান করত, তাহলে ধরে নেওয়াই যেত যে ম্যাচ ওই দলের হাতের মুঠোয়। এমন অবস্থায় শুরু হয় ভারতীয়দের ব্যাটিং। সেওয়াগ এবং সৌরভ ওপেনিং করেন আর ১৪.৩ ওভারে ১০৬ রান তোলেন। রান তাড়া করার একটা ভিত তৈরি হয়ে যায়। প্রথমে আউট হন সৌরভ ৬০ (৪৩ বল), এরপর মাত্র ৪০ রানের মধ্যে আরও ৪টি উইকেট পড়ে যায়। যখন সচিন আউট হন তখন ভারতের স্কোর ১৪৬-৫। ইংল্যান্ড ধরেই নেয় যে তারা এই ম্যাচ জিতে গেছে। এখান থেকেই শুরু হয় জেদ দিয়ে স্বপ্নপূরণের লড়াই। স্বপ্নের পার্টনারশিপ তৈরি হয় যুবরাজ সিং আর মহম্মদ ক্যাইফের মধ্যে।

তারা দুজনে ৪১.৪ ওভারে ভারতের স্কোরকে নিয়ে যান ২৬৭-৬-এ। যখন যুবরাজ আউট হন ৬৯ রানে (৬৩ বল) তখন ভারতের দিকে ম্যাচের পাল্লা বেশ কিছুটা ভারি। ক্যাইফ হরভজনের সঙ্গে ব্যাট করে ভারতের রানকে নিয়ে গেলেন ৩১৪-৭ (৪৭.৩ ওভার) আর কুম্বলের সাথে ব্যাট করে ৩১৪-৮ (৪৭.৫ ওভার)। তখনও ভারতের বাকি ১২ রান। এই রানগুলো উঠে আসে ক্যাইফ আর জাহির খানের যৌথ ব্যাটিং-এর মধ্যে দিয়ে। জয়ের জন্য শেষ রান আসে জাহির খানের ব্যাট থেকে; আর শেষ অবধি যিনি এই ম্যাচকে টেনে নিয়ে যান তিনি হলেন মহম্মদ ক্যাইফ, তিনি অপরাজিত থাকেন ৮৭ রানে (৭৫ বল)।

ওই জেতার রানগুলো আসার সাথে সাথেই মাঠে শুরু হয়ে যায় বিজয় উৎসব। সবাইকে প্রায় বিস্মিত করে দিয়ে ভারতীয় ক্যাপ্টেন সৌরভ লর্ডসের ব্যালকনিতে ওড়াতে শুরু করেন নিজের গা থেকে খুলে ফেলা ভারতীয় দলের নীল জার্সি। গোটা দেশ এবং ক্রিকেট দুনিয়া ওই দিন দেখেছিল এক ক্যাপ্টেনের স্পর্ধা, সাহস, জেদ আর সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবার প্রবল ক্ষমতা।

এখানে অবশ্যই মনে করাতেই হয়, ওই বছরেই ইংল্যান্ড এবং ভারতের যে সিরিজ হয়েছিল সেখানে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেডেতে শেষ ম্যাচে ভারতের জেতার জন্য টার্গেট ছিল ২৫৬ রান। সেদিন ভারত তাদের টার্গেটে পৌঁছতে পারেনি। ম্যাচ জিতেছিল ইংল্যান্ড। সিরিজ ৩-৩ হয়ে ড্র হয়ে ছিল। সেদিন ম্যাচ জেতার পর ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ সেদিন বিজয়োল্লাস করেছিলেন টি-শার্ট খুলে। সেই দৃশ্য সৌরভ ভোলেননি। দেশের মাটিতে ম্যাচ হেরে বিপক্ষ টিমের খেলোয়াড়ের অমন উল্লাস ছিল প্রায় অপমানসম। তারই প্রতিশোধ হিসেবে লর্ডসের ব্যালকনিতে সৌরভ উড়িয়ে ছিলেন ওই জার্সি।

আসব কিছু স্মৃতিচারণের কথায়। সৌরভ এই ম্যাচের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কিছু মজার ঘটনা উল্লেখ করেন। যেমন লর্ডসের লাঞ্চ পৃথিবীর যে কোনও ক্রিকেট মাঠের লাঞ্চের তুলনায় সেরা। সেই সেরা লাঞ্চ দূরে সরিয়ে রেখে তিনি এবং সেওয়াগ শুধু মাত্র সুপ খান কারণ তাদের ওপেনিং করতে হত। দুজনের মধ্যে এও আলোচনা হয় যে তারা প্রথমে ১৫ ওভারের মধ্যে ১০০ রান তুলবে বাকিটা পরের টার্গেট। সৌরভের সঙ্গে কোচ জন রিটের একটা মনোমালিন্য চলছিল সেই সময়। দুজন দুজনের সঙ্গে প্রায় কথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তবে ম্যাচের শেষে জন যখন সৌরভের কাছে আসেন জয়ের আনন্দ ভাগ করতে তখনও সৌরভ কথা বলতে নারাজ হন। পরে অবশ্য সেই সব সমস্যা মিটিয়ে নিয়ে চলে যুদ্ধ জয়ের উৎসব।

ম্যাচের দুই নায়ক যুবরাজ আর ক্যাইফ যখন অনেক বছর পর একইভাবে স্মৃতিচারণা করেন তখন তাঁরাও আবেগে আর খুশিতে ভেসে যান। দুজনে যখন প্রথম ক্রিজে আসেন তখন তাদের পরিকল্পনা ছিল একটা পার্টনারশিপ তৈরি করার। সেই পার্টনারশিপ যে বিশ্ব ক্রিকেটে সর্বকালের সেরা পার্টনারশিপ হয়ে উঠবে তা তারা নিজেরাও কল্পনা করতে পারেন নি। যুবরাজ এবং ক্যাইফ ১২১ রানের একটি রেকর্ড পার্টনারশিপ গড়েন।

যুবরাজের মনে পড়ে যে সচিনের আউট হবার পরে ইংল্যান্ড দলে জয়ের উৎসব শুরু হয়ে যায়। ইংল্যান্ডের অলরাউন্ডার রুনি ইরানি তো মাঠের মাঝে খেলা চলাকালীন তাদের দেশে আসা এবং ঘোরার জন্য শুভেচ্ছাবার্তাও দিয়ে বসেন ভারতীয় ক্রিকেটারদের।

ছোট গ্রাম থেকে উঠে আসা ক্যাইফ বলে ওঠেন, এই জয়ের পর তাঁকে তাঁর গ্রামের বাসিন্দারা হুডখোলা জিপে বসিয়ে গ্রাম প্রদক্ষিণ করান। তাঁর কাছে এই সম্মান ছিল আশাতীত। আর সৌরভ! তিনি সেই ম্যাচের কথা বলতে গিয়ে বলেন, মানুষ শুধু ওই জার্সি ওড়ানোর দৃশ্যটি মনে রেখেছে, কিন্তু তার আগে যে উনি সেওয়াগের সঙ্গে ১৫ ওভার ব্যাট করে গুরুত্বপূর্ণ ৬০ রান করেন সেটার কথা আজ আর তেমন ভাবে বলে না!

এর আগে ওই লর্ডসের ব্যালকনিতে ১৯৮৩ সালে কপিলদেব বিশ্বজয় করেছিলেন শক্তিশালী ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে। সেবার গোটা ভারতীয় টিমের কাছে সে জয় ছিল অপ্রত্যাশিত। তবুও সেই বিজয়োল্লাসের মধ্যে ছিল উচ্ছ্বাস, উন্মাদনা আর বিশ্বজয়ের স্ফূর্তি। তবে ২০০২ সালে লর্ডসের একই মাঠ এবং ব্যালকনিতে যে বিজয় উৎসব সেই সময় গোটা দেশ দেখল, তা ছিল নতুন ভারতের তাজা রক্তের স্ফুলিঙ্গ। এক অধিনায়কের সামনে থেকে লড়াই করার সাহস। লর্ডসের ব্যালকনি মিলিয়ে দিয়েছে ক্রিকেটের দুই প্রজন্মকে। চিনিয়ে দিয়েছে নতুন প্রজন্মের ভারত অধিনায়ককে যার ছিল বিপক্ষ শিবিরে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেবার স্পর্ধা। সেই সাহস, স্পর্ধা, ক্লাস আর টেকনিকের অপর নাম সৌরভ। ভারতের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক। সবার দাদা— আর বাংলা ও বাঙালির অনুপ্রেরণা।