Categories
খেলার মাঠ |

স্যাফ গেমস ’৮৭

871 |
Share
| ১৮ এপ্রিল, ২০২১
বিশ্বজিৎ দে

রেডিও উপস্থাপক ও ক্রীড়া-উৎসাহী

স্যাফ গেমসের জন্য প্রকাশিত বিশেষ কার্ড; চিত্র সৌজন্য: www.collectorbazar.com

১৯৮৭ সালের প্রাক শীতের দুপুর। কলকাতার সল্টলেক স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক সূচনা হল তৃতীয় সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন গেমসের বা স্যাফ গেমসের। এর আগে বেশ কিছু বিশ্বমানের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে শহর কলকাতায়, তবে এই গেমসকে ঘিরে যে উন্মাদনা এবং উচ্ছ্বাস চোখে পড়েছিল তা ছিল মনে রাখার মতো। বাংলা আবার সাক্ষী রইল আরও এক ক্রীড়াযজ্ঞের।

দ্য এশিয়াড বা এশিয়ান গেমস অর্গানাইজেশন তৈরি করা হয় বিশ্ব অলিম্পিক গেমসের তত্ত্বাবধানে, যাতে এশিয়ার দেশগুলির খেলার মান উন্নয়ন হয় এবং দেশগুলির মধ্যে সৌহার্দ্য বজায় থাকে। তারই ফলস্বরূপ এশিয়ান গেমস তৈরি হয় এবং ধীরে ধীরে চিন, জাপান এবং কোরিয়ান দেশগুলি খেলার জগতে নিজেদের পারফরমেন্স ভাল করতে থাকে এবং অলিম্পিকের মতো মঞ্চে তারা তাদের দক্ষতা প্রদর্শন করতে থাকে।

১৯৭৮ সালে ব্যাংককে এশিয়ান গেমস আয়োজিত হয়। সে বছর সাউথ এশিয়ান দেশগুলি তেমন ভাল পারফরমেন্স উপহার দিতে পারেনি। সেখান থেকেই এইসব অঞ্চলের দেশগুলির খেলার মান উন্নয়নের জন্য একটি সংগঠন তৈরির প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, মালয়েশিয়া এবং মালদ্বীপের মতো দেশগুলি নিয়ে তৈরি হয় সাউথ এশিয়ান ফেডারেশন গেমসের এই সংগঠন। নেপাল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এই স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। প্রথম স্যাফ গেমস অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে। এরপরের বছর ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে আয়জিত হয় দ্বিতীয় স্যাফ গেমস। সে বছর আরও একটি সিদ্ধান্তে আসা হয় যে, এই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা প্রতি বছর আয়োজন করা হবে না, বরং প্রতি দু’বছরে একবার এই ক্রীড়াযজ্ঞের আয়োজন করা হবে। সেই বিষয়টি মাথায় রেখে ১৯৮৭ সালে কলকাতায় বসে তৃতীয় স্যাফ গেমসের আসর।

এশিয়ার সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম কলকাতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে উদ্বোধন এবং সমাপ্তি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ১৯৮৭ সালে ২০ নভেম্বর থেকে ২৭ নভেম্বর এই আট দিনব্যাপি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলতে থাকে।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দেশের সেই সময়কার তাবড় তাবড় ব্যক্তিত্বরা। এবং প্রায় ১২০০০০ ক্রীড়া প্রেমী দর্শকও সেদিন উপস্থিত ছিলেন এই অনুষ্ঠানে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগের দিন ঢাকা থেকে খেলার মশাল এসে পৌঁছয় কলকাতায়। ঐ মশাল রাখা হয় নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। ১৯৮৬ সালের সিওল এশিয়ান গেমসে চারটি সুবর্ণপদকজয়ী ভারতীয় রানার পি.টি.ঊষা সকল প্রতিযোগীদের হয়ে স্পোর্টিং স্পিরিটে খেলা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার শপথ নেন।

১৯৮৭ সালের স্যাফ গেমসে মোট দশটি খেলার বিভাগ ছিল যেখানে অংশগ্রহণকারীরা তাদের সেরাটুকু প্রদর্শন করেন। প্রত্যেক খেলার জন্য নির্ধারিত করা হয়েছিল আলাদা আলাদা জায়গা। যেমন যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে অ্যাথলেটিক্স এবং ফুটবল, সুভাষ সরোবর সুইমিং পুলে সাঁতার, ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে টেবিল টেনিস আর ওয়েট লিফটিং, কাবাডি অ্যাসোসিয়েশন গ্রাউন্ডে কাবাডি, নেতাজি ইন্দোর স্টেডিয়ামে ভলিবল, বাস্কেট বল, বক্সিং এবং কুস্তি।

সেরার সেরা দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল ভারত। পদক তালিকায় ভারত মোট ১৫৫টি পদক পায়। তার মধ্যে ৯১টি সোনা, ৪১টি রুপো আর ১৯টি ব্রোঞ্জ। দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে পাকিস্তান। ১৬টি সোনা নিয়ে তারা পায় মোট ৬৩টি পদক এবং তৃতীয় স্থান অর্জন করে শ্রীলঙ্কা। তাদের মোট পদক সংখ্যা ছিল ৩৫, যার মধ্যে তারা পায় ৪টি সোনা। এছাড়া বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভুটান যথাক্রমে অর্জন করে চতুর্থ, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ স্থান।

এই বছরের স্যাফ গেমসের সেরা আকর্ষণ ছিল ম্যাসকট ‘বাবু’— বাংলার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। পৃথিবী বিখ্যাত এই রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বাঙালির ধুতি এবং পাঞ্জাবি পরিয়ে একটি মজার বেশে সামনে আনা হয়, যা সকল বয়সের মানুষের কাছে হয়ে উঠল বিপুল জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য। মনে আছে আমরা যারা ছোট ছিলাম তাদের জন্য ‘বাবু’ ম্যাসকটটি ছিল বিরাট আকর্ষণের। ছোটবেলায় আমরা অনেকেই এই ৮৭’র স্যাফ গেমসের ম্যাসকট আঁকার খাতায় বহুবার এঁকেছি।

সমাপ্তি অনুষ্ঠানের দিন যুবভারতী স্টেডিয়ামে ছিল মানুষের সাথে মানুষের মিশে যাওয়ার এক সৌহার্দ্যপূর্ণ ছবি। সকল দেশের খেলোয়াড়রা একে অপরের সাথে বিনিময় করেছিলেন ভালবাসা এবং আন্তরিকতা। উঠে এসেছিল বিশ্বভ্রাতৃত্বের এক উজ্জ্বল চিত্র। একদম মাঠের মাঝামাঝি ভারতীয় বায়ুসেনার হেলিকপ্টার থেকে নেমে আসে আট জন প্যারাশুটার্স। মাঠ জুড়ে চলছিল গ্রাম্য যুবক যুবতিদের নাচ এবং গান। মোটর সাইকেল আরোহী সেনানিরা প্রদর্শন করছিল রোমাঞ্চকর খেলা আর একদম শেষে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন জুড়ে ছিল আতস বাজির খেলা আর রোশনাই।

কলকাতা মহানগরী সাক্ষী থেকেছে খেলা-সংক্রান্ত অসংখ্য ঐতিহাসিক ঘটনার। ১৯৮৭ সালের স্যাফ গেমস তেমনই একটি বৃহৎ ক্রীড়াযজ্ঞ যেখানে খেলার মাধ্যমে নানা দেশের মানুষের মেলবন্ধন হয়েছে। কলকাতাবাসী হিসেবে এ আমাদের কম গর্বের বিষয় নয়!

ঋণ: Wikipedia