― কোথায় যাবে?
― দূরে।
― দূরে বলতে কোথায়?
― দূরে বলতে দূরে।
― কত দূরে?
― তা তো জানি না।
― তাহলে তুমি কোথায় যাবে? কতদিন ধরে যাবে?
―আমি জানি আমি দূরে যাব। কতদূরে যাব তা জানি না। কিন্তু যাব।
― আর যেতে যেতে যদি কোথাও না পৌঁছাও?
― তাহলেও যাব।
গাছটা তাকিয়ে রইল রোদ্দুরের দিকে। রোদ্দুরের সমস্যা এই, সে রোজ আসে, রোজ জড়িয়ে ধরে, কিন্তু থাকে না। যদি সে থাকত, যদি তার স্পর্শ থেকে যেত মাটিতে, শরীরে, মনের ভিতর, তাহলে হয়তো, গাছটাও একদিন হাঁটতে পারত। গাছটা মাথা ঝোঁকায়। একগুচ্ছ শুকনো পাতা খসে পড়ে।
― রোদ্দুর এদিকে ওদিকে সরে যায়।
― তুমি কি এখনই সরে যাবে নাকি?
― না, না, আমি তো রোজ যাব যাব বলিই, কিন্তু যেতে পারি কই? যখন বিকেল এসে আমাকে টেনে নিয়ে যায়, তখন আমার সারা শরীর জুড়ে ক্লান্তি। আর কোথাও যেতে পারি না। ঘুমিয়ে পড়ি।
― কোথায় ঘুমোও?
― আছে একটা গুহা। সেখানে আমি যখন ঢুকে পড়ি, তখন সব অন্ধকার হয়ে যায়। আকাশে তখন ঝকমকিয়ে ওঠে নক্ষত্র। তুমি দেখনি?
― দেখেছি। কিন্তু তখন আমিও ঘুমচোখে তাকাই। অবশ্য রোজ যে ঘুম আসে, তা নয়। মাঝেমাঝে সারা রাত জেগে থাকি। তখন তোমার কথা ভাবি। কোথায় আছ তুমি? অন্য কোনও গাছের কাছে চলে গেলে নাকি?
আরে, বোকা মেয়ে, অন্য কোনও গাছ কোথায় বলতে পার? মানুষ তো সব কেটে সাফ করে দিয়েছে।
আর কোথাও নেই আমার মতো গাছ?
আমি অনেক খুঁজি জানো। জানো তো আমি সর্বত্র চলে যাই। মানুষ আমাকে ভয় পায়। আমাকে আটকানোর জন্য মানুষ কত কীই না করেছে। মাটির নীচে এখন থাকে নাকি। সে তো থাকতেই হবে। অক্সিজেন নেই তো।
অক্সিজেন কে গো?
এই যে, যাকে তুমি এখন জন্ম দিচ্ছ। এই যে দ্যাখো, আমি যখন থাকি, তখন তুমি আমাকে শুষে নাও। আর তোমার আমার সন্তান জন্ম নেয়। কত সন্তান বলো। পাতা, ফুল, ফল, আর অক্সিজেন। আমি তো ভাবি, কবে তোমার থেকে আরেকটা গাছ জন্ম নেবে! কবে সেই গাছ থেকে আরও একটা গাছ। এভাবে কবে গাছে গাছে ভরে যাবে।
‘ও আমাকে বুঝি আর পছন্দ নয়?’
‘সেকি, আবার বোকামি। তুমি দেখছি মানুষের মতো বোকা। মানুষও শুধু আমি, আমি আমি করে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করতে করতে শেষ পর্যন্ত আর কাউকে সহ্য করতে পারেনি। মানুষের আর ক’জন বেঁচে আছে বলো। ওই যে ডানদিকে দেখছ দূরে পাহাড়, তারপরেই আছে একটা মৃত শহর।’
‘মৃত শহর?’
‘হ্যাঁ, মৃত। কারণ সেখানে মানুষ নেই, পাখি নেই, জল নেই, তোমার মতো একটিও গাছ নেই। আমাকে তো সর্বত্র যেতেই হয়। তাই আমি সেই মৃত শহরের আনাচে কানাচে খুঁজেছি। কেউ নেই। কত চেষ্টা করেছি, যাতে একটা অন্তত গাছ জন্মায়।’
‘বুঝেছি, তারপর তুমি তার কাছেই যাবে, আমার কাছে আর আসবে না।’
‘না, সোনা, এমনটা তো হয় না। তুমিই তো আমার একমাত্র গাছ। আমি তো তোমার কাছেই আমার সবকথা বলি। চিরকাল বলব। কিন্তু আমার আর তোমার পরে? তারপর? ভেবে দেখেছ? মানুষ এসব ভাবেনি বলেই, আজ তারা মাটির নীচে লুকিয়ে লুকিয়ে বাঁচে। খোলা মাঠে ঘুরে বেড়াতে পারে না। বুক ভর্তি হাওয়া নিতে পারে না। আমাকেও গায়ে জড়িয়ে নিতে পারে না। কত ডাকি ওদের, আয় আয় আয়। কিন্তু আসে না। আমাকে ভয় পায়।’
‘কেন? তুমি তো খুব শান্ত। বরং তুমি যখন থাক না, তখনই অন্ধকার এসে ঘিরে ধরে। আর অন্ধকার খুব অসুস্থ। কেমন শীত, ঠান্ডা, যেন আয়ু নেই। আচ্ছা, অন্ধকার কি মৃত? তাহলে অন্ধকার কথা বলে না কেন?’
‘না, না, একদম এসব ভেবো না। অন্ধকার না থাকলে আমি তো জন্ম নিতে পারতাম না। অন্ধকার আমারও মা। অন্ধকার তো আমায় জন্ম দিয়েছে, তোমার কাছে আসবে বলে। একা অন্ধকার তো কিছু করতে পারে না। এই যে মহাকাশ দেখছ, সবই তো অন্ধকার। কিন্তু ওই যে দূরে দূরে কোটি কোটি নক্ষত্র, কেন দেখতে পারছ? আলো আছে বলে তাই না? অন্ধকার ওদের জন্ম দিয়েছে। মানুষ এখন সেই অন্ধকারের নীচেও আসতে পারে না। মানুষ নিজের অন্ধকার তৈরি করে তার ভিতর শুয়ে থাকে, বসে, হেঁটে চলে বেড়ায়। সেই অন্ধকার কিন্তু মানুষের অন্ধকার। আর রাত্রির যে অন্ধকার দেখছ, সে আমার মতোই একজন।’
‘মানুষের জন্য আলাদা অন্ধকার আছে?’
‘হ্যাঁ, তো। আর সে অন্ধকার খুব জটিল, খুব অসহায়। সেই অন্ধকার আমাদের কারো কাছে আসে না। তোমার কাছেও আসে না। কিন্তু সেই অন্ধকারে থাকতে থাকতে মানুষও তার মতো হয়ে ওঠে। তখন সে তোমায় আমায় মারতে আসে।’
‘কিন্তু তুমি তো চলে যাবে।’
‘আমার স্বপ্ন আমি শুধু যাব। কিন্তু কোথায় যাব তা জানি না, তাই তো যাইনি। কারণ আমার অনেক দায়িত্ব আছে।’
‘কেমন দায়িত্ব শুনি।’
‘এই যে, তোমার আরও ছানাপোনা হবে। আরও একটা গাছ হবে। বাতাসে অক্সিজেন দেবে তুমি। তার জন্য আমাকে তোমার কাছে থাকতেই হবে। তোমাকে আরও অনেক বেশি সবুজ করে তুলব আমি।’
‘কিন্তু জল যে খুব কম দেখা করতে আসে।’
‘জলকে আমরা দু’জনে মিলেই ডাকব।’
‘ডাকলেই কি আসবে?’
‘তা জানি না যে, জল খুব মুডি।’
‘জল যদি না আসে, তাহলে তো আমি মরেই যাব।’
‘কিন্তু আমরা যদি একসঙ্গে আকাশের দিকে চেয়ে জলকে ডাকি, তাহলে জলও চলে আসবে। তারপর, হ্যাঁ, তারপর তো তুমি এখনও দেখনি। বৃষ্টি যারা দেখেছে, তারা জানে বৃষ্টি কী।’
‘বৃষ্টি?’
‘হ্যাঁ, বৃষ্টি পড়লে আকাশ থেকেও জল পড়বে, আর মাটিও ভিজে যাবে। তখন দেখবে মাটিও তোমার বন্ধু।’
‘বন্ধু তো বটেই, আমি মাটির কাছে ঋণী।’
‘মাটির কাছে আমরা কে ঋণী নয় বলো তো।’
‘কিন্তু তোমার কথা আলাদা। তুমি তো আলো। এই পৃথিবীরই নও তুমি। ওই সূর্যের।’
‘হ্যাঁ, তা বটে, কিন্তু . . .আমি যে তোমার মতো আলো হতে চাই গাছ।’
‘সেটা তো আর সম্ভব নয়।
এর জন্য দুঃখ হত আগে। কিন্তু এখন আর হয় না। অভ্যস্ত হয়ে গেছি দুঃখ পেতে পেতে।’
‘তুমি তো আলো। তুমি তো দুঃখকেও আলোকিত কর।’
‘করি তো।’
‘তাহলে তুমি যখন দুঃখ পাও, তখন তোমায় কে আলো দেয়?’
‘হাহাহাহাহাহা, আলো যখন দুঃখ পায়, তখন তো একজনই আছে গো, যে আমায় আলো দেবে।’
‘কে সে?’
‘তুমি।’
‘এইটা মিথ্যে বলছ।’
‘না, মিথ্যে বলব কেন? একটা সময় জানো তো, যখন অসংখ্য গাছ ছিল, তখন সবাইকে আমি আলো দিতাম। আর আমি যখন দুঃখ পেতাম, তখন ঐ গাছের তলায় আমার আলো গুঁড়ি মেরে বসে থাকত। কিছুতেই যাবে না সে। আস্তে আস্তে বিকেল এসে তাকে ডাকত। চোখের জল মুছিয়ে দিত। তারপর তাকে সঙ্গে নিয়ে চলে যেত দিগন্তের কাছে।’
‘দিগন্ত কে?’
‘দিগন্ত হচ্ছে এমন এক তরুণ, যে কখনও স্থির হয়ে থাকতে পারে না। ধরো, তুমি গেলে দিগন্তের কাছে অনেকদিন ধরে যেতে যেতে যেতে, কিন্তু যখন গিয়ে পৌঁছলে, তখন দিগন্ত আরও দূরে সরে গেছে। দিগন্ত সবসময় অধরা।’
গাছ কিছুক্ষণ ভাবল। কোথা থেকে যেন একটা দমকা হাওয়া এল। গাছটা শিউড়ে উঠল।
‘আলো, আমি তো একথা ভাবিই নি।’
‘কী কথা?’
‘আমি তো কোথাও যেতে পারি না, পারবও না।’
‘তাতে কী?’
‘আমি দিগন্তের কাছে যাব কী করে?’
‘আরে বোকা, তুমিও একটা দিগন্ত।’
‘আমি? কী করে?’
‘ধরো তুমি এখান থেকে দিগন্তকে দেখছ, দিগন্তও আসলে তোমাকেই দেখছে। এর মানে হল, তুমিও তার কাছে একটা দিগন্ত। এমন এক দিগন্ত, যে নিজেই একটা গাছ।’
‘এত জটিল করে কেন বলো? আসল কথা হল, আমি দিগন্তকে দেখছি, দিগন্তও আমাকে দেখছে। তাই আমিও দিগন্তের কাছে দিগন্ত।’
‘হ্যাঁ, তার মানে তোমাকে দেখেও কেউ ভাবছে আমার মতো।’
‘কী ভাবছে?’
‘এই হাঁটার কথা। আমি যেমন ভাবছি, যাব।’
‘তুমি কোথাও যাবে না। তুমি আমার কাছেই থাকবে। আস্তে আস্তে এখানে একটা বাগান হবে। পাখি আসবে। আকাশ থেকে জল পড়বে।’
‘হ্যাঁ, আর নদী জন্ম নেবে। তাতে থাকবে প্রচুর মাছ।
তুমি অন্য গাছেদের পেয়ে আমার কথা ভুলে যাবে না তো?’
‘কখনও না। আমি আর তুমিই তো তাদের জন্ম দেব। তারপর আমাদের সেই ছোট্ট রাজ্য হয়ে উঠবে প্রচুর সবুজ। তারা সবাই হবে আমাদের সন্তান। অন্ধকারেও কেউ ভয় পাবে না আর। অন্ধকার যখন নিজে ঘুমিয়ে পড়বে, তখন আমি উঠে পড়ব। সবাইকে জাগিয়ে দেব।’
‘আমি কি তখন বুড়ি হয়ে যাব?’
‘আরে, আমিও তো তখন বুড়ো হব।’
‘আলোও বুড়ো হয়?’
‘হয়।’
‘আচ্ছা, মানুষ যদি তার আগে এসে আমাকে কেটে ফেলে?’
আলো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর আস্তে আস্তে আলো তার বাড়তে লাগল।
― থামো থামো। তুমি এত রেগে গেলে তো আমি পুড়ে যাব।
― রেগে যাব না? মানুষ এভাবে সারা পৃথিবীর সব গাছকে মেরে ফেলেছে। আগে যখন গাছ ছিল, বাতাস ছিল, অক্সিজেন ছিল, তখন আমাকে লোকেও এত ভয় পেত না। মেঘ করত, বৃষ্টি পড়ত। মেঘের ছায়ায় আর আমার হালকা আলোয় মানুষ হেঁটে যেত। তারপর সব বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। মেঘ করল না আর। সে কী কুয়াশা। কালো ধোঁয়ার কুয়াশা। আমিও সেই কুয়াশায় ঢুকতে পারতাম না আর। দমবন্ধ হয়ে আসত। কত গাছ মরে গেল। কত মানুষ মরে গেল। কিন্তু মানুষ শিক্ষা পেল না। এখন তুমি এসেছ। অনেকদিন পর। ওরা তোমার ক্ষতি করতে চাইলে আমি এই পৃথিবীটাকেই ধ্বংস করে দেব। সব পুড়িয়ে দেব।
― তুমি এত রাগ কোরো না প্লিজ। আরে, মানুষ তো ভয়ে বেরোয় না আর বাড়ি থেকে। ভাইরাস চারিদিকে। আর আসবে না আমার কাছে কেউ। আমাকে মারবে না কেউ। তুমি নিশ্চিন্ত থাক। আমরা আবার সবুজের রাজ্য গড়ে তুলব। তুমি শুধু আমাকে কথা দাও, আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না।
― যাব না, যাব না, যাব না।
― কিন্তু তুমি যে বললে, তোমার শুধু যেতে ইচ্ছে হয়।
― সে তো হয়। কিন্তু আমার সামনে এখন অনেক বড় কাজ। কোথায় আর যাব। আগে সবাই একটু সবুজ হয়ে উঠুক। জল আসুক। বৃষ্টি আসুক। নদী কুলকুল করে বয়ে যাক। পাখিরা জন্মাক। মানুষ গর্ত থেকে বেরোক। তারপরে আমরা সবাই যাব। অনেক রাস্তা পেরতে পেরতে যাব। কিন্তু ততদিন আমার অনেক কাজ। তোমার সঙ্গে থাকতে হবে আমাকে।
আনন্দে একটা নতুন পাতার কুঁড়ি বেরল গাছের।
― ঐ দ্যাখো, বলতে না বলতেই . . .
গাছ আর আলো একে অপরের দিকে চেয়ে রইল। যেন বহুজীবন ধরে তারা তাকিয়েই আছে।