বিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রহরে বিশ্বপ্রকৃতির উদার প্রাঙ্গণে ছেলেদের মুক্তি দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ তৈরি করলেন শান্তিনিকেতন-বিদ্যালয়।
শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী বয়ে নিয়ে চলেছে রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনে কর্মসাধনার পরিচয়। এই সাধনা তাঁর মতে, মনুষ্যত্বসাধনা। এই সাধনায় যাঁরা স্থপতি, এই সহযোগীর দল, এঁরা আশ্রমের সৃষ্টিকার্যে নিজেদের সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। এই সঙ্গী কর্মী এবং বন্ধুদের কথাই ধরা রয়েছে ‘শান্তিনিকেতনের গোড়ার কথা’য়।
আজ ক্ষিতিমোহন সেনের কথা।
‘আমরা ছিলাম মাটির তাল, গুরুদেব আমাদের হাতে ধরে গড়েপিটে তৈরি করে নিয়েছেন— তিনি না থাকলে আমরা কিছু হতাম না’। এ তো সেই সময়ে সকলেরই মনের কথা। শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম এবং বিশ্বভারতীর সঙ্গে যাঁরা যুক্ত ছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকে মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য স্নেহ সহযোগিতা। কিন্তু শাস্ত্রজ্ঞ-পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন স্বয়ং যখন এই উক্তি করেন, তখন মনে হয়, ক্ষিতিমোহন যেমন রবীন্দ্রনাথের আবিষ্কার, রবীন্দ্রনাথও তেমনি ক্ষিতিমোহনের কাছে দেখা দিয়েছিলেন এক মহাদেশ আবিষ্কারের বিস্ময়ের মতো। ক্ষিতিমোহন সেন— মুজতবা আলী যাঁকে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ ও বিধুশেখর শাস্ত্রীর মাঝখানের এক সেতু। পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায় একটি অবিস্মরণীয় মন্তব্যে লিখেছেন, ‘শান্তিনিকেতন আশ্রম ও বিশ্বভারতী পরিচালনার ক্ষেত্রে বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের দুই বাহুস্বরূপ— বুদ্ধদেবের দুই প্রধান শিষ্য সারিপুত্ত এবং মৌদ্গল্যায়নের অনুরূপ রবীন্দ্রনাথের দুই শিষ্য ছিলেন বিধুশেখর ও ক্ষিতিমোহন’।
ক্ষিতিমোহন ছিলেন বিশ্বভারতীর গুণিজনসভার প্রধান সভাসদ। যাঁকে দ্বিজেন্দ্রনাথ বলেছিলেন,
‘একা-নব-রতন ক্ষিতিমোহন
ভকতি-রসের রসিক
কবীর-কামধেনু করি দোহন
তোষেণ তৃষিত পথিক’।
এক সুবিশাল জ্ঞানভাণ্ডার নিয়ে তপস্বীর মতো বিচরণ করতেন এই মানুষটি। কাশীতে তাঁর শৈশব ও যৌবন কেটেছে। টোলে এবং কাশীর কুইনস কলেজে পড়াশোনা করে সংস্কৃতে এম এ পাশ করেন। এই সময়েই বিধুশেখর শাস্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ হয় তাঁর। মধ্যযুগের ভক্ত-সন্তদের বাণী তাঁকে গভীরভাবে আকর্ষণ করেছিল। অত্যন্ত অল্প বয়সেই তিনি সন্তধর্মে দীক্ষা নেন, যোগ দিয়েছিলেন সন্তদের অন্তরঙ্গদলে। ভারতের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেরিয়েছেন, মঠ-মন্দির-আখড়ায় ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছেন দাদু-কবীর-রজ্জবের বাণী। আসাম থেকে গুজরাট পর্যন্ত বিস্তৃত উত্তর ভারতে সন্ত-বাউল-সুফি সাধনার প্রতি তাঁর ছিল দুর্নিবার আকর্ষণ। পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় মধ্যযুগীয় সাধুসন্তদের বাণী সংগ্রহ করে ভারতীয় জীবনসাধনার হারিয়ে যাওয়া এক অধ্যায়কে জাগিয়ে তুললেন। তাঁর লেখা ‘ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা’ বইটির ভূমিকা লেখেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
১৮৯৭ সাল। ক্ষিতিমোহনের বয়স তখন সতেরো বছর। বরিশাল থেকে বিপিন দাশগুপ্ত কাশী গেছেন। তাঁর কাছেই সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথের কবিতা শুনলেন ক্ষিতিমোহন। তাঁর মনের বীণার তন্ত্রীতে বেজে উঠল এক অজানা সুর। ক্ষিতিমোহন লিখছেন, ‘আমি সেই কাব্যের মধ্যে উপনিষদ ও সন্তকবিদের ভাব দেখতে পেলাম। তখন থেকেই রবীন্দ্রনাথ আমার পরমাত্মীয় . . . রবীন্দ্রকাব্য যে কত ভাল লাগত কী বলব? সন্তবাণী তো শত শত বছরের পুরনো আর রবীন্দ্রনাথ জীবন্ত। এতদিন খেতাম আমসী— এখন খেলাম টাটকা ল্যাংড়া-আম। ধন্য হয়ে গেলাম’।
বাউলের জীবনতত্ত্বে আকৃষ্ট হয়ে ক্ষিতিমোহন ঘুরেছেন বাংলার মাঠে-ঘাটে। গ্রামেগঞ্জে। সমাজের অবহেলিত নিম্নবর্গের মানুষদের মধ্যে যে জীবনদর্শন, যে অধ্যাত্মসাধনা তিনি খ্যাপার মতো খুঁজে ফিরেছেন, সেই পরশপাথর ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর জ্ঞানচর্চায়। রবীন্দ্রনাথ ও চারুচন্দ্রের আগ্রহে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘হারামণি’ শিরোনামে নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে অসংখ্য বাউলগান প্রকাশ করেন ক্ষিতিমোহন। এই ঘটনা ১৯১৫ সালের। প্রায় বছর দশেক পরে ‘দ্য ফিলোজফি অফ আওয়ার পিপল’ নামক একটি বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেন। ‘বন্ধু ক্ষিতিমোহন সেনের দুর্লভ বাক্যরত্নের ঝুলি থেকে একদিন এক পুরাতন বাউলের গান পেয়েছিলুম।…ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না’।
ক্ষিতিমোহন রচিত ‘দাদু’ গ্রন্থের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘ক্ষিতিবাবুর কল্যাণে ক্রমে হিন্দুস্থানের আরও কোনও কোনও সাধক কবির সঙ্গে আমার কিছু কিছু পরিচয় হল . . . । . . . ক্ষিতিমোহনবাবু ভার নিয়েছেন বাংলাদেশে সেই লুপ্ত স্রোতকে উদ্ধার করে আনবার’।
তাঁর সংগৃহীত শিখভজন অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ‘বাজে বাজে রম্যবীণা বাজে’, ‘এ হরি সুন্দর’, ‘আজি নাহি নাহি নিদ্রা আঁখিপাতে’। রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন প্রাচীন হিন্দি সাহিত্যের কিছু অসামান্য সৃষ্টির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন ক্ষিতিমোহন। রবীন্দ্রনাথ মন্দিরে প্রতি সপ্তাহে আশ্রমের ছাত্রদের যে ভাষণ দিতেন, সেগুলি সন্তোষচন্দ্র মজুমদার এবং ক্ষিতিমোহন সেন লিখে না রাখলে রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক মনকে আমরা জানতেই পারতাম না। তাঁর মন্দিরভাষণে প্রধান উপাদান ছিল— উপনিষদ, গীতা, বুদ্ধবাণী। ক্ষিতিমোহনের অনুশীলন এবং অনুরাগও ভারতীয় ঐতিহ্যের তিনটি ধারাতেই। একদিকে মধ্যযুগের সন্ত, আউলবাউল, আবার অন্যদিকে বেদ উপনিষদ। বাংলাভাষায় অসংখ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। তেমনই হিন্দি এবং গুজরাতি ভাষাতেও রয়েছে তাঁর অনুবাদ ও মৌলিক রচনা।
ক্ষিতিমোহন কবে এসে পৌঁছলেন শান্তিনিকেতন? এই তথ্য জানতে হলে একটু পিছিয়ে যাই। কাশীতে বসে রবীন্দ্রনাথের কাব্যপাঠে মুগ্ধ ক্ষিতিমোহন সামনাসামনি কবিকে দেখতে সোজা চলে এলেন কলকাতায়। ১৯০৪ সাল। মিনার্ভা থিয়েটারে কবি ‘স্বদেশি সমাজ’ প্রবন্ধ পড়বেন। ভিড়ের চাপে সেই সভায় ঢুকতেই পারলেন না। আবার প্রতীক্ষা। শেষ পর্যন্ত কার্জন থিয়েটারে দূর থেকে কবির প্রবন্ধপাঠ শুনেই সন্তুষ্ট থাকতে হল।
রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষিতিমোহনের নাম উল্লেখ করেন কালীমোহন ঘোষ। কালীমোহন যখন স্বদেশব্রতে দীক্ষিত হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামে বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছেন, সেই সময় ঘটনাচক্রে ঢাকা জেলার সোনারং গ্রামে দেশের ভিটেতে মায়ের সঙ্গে এসেছেন ক্ষিতিমোহন। পরিচয় এবং অল্প ক’দিনেই ঘনিষ্ঠতা। যোগসূত্র রবীন্দ্রনাথের কবিতা। কালীমোহন শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে বিস্তারিত বিবরণ দেন ক্ষিতিমোহনের। রবীন্দ্রনাথ অজিতকুমার চক্রবর্তীকে লিখছেন, ‘তাঁর সাহিত্যানুরাগ ও বিদ্যাবুদ্ধির কথাতেই যে আমি উৎসাহিত হয়েছি তা নয়, এর মধ্যেও ওই লোকপ্রেমের সংবাদ পেয়েছি, ইনিও ওই বালকটির সঙ্গে গ্রামে কাজ করে ফিরেছেন— লোকসেবার উৎসাহ তাঁর পক্ষে যেরকম স্বাভাবিক সেইটে জেনেই আমি তাঁকে বোলপুরে আবদ্ধ করতে এত উৎসুক হয়েছি। সুশিক্ষিত সুযোগ্য এম এ ডিগ্রিধারী বেতন দিলেই পাওয়া যায়, কিন্তু যে জিনিসটা পুঁথিগত নয়, সেটা আমাদের দেশে কত দুর্লভ তা’ তো জানো’।
১৯০৮ সালের আষাঢ় মাসে ক্ষিতিমোহন আসেন শান্তিনিকেতনে। সেই দিনটির স্মৃতিচারণ করে লেখেন, ‘বোলপুর স্টেশনে যখন নামি, তখন প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। সে আমার জীবনের একটি স্মরণীয় রাত্রি। আর তার পরের দিনের প্রভাতও কম স্মরণীয় নয়। বোলপুর থেকে পায়ে হেঁটে শান্তিনিকেতনের কাছে এসে শুনি উদাত্ত কণ্ঠের গান— ‘আপনি জাগাও মোরে’। দেহলী নামে তাঁর গৃহের দ্বিতলে দাঁড়িয়ে কবি গান ধরেছেন। আজও সেই গানের সুর আমার কানে লেগে আছে’। তিনি কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বিদ্যালয়ের সর্বাধ্যক্ষ হয়ে, অবসর গ্রহণের সময় ছিলেন অস্থায়ী উপাচার্য।
মহাত্মা গান্ধীর কাছে তিনি ছিলেন প্রাচীন ঋষিপ্রতিম, রবীন্দ্রনাথ সমস্ত পৃথিবী ঘুরেও তাঁর সমকক্ষ কোনও জ্ঞানতাপসের সন্ধান পাননি। কোনও একটি গুণ বা বিশেষণে তাঁর পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। পূর্ণানন্দ চটোপাধ্যায় লিখছেন, ‘শুধু শাস্ত্রজ্ঞ-পণ্ডিত ছিলেন না ক্ষিতিমোহন— তিনি ছিলেন মধ্যযুগের সন্তধর্মের প্রচারক, রবীন্দ্রসাহিত্যের রসজ্ঞ সমালোচক, বৌদ্ধধর্মের গবেষক, বাউল-ফকির গানের তত্ত্বসন্ধানী সংগ্রাহক, শব্দতাত্ত্বিক, বৈদিক প্রথা অনুসারী পুরোহিত, উৎসব-অনুষ্ঠানে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্য রক্ষায় নিষ্ঠাবান ব্রতী, সতত জিজ্ঞাসু পর্যটক, ছাত্রদরদী অধ্যাপক, অসধারণ বাগ্মী ও অলৌকিক কথক। তাছাড়া সঙ্গীত, নাটক-অভিনয় ও অলঙ্কার শাস্ত্রে ছিল তাঁর অপরিসীম অনুরাগ। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে রন্ধনশাস্ত্র সবই ছিল তাঁর আয়ত্তাধীনে’। প্রথমদিকে কুলবিদ্যা কবিরাজির চর্চা করবেন বলে কয়েকমাসের জন্য কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আন্তরিক ডাকে সাড়া দিয়ে আবার ফিরে আসতে হয়। পরিহাস করে বলেছেন, ‘কবি রাজি হলেন না, তাই কবিরাজী করা হল না’।
রবীন্দ্রনাথের নানা উৎসব-অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাকে বাস্তব রূপ দিয়েছেন ক্ষিতিমোহন। যথার্থ সহচর হয়ে রূপ দিয়েছেন আশ্রমের নানান উৎসব অনুষ্ঠান। তার মধ্যে বর্ষামঙ্গল ও শারদোৎসবের কথা উল্লেখ করতেই হবে। লোকধর্ম ও সাহিত্যচর্চায় দু’জন হয়ে উঠেছিলেন দু’জনের পরিপূরক। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তিনি যদিচ প্রাচীন শাস্ত্রজ্ঞ তথাপি তিনি অত্যন্ত উদার। তিনি বলেন এই ঔদার্য তিনি শাস্ত্র হতেই লাভ করেছেন। হিন্দুধর্মকে যাঁরা নিতান্ত সংকীর্ণ করে অপমানিত করেন তাঁদের মধ্যে এই দৃষ্টান্ত হয়ত কাজ করবে। অন্তত ছাত্রদের মনকে সংকীর্ণতা মুক্ত করতে পারার পক্ষে ইনি অনেকটা সাহায্য করতে পারবেন’।
আজকের ভারতবর্ষ কি সত্যিই এই সংকীর্ণতা থেকে মুক্তি চায়? ধর্মের বেশে যে মোহ আজ গ্রাস করছে, সেই বিষাক্ত কালনাগিনীর নিঃশ্বাসে কলুষিত সমস্ত বিশ্ব। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সহচরবৃন্দ কিন্তু শান্তিনিকেতন আশ্রমে অন্য উত্তরণের স্বপ্নের বীজ রোপণ করেছিলেন। এটুকুই মনে করানোর দায় আমাদের। তাঁদের অবদান বিস্মৃত হলে ইতিহাসকে অস্বীকার করা হয়। সেই পাপ আমরা রাখব কোথায়?
ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০)