Categories
পুজোর খাতা ২০২৪ |

বেস্ট ফ্রেন্ড

115 |
Share
| ২ অক্টোবর, ২০২৪
নীলেশ নন্দী

চিত্রবিন্যাস/ কমলাকান্ত পাকড়াশী

ঠাকুরদাকে ঘিরে আমরা চার ভাই-বোন বসেছি জমিয়ে গল্প শুনব বলে। পরীক্ষার চাপে অনেকদিন ঠাকুরদার কাছ থেকে কোনো গল্প শোনা হয়নি। আজ থেকে আমাদের স্কুলে গরমের ছুটি পড়েছে। তাই আগামীকাল খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠা বা স্কুল যাওয়ার কোনো তাড়া নেই। এখন শুধু আনন্দই আনন্দ। তবে ঠাকুরদার কাছ থেকে গল্প শোনার আবদার করা পরীক্ষার প্রস্তুতির মতই কঠিন। জানি না এই কয়েক দিনের মধ্যে আর গল্প শুনতে পারব কিনা। তাই আজ আমাদের উচ্ছ্বাসের অন্ত নেই। ঠাকুরদা একটু নড়েচড়ে বসে গল্প বলা শুরু করলেন—
‘আজ তোদের যে ঘটনার কথা বলব, সেই ঘটনাটি ঘটেছিল আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন। আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে প্রায়ই একটা অনাথ আশ্রমে যেতাম। সেখানে গিয়ে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করতাম। সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের বাবা-মা কেউ নেই, তবু তারা কত সুখে রয়েছে। সকলের সঙ্গে সকলের দারুণ বন্ধুত্ব। দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ তারা একে অপরের সঙ্গে ভাগ করে নেয়। তবে তাদের মধ্যে আয়ুষ নামের একটি ছেলে ছিল, যার মন ছিল বড়ই উদার। সে যাদের কাছ থেকে যত উপহার পেত, সেগুলো বন্ধু, ভাই-বোন, দাদা-দিদি, সকলের সঙ্গে ভাগ করে নিত। আর তার নিজের যে জিনিসটা সবচেয়ে ভালো লাগত, সেটি সে নিজের কাছে রেখে দিত। আমার বাবা-মায়ের নয়নের মণি ছিল সে। তাঁরা সবসময় আমায় বলতেন আয়ুষের মতো হতে। ছেলেটি যেমন নম্র-ভদ্র স্বভাবের ছিল, তেমনই ছিল মিষ্টভাষী। সর্বদা গুরুজনদের সম্মান করত। তাঁদের কথা মেনে চলত। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করত। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আমারও তাকে খুব ভালো লেগে গিয়েছিল।
তার মত বন্ধু পেয়ে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করতাম।
আমি যখনই তার কাছে যেতাম, তখনই সে আমায় কোনো খেলনা অথবা পুতুল অথবা ক্যাডবেরি বা চিপ্সের প্যাকেট হাতে তুলে দিত। আর যেহেতু আয়ুষের সঙ্গে আমার দারুণ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, সেহেতু আমার প্রতি সে একটু বেশিই দুর্বল ছিল। সে আমায় সব কথা বলত। কোনো কথা লুকোত না। সেজন্যই একদিন জানতে পারি, প্রতিদিন রাতে ঘুমোনোর পর পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়ুষ দেখে তার বালিশের পাশে কেউ অজান্তে তার জন্য উপহার রেখে দিয়ে গেছে।

‘তার মানে তার ভালো স্বভাবের জন্য কোন বন্ধু অথবা যাঁরা তাদের দেখাশোনা করেন, তাঁদের মধ্যে কেউ এসে ওই উপহারগুলো দিয়ে যেতেন—’ গল্পের মাঝখানে স্নেহাশীষ কথাগুলো বলে ওঠে।
সৌমিলী ওর মাথায় আস্তে করে গাট্টা মেরে বলে, ‘তোর এই এক স্বভাব। গল্পের মাঝে বুদ্ধির জহির করতে বসে যাস।’

ঠাকুরদা একটু স্মিত হেসে বললেন,‘যদি তাঁদের মধ্যেই কেউ জিনিসগুলো দিতেন, তাহলে তো তাঁরা আয়ুষের হাতেই সরাসরি সেগুলো তুলে দিতেন। অযথা কেন তাকে লুকিয়ে সেগুলো দিতে যাবেন? আমি যখন তাকে সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তখন সে বলেছিল, আমি সব বন্ধুদের কাছে, স্যার-ম্যামদের কাছে জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু সবাই বলেছেন কেউ আমায় উপহারগুলো দেননি।
আমিও তখন ভেবেছিলাম যিনি তাকে উপহারগুলো দিচ্ছেন, তিনি নিজে থেকে তাকে কিছু বলতে চাইছেন না। আর যদি বলারই হত, তাহলে লুকিয়ে সারপ্রাইজ গিফট দেওয়ার মজাটা কোথায়?
তবে সেইসব জিনিসগুলো বড়ই লোভনীয় ছিল। বরাবরের মত সে সবার মধ্যে সেগুলো ভাগ করে দেওয়ার পর আমাকেও বেশ ভালো দেখে একটা খেলনা গাড়ি উপহার দিয়েছিল। বাবা-মা যদিও তাকে এমন দামি উপহার দিতে মানা করেছিলেন, তবুও সে ম্যানেজ করে আমায় তা দিয়েছিল। সত্যি বলতে কি, আমি বাবা-মায়ের উপর তখন একটু বিরক্তি বোধই করেছিলাম। কিন্তু আমার মনে তখন বারেবারে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। কে আয়ুষকে অজান্তে এমন সুন্দর উপহারগুলো দিয়ে যায়?
দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছিল।
এক রবিবার সকালে আমরা আবার যাই ওই অনাথ-আশ্রমে। মা নিজের হাতে আশ্রমের ছেলে-মেয়েদের জন্য ফ্রাইড রাইস, চিলি চিকেন রান্না করে নিয়ে গিয়েছিলেন। বাবার হাতে ছিল ফল-মূল, চকলেট।
সেদিনও গিয়ে যথারীতি দেখলাম আয়ুষের ঝুলিতে আরও কিছু দামি উপহার যুক্ত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে লাল রঙের টেডি থেকে শুরু করে খেলনা ফোন, সবই ছিল।
আয়ুষ আমায় পুনরায় সেই অপরিচিত ব্যক্তির কথা বলল। তার কথায় মনের ভেতরের কৌতূহল আরও বেড়ে যেতে শুরু করল। কে সেই ব্যক্তি? কেনই বা তিনি কখনও তার সামনে এসে উপহার দেন না?
সেদিন আয়ুশ আমায় লাল টেডিটা উপহার দিয়েছিল। যদিও আমি তার কাছে অন্য একটা গিফট চাইছিলাম। একটা ছোট্ট পলি ট্রান্সফর্মিং অ্যাভেঞ্জার্স রোবোট, যেটিকে খেলনা গাড়িতে পরিবর্তন করা যায়।
কিন্তু আয়ুষ সেটা কিছুতেই আমায় দিতে চাইছিল না। কারণ ওই খেলনাটি তার সবচেয়ে প্রিয় ছিল।
সে আমায় বলেছিল সেটির বদলে অন্য যা খুশি নিতে। যদিও আমি বলেছিলাম, থাক আমার কিছু চাই না।
কিন্তু মনে মনে তখন উপায় ভাবছি কিভাবে খেলনাটি তার চোখের আড়াল থেকে চুরি করা যায়।
তারপর সুযোগ বুঝে খেলনাটি চুরি করতে এবং আশ্রম থেকে সেটি নিয়ে আসতে সক্ষমও হই।

বাড়ি ফেরার পর খেলনাটি লুকিয়ে ফেলি। কারণ বাবা অথবা মা একবার ওই খেলনাটি দেখলেই খুব সহজে ধরে নিতে পারবেন, খেলনাটি আসলে কার এবং তার জন্য আমাকে শাস্তিও ভোগ করতে হবে।
সেদিন তাঁদের চোখের আড়ালে খেলনাটি নিয়ে খেলে দারুণ খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু তখনও জানতাম না আমার জন্য কোন ভয়াবহ ঘটনা অপেক্ষা করে আছে!
রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে যখন ঘুমোতে গেলাম, তখন থেকেই মনের ভিতর কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ কাজ করছিল। প্রায় ঘন্টাখানেক এপাশ-ওপাশ করেও সহজে ঘুম আসছিল না।
তারপর হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম। যেহেতু আমি আলাদা ঘরে থাকতাম, সেহেতু ভেবেছিলাম বাবা অথবা মা হয়ত আমায় কিছু বলার জন্য এসেছেন।
তাই আমি বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ছিটকিনি খুলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু কোথায় কে? ডিম লাইটের হালকা আলোয় কাউকেই দেখতে পেলাম না।
দরজায় টোকা পড়ার শব্দ ঠিক শুনেছি না ভুল, একথা ভাবতে ভাবতেই দেখলাম ছাদে ওঠার সিঁড়ির ঠিক নিচে আমার সেই অ্যাভেঞ্জার্স রোবটটি। নিজে থেকে সেটি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে! এ কি স্বপ্ন, না সত্যি!
আমি ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম রোবটটির দিকে। হৃদস্পন্দন ক্রমশই বেড়ে যেতে শুরু করেছে। রোবটটির একেবারে সামনে গিয়ে আমি ঠিক যেই মুহূর্তে সেটি হাতের মুঠোয় বন্দী করে তুলেছি, ঠিক তখনই সিঁড়ির ওপর থেকে ভয়ানক গলায় কেউ বলে উঠল, ‘ছেড়ে দে ওটা। যে জিনিসে তোর কোন অধিকার নেই সেই জিনিস তুই জোর করে কেন অধিকার করবি?’

আমার স্পষ্ট মনে আছে আধো অন্ধকারে সিঁড়ির চার ধাপ উপরে যে ছেলেটিকে দেখতে পেয়েছিলাম, তাকে দেখে আমি ভয় পেয়ে কয়েক হাত পিছনে ছিটকে গিয়ে পড়েছিলাম। এ যে রঞ্জনদা! ওই অনাথ আশ্রমেরই একটি ছেলে। আমার থেকে মাত্র এক বছরের বড় ছিল। ঠিক এক বছর আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে সে সবাইকে কাঁদিয়ে চলে গিয়েছিল না ফেরার দেশে। বড় ভালো ছিল ছেলেটি। আয়ুষের মতোই উদার মনের ছিল সে। তাই তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। মৃত্যুও তাদের বন্ধুত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। তাই তো সে প্রতিদিন আয়ুষের অজান্তে তার বালিশের পাশে একটি করে উপহার রেখে যায়।

আমি বড়ই অনুশোচনা বোধ করছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম চুরি করতে গিয়ে আমি দু’জনের মনেই কষ্ট দিয়েছি। আমি চেয়েছিলাম আয়ুষের ভালো বন্ধু হতে। কিন্তু সেই ঘটনাটি ঘটার পর বুঝেছি বন্ধুত্বের প্রকৃত অর্থ কি? কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তার মনে কষ্ট দেওয়া বন্ধুত্ব নয়। বরং বন্ধুর মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলাই হল আসল বন্ধুত্ব।

আমি রঞ্জনদাকে বলেছিলাম, ‘আমার বড় ভুল হয়ে গিয়েছে দাদা। আয়ুশকে আমি আর কোনদিনও কষ্ট দেব না। ওর খেলনা আমি ফিরিয়ে দেব।’
কথাগুলো বলার পর দেখলাম রঞ্জনদা আমার চোখের সামনে থেকে কুয়াশার মত মিলিয়ে গেল। তারপর যেদিন আয়ুষের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম সেদিন ওই খেলনা তাকে ফিরিয়ে দিয়ে আমার অপরাধ স্বীকার করেছিলাম। আশ্চর্যজনক ভাবে দেখলাম সে কত সহজেই আমায় ক্ষমা করে আমার দিকে একটি ফ্রেন্ডশিপ রিং বাড়িয়ে দিয়েছে। আমিও প্রিয় বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম।’

পুরো গল্পটা বলতে বলতে ঠাকুরদার চোখে জল চলে এসেছিল। আমরা একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম।
সত্যিই ঠাকুরদার এই গল্প আমাদের বন্ধুত্বের আসল মানে শেখাল। ঠাকুরদা বললেন, ‘অনেক রাত হয়েছে। এবার তোমরা লক্ষ্মী ছেলে-মেয়েদের মত যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো।’