Categories
পুরনো পরগণা |

টুনটুনি আর নাপিতের কথা

1255 |
Share
| ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

১৮৬৩-১৯১৫। বাংলা শিশুসাহিত্যের স্তম্ভ। লেখক, চিত্রকর, বিজ্ঞানী, সংগীতজ্ঞ এবং মুদ্রণশিল্পে অগ্রণী গবেষক। ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৯১৩ সালে।

অলংকরণ: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

টুনটুনি গিয়েছিল বেগুন পাতায় বসে নাচতে৷ নাচতে-নাচতে খেল বেগুন কাঁটার খোঁচা৷ তাই থেকে তার হল মস্ত বড় ফোড়া৷
ও মা, কী হবে? এত বড় ফেড়া কী করে সারবে?
টুনটুনি একে জিগগেস করে তাকে জিগগেস করে৷ সবাই বললে, ‘ওটা নাপিতকে দিয়ে কাটিয়ে ফেল৷’
তাই টুনটুনি নাপিতের কাছে গিয়ে বললে, ‘নাপিতদাদা, নাপিতদাদা, আমার ফোড়াটা কেটে দাও না!’
নাপিত তার কথা শুনে ঘাড় বেঁকিয়ে নাক সিঁটকিয়ে বললে, ‘ঈশ! আমি রাজাকে কামাই, আমি তোর ফোড়া কাটতে গেলুম আর আর কি!’
টুনটুনি বললে, ‘আচ্ছা দেখতে পাবে এখন, ফোড়া কাটতে যাও কি না!’
বলে সে রাজার কাছি গিয়ে নালিশ করলে, ‘রাজামশাই, আপনার নাপিত কেন আমার ফোড়া কেটে দিচ্ছে না? ওকে সাজা দিতে হবে!’
শুনে রাজামশাই হো-হো করে হাসলেন, বিছানায় গড়াগড়ি দিলেন, নাপিতকে কিছু বললেন না৷ তাতে টুনটুনির ভারি রাগ হল৷

সে ইঁদুরের কাছে গিয়ে বললে, ‘ইঁদুরভাই, ইঁদুরভাই, বাড়ি আছ?’
ইঁদুর বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পিতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি এক কাজ কর৷’
ইঁদুর বললে, ‘কী কাজ?’
টুনটুনি বললে, রাজামশাই যখন ঘুমিয়ে থাকবেন, তখন গিয়ে তাঁর ভুঁড়িটা কেটে ফুটো করে দিতে হবে৷’
তা শুনে ইঁদুর জিভ কেটে কানে হাত দিয়ে বললে, ‘ওরে বাপরে! আমি তা পারব না!’ তাতে টুনটুনি যারপরনাই রাগ করে বিড়ালের কাছে গিয়ে বললে, ‘বিড়ালভাই, বিড়ালভাই, বাড়ি আছ?’
বিড়াল বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাই খাই, যদি ইঁদুর মার৷’বিড়াল বললে, ‘এখন আমি ইঁদুর-টিদুর মারতে যেতে পারব না, আমার বড্ড ঘুম পেয়েছে৷’ শুনে টুনটুনি রাগের ভরে লাঠির কাছে গিয়ে বললে, ‘লাঠিভাই, লাঠিভাই, বাড়ি আছ?’
লাঠি বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি বিড়ালকে ঠেঙাও৷’
লাঠি বললে, ‘বিড়াল আমার কি করেছে যে আমি তাকে ঠেঙাতে যাব? আমি তা পারব না৷’ তখন টুনটুনি আগুনের কাছে গিয়ে বললে, ‘আগুনভাই, আগুনভাই, বাড়ি আছ?’
আগুন বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’

টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি তুমি লাঠি পোড়াও৷’
আগুন বললে, ‘আজ ঢের জিনিস পুড়িয়েছি, আজ আর কিছু পোড়াতে পারব না৷’ তাতে টুনটুনি তাকে খুব করে বকে, সাগরের গাছে গিয়ে বললে, সাগরভাই, সাগরভাই, বাড়ি আছ?’
সাগর বললে, ‘কে ভাই, টুনিভাই? এস ভাই, বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি তুমি আগুন নেবাও৷’
সাগর বললে, ‘আমি তা পারব না৷’ তখন টুনটুনি হাতির কাছে গিয়ে বললে, ‘হাতিভাই, হাতিভাই, বাড়ি আছ?’
হাতি বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি সাগরের জল সব খেয়ে ফেল৷’
হাতি বললে, ‘অত জল খেতে পারব না, আমার পেট ফেটে যাবে৷’

কেউ তার কথা শুনল না দেখে টুনটুনি শেষে মশার কাছে গেল৷ মশা দুর থেকে তাকে দেখেই বললে, ‘কে ভাই? টুনিভাই? এস ভাই! বস ভাই! খাট পেতে দি, ভাত বেড়ে দি, খাবে ভাই?’
টুনটুনি বললে, ‘তবে ভাত খাই, যদি হাতিকে কামড়াও৷’

মশা বললে, ‘সে আবার একটা কথা! এখুনি যাচ্ছি৷ দেখব হাতি বেটার কত শক্ত চামড়া৷ বলে, সে সকল দেশের সকল মশাকে ডেকে বললে, ‘তোরা আয় তো রে ভাই, দেখি হাতি বেটার কত শক্ত চামড়া৷’

অমনি পিন্-পিন্-পিন্-পিন্ করে যত রাজ্যের মশা, বাপ বেটা ভাই বন্ধু মিলে হাতিকে কামড়াতে চলল৷ মশায় আকাশ ছেয়ে গেল সূর্য ঢেকে গেল৷ তাদের পাখার হাওয়ায় ঝড় বইতে লাগল৷ পিন্- পিন্-পিন্-পিন্ ভয়ানক শব্দ শুনে সকলের প্রাণ কেঁপে উঠল৷ তখন—
হাতি বলে, সাগর শুষি!
সাগর বলে, আগুন নেবাই!
আগুন বলে, লাঠি পোড়াই!
লাঠি বলে, বেড়াল ঠেঙাই!
বেড়াল বলে, ইঁদুর মারি!
ইঁদুর বলে, রাজার ভুড়ি কাটি!
রাজা বলে, নাপিত বেটার মাথা কাটি!
নাপিত হাত জোড় করে কাঁপতে কাঁপতে বললে, ‘রক্ষে কর টুনিদাদা! এস তোমার ফোড়া কাটি!’

তারপর টুনটুনির ফোড়া সেরে গেল, আর সে ভারি খুশি হয়ে আবার গিয়ে নাচতে আর গান গাইতে লাগল—টুনটুনা টুন্ টুন্ টুন্! ধেই ধেই!

পুরনো বানান অপরিবর্তিত