চলে গেলেন ভারতীয় ক্রীড়া জগতের ‘অলরাউন্ডার’ চুনী গোস্বামী। বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগছিলেন বেশ কিছু বছর ধরে। সেই লড়াই থেমে গেল ৩০ এপ্রিল ২০১৯, বৃহস্পতিবার। তাকে বলা হত ভারতবর্ষের ‘কমপ্লিট ফুটবলার’। তাঁর অসাধারণ ড্রিবল, গোলের জন্য জায়গা করে নেওয়া এবং দৃষ্টি নন্দন ফুটবল ছিল ময়দানের আকর্ষণ। দেশের সম্ভবত সেরা ফরওয়ার্ড, সীমিত দক্ষতার এক ক্রিকেটার আর কলকাতার সাউথ ক্লাবে খেলা এক গ্রেসফুল টেনিস খেলোয়াড়।
সুনির্মল গোস্বামী বা চুনী গোস্বামীর জন্ম ১৫ জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে পূর্ববঙ্গের কিষাণগঞ্জে। মাত্র ৯ বছর বয়সে মোহনবাগান জুনিয়র টিমে সুযোগ পান এবং বহু সুযোগ আসা সত্ত্বেও থেকে যান এই ক্লাবেই। ১৯৫৪ সালে জুনিয়র টিম থেকে সিনিয়র টিমে খেলার সুযোগ পান আর আজীবন থেকে যান এই ক্লাবেই। বিস্ময়কর বিষয় হল তিনি মাত্র ২৭ বছর বয়সে ফুটবল থেকে অবসর নেন এবং মনস্থির করেন এবার তিনি ক্রিকেট খেলবেন। তবে এই সময়ের মধ্যেই উনি ইতিহাসের পাতায় প্রবেশ করেন মোহনবাগানের হয়ে খেলে। টানা পাঁচ বছর উনি মোহনবাগান দলের অধিনায়ক ছিলেন—১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল অবধি। এই দলের হয়েই ১৪৫টি গোল করেন আর ট্রফি জেতেন ২৩টি। টানা ১৫ বছর মোহনবাগানে খেলে ৬টা ডুরান্ড কাপ আর ১০ বার কলকাতা লিগ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন তিনি।
ময়দানে তাঁকে নিয়ে শোনা অনেক গল্প আছে। যেমন তাঁর প্রথম মোহনবাগান দলে জার্সি পাওয়া নাকি পুরোটাই কাকতালীয়। অন্য দু’জন অনুপস্থিত থাকায় তিনি জার্সি পান এবং খেলতে শুরু করেন ইনসাইড লেফট হিসেবে। এও শোনা যায় একবার জে. সি. গুহ ষাটের দশকে চুনী গোস্বামীকে সেই সময়ের ফিয়াট গাড়ি উপহার দেবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গলে খেলার জন্য, কিন্তু চুনী এটা প্রত্যাখ্যান করেন এবং থেকে যান তাঁর প্রাণের ক্লাব মোহনবাগানে। যে দলের জন্য এত আত্মত্যাগ সেই মোহনবাগান তাঁকে ২০০৫ সালে ‘মোহনবাগান রত্ন’ দিয়ে সম্মানিত করেন। শুধু ক্লাব নয় বাংলার জন্য উনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, ২৫টি গোল করেছেন সন্তোষ ট্রফিতে। যখন বাংলার জন্য খেলেন তখন দলের কথা ভুলে গিয়ে সবাইকে একসাথে নিয়ে বাংলার ফুটবলের সম্মান রক্ষার্থে খেলেছেন এবং জিতেছেন ট্রফি।
শুধু নিজের দলের বা রাজ্যের জন্য নয়, দেশের জন্যও তাঁর সেরা খেলা সব সময় উপহার দিয়ে এসেছেন। আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁর খেলা শুরু ১৯৫৬ সালে অলিম্পিক গেমস দিয়ে, যে ম্যাচে ভারত জেতে ১-০ গোলে। এরপর উনি মোট ৫০টা ম্যাচ খেলেন ভারতের হয়ে। ১৯৬২ সালে জাকার্তা এশিয়ান গেমসে যে ভারতীয় দল সোনা জেতে তার অধিনায়ক ছিলেন বাংলার প্রতিভাবান চুনী গোস্বামী। এছাড়াও ১৯৬৪ সালের এশিয়ান কাপ এবং মারদেকা টুর্নামেন্ট রানার্স দলের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। ভারতের হয়ে কেরিয়ারে মাত্র ১৩টি গোল উনি করেন।
তাঁর বর্ণময় ক্রীড়া জীবনের আরও একটি দিক হল ক্রিকেট। মাত্র ২৭ বছর বয়সে ফুটবল গ্রাউন্ড ছেড়ে ক্রিকেটের পিচে নেমে পড়েন। বিষয়টা রোমাঞ্চকর শোনালেও কাজটা খুব সহজ ছিল না তাঁর মতো ক্রীড়াবিদের জন্য, কারণ তাঁকে প্রমাণ করতে হত নিজের দক্ষতা এবং একই সঙ্গে ধরে রাখতে হত নিজের কীর্তি। সুতীব্র আত্মবিশ্বাস না থাকলে এই ভাবে একটা খেলা থেকে অন্য খেলায় পদার্পণ করা সহজ নয়। যুদ্ধটা মূলত ছিল নিজের সঙ্গে কিন্তু এখানেও তিনি সফল। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটার হিসেবে রঞ্জি ক্রিকেট খেললেন ডানহাতি ব্যাটসম্যান এবং মিডিয়াম পেসার হিসেবে। ওঁর মিডিয়াম পেস এবং সিম বোলিং ছিল ঘরোয়া ক্রিকেটের এক নতুন বিষয়। বাংলাকে তিনি নিয়ে যান রঞ্জি ফাইনাল অবধি ১৯৭১-৭২-এর মরসুমে, যদিও সেই ম্যাচ তারা হেরে যায় মুম্বাইয়ের কাছে। কিন্তু তিনি একজন বিরল প্রতিভা যিনি বাংলাকে ফুটবল এবং ক্রিকেটে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
যখন উনি পুরদমে ক্রিকেট খেলছেন ১৯৬৬-তে, সেই সময়ের বিশ্ব ক্রিকেটের ত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিস আসে ভারত সফর করতে। সেই দলে ছিল গ্যারি সোবার্স, রোহান কানহাই, ডেরেক মারে, ক্লাইভ লয়েড, ওএস হল, চার্লি গ্রিফিথের মত আগ্রাসী ক্রিকেটার। ভারতের বিরুদ্ধে নামার আগে দুটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে দেওয়া হয় তাঁদের মধ্যাঞ্চল এবং পূর্বাঞ্চলের দলের বিরুদ্ধে— যে দুটি দলকে সেই সময়ের ঘরোয়া ক্রিকেটে সবচেয়ে দুর্বল বলে মনে করা হত। পূর্বাঞ্চলের সেই দলে ছিলেন হনুমন্ত সিং (ক্যাপটেন), দালজিৎ সিং, রমেশ সাক্সেনা, অম্বর রায়, সুব্রত গুহ, দেবু মুখার্জি এবং চুনী গোস্বামী। বোলিং লাইন-আপ বলতে সুব্রত গুহ আর চুনী গোস্বামীর সঙ্গে দু’জন স্পিনার মহম্মদ সিদ্দিকি আর চাঁদু জোশী। বাংলার দুই পেসারের দাপটে ক্যারেবিয়ানরা প্রথম ইনিংসে মাত্র ১৩৬ রানে অল-আউট হয়ে যায়। সুব্রত নিয়েছিলেন ৪ উইকেট আর চুনী নিয়েছিলেন ৫ উইকেট ৪৭ রান দিয়ে। প্রথম ইনিংসের ব্যাটিং-এর সময়তেও এই দুজন রুখে দাড়িয়ে ছিলেন। মোট ৪৪ রান তাঁরা যোগ করেছিলেন। পূর্বাঞ্চল তুলেছিল ২৮৩ রান যার মধ্যে চুনী করেছিলেন ২৫ রান। ক্যাপ্টেন হনুমান্ত ডিকক্লেয়ার করে দেন ১৪৭ রানের একটা লিড রেখে। দ্বিতীয় ইনিংসে দুনিয়া কাঁপানো ওয়েস্ট ইন্ডিস ব্যাটসম্যানরা সবাই আউট হয়ে যায় মাত্র ১০৩ রানে। সেই ম্যাচ পূর্বাঞ্চল জেতে এক ইনিংস এবং ৪৪ রানে। এই ইনিংসেও চুনী নেন তিন উইকেট এবং সুব্রত সাত। চুনী গোটা ম্যাচে পেয়েছিলেন ৮ উইকেট। ওঁর মিডিয়াম পেস আর সুইং বলিং-এর সামনে ধরাশায়ী হতে হয়েছিল ক্যারেবিয়ান ব্যাটসম্যানদের। এই ম্যাচটা চুনীর ক্রিকেট জীবনের অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ম্যাচ কারণ উনি খেলেছিলেন এক ভয়ডরহীন ক্রিকেট। যে ভয়ডরহীন ক্রিকেটের কথা আজ বলা হয়, তার জন্ম কিন্তু সেই ষাটের দশকে ওই বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বোলারদের বিরুদ্ধে। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট জীবনে চুনী ৪৬টা ম্যাচ খেলে ১৫৯২ রান করেন এবং সংগ্রহ করেন ৪৭টা উইকেট।
এ এক অবিস্মরণীয় প্রতিভার স্ফূরণ ভারতবর্ষ দেখতে পেয়েছিল চুনীর মধ্যে। এই দেশের ফুটবলের ইতিহাস তৈরি হয়েছিল চুনী-পিকে-বলরামের মত ত্রয়ীর হাতে। যাঁদের খেলায় ছিল ক্ষীপ্রতা এবং ছিল শিল্পীর তুলির টান। চুনী যখন মধ্যগগনে, তখন ইংল্যান্ডের টোটেনহাম দলে খেলার জন্য ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক বিদেশের এই ঐতিহাসিক ক্লাবে তাঁর আর খেলা হয়ে ওঠেনি। কে বলতে পারে চুনীর ওই শৈল্পিক ফুটবল নতুন কোনও ইতিহাস রচনা করতে পারত বিশ্ব ফুটবলে!
ফুটবল ও ক্রিকেটে সফল হয়ে উনি কলকাতা সাউথ ক্লাবে জমিয়ে খেললেন টেনিস। তাঁর সুন্দর চেহারা, একগাল হাসি, দৃষ্টিনন্দন ড্রিবল আর ধারালো সুইং বোলিং-এর জন্য তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল বিপুল। উনি ছিলেন খেলার মাঠের নায়ক, ময়দানের উত্তমকুমার। যেভাবে উনি মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন, ঠিক সেইভাবে পেয়েছেন বেশ কিছু সম্মাননা এবং স্বীকৃতি। তিনি ১৯৬২-তে বেস্ট স্ট্রাইকার অফ এশিয়া অ্যাওয়ার্ড, ১৯৬৩-তে অর্জুন পুরস্কার, ১৯৮৩-তে পদ্মশ্রী এবং ২০০৫-এ মোহনবাগান সম্মানে সম্মানিত হন আর ওই একই সালে উনি কলকাতার শেরিফ হন। চুনী গোস্বামী সত্যিকারের একজন ‘অলরাউন্ডার’ যিনি একাধিক খেলায় নিজেকে মেলে ধরেছিলেন এবং পেয়েছিলেন সাফল্য। জিতেছিলেন ম্যাচের পর ম্যাচ আর অসংখ্য হৃদয়। উনি চলে গেলেও ভারতবর্ষের খেলার দুনিয়ায়ে বাঁধানো থাকবে চুনীর নাম সোনা দিয়ে।