ছবি দেখ? ছবি দেখতে ভাল লাগে তোমাদের? তবে ছবির কথা মনে পড়লেই দুটি নাম সেই সঙ্গে নিশ্চয়ই মনে জেগে উঠবে— অবনীন্দ্রনাথ আর তাঁর প্রিয়তম শিষ্য নন্দলাল৷ কত ছবিই তো দেখতে পাই মাসিক পত্রে, বইতে, ক্যালেন্ডারে! কত ছবি জমিয়ে রাখি, কত ছবি ফেলে দিই, তার কি হিসেব আছে? সেসব ছবির কোনটি কে এঁকেছেন তা কি আর দেখি? তা হলে বলব, ছবি জমিয়েছ কিন্তু ছবি ভাল করে দেখনি কখনও৷ ছবি তর্কের জিনিস নয়৷ ভাল গানখানি, চুপ করে শোনবার, ভাল সন্দেশটি, রসিয়ে স্বাদ নেবার, তর্কের নয়৷ তাছাড়া ছবি আর শিল্পী আলাদা নয়৷ শিল্পীর মধ্যে দিয়ে ছবি আর ছবির মধ্যে দিয়ে শিল্পীকে জানলে তবেই ঠিক জানা হল— সত্যিকারের রস পাওয়া গেল৷
শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে অনেক লেখা, অনেক বই বেরিয়ে গেছে৷ সেসব হয়তো তোমরা কিছু কিছু পড়েছও৷ কিন্তু নন্দলাল সম্বন্ধে এখনও তেমন কিছু বলা হয় নি৷ শিল্পী নন্দলাল সম্বন্ধে জানতে হলে কিছু বলবার নেই৷ খুব মন দিয়ে তাঁর ছবি দেখ বেশ রসিয়ে রসিয়ে যেমন করে আজকের দিনে একখানা সন্দেশ পেলে চেখে চেখে খাও৷
কিন্তু শিল্পগুরু নন্দলাল— বিশেষত মানুষ নন্দলাল সম্বন্ধে জানতে গেলে তাঁর অন্তরঙ্গ শিষ্যের কথা ছাড়া অন্য উপায় নেই বললেই চলে৷ কারণ তিনি শিল্প সম্বন্ধে সামান্য কিছু লেখা ছাড়া নিজের সম্বন্ধে লেখা তো দূরের কথা, বলতেনই খুব কম৷ তাই নিতান্ত কাছে থেকে দেখা নন্দলাল সম্বন্ধে কয়েকটি গল্প মানে সত্য ঘটনা বলছি৷ তা থেকে তোমরা মানুষ নন্দলাল সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা করে নিতে পারবে৷
শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেন ছাড়িয়ে আরও দক্ষিণে রাজগঞ্জ বলে একটা জায়গা আছে৷ তার কাছেই ছোটো একটি গ্রাম আছে তার নাম বাণিপুর৷ এই গ্রামটি হল নন্দলালের পৈতৃক বাসস্থান৷ কিন্তু নন্দলালের জন্ম হয়েছে এই গ্রাম থেকে অনেক দূরে— বিহারে, ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর, মুঙ্গের জেলার খড়্গপুর বলে একটি গ্রামে৷ নন্দলালের বাবা পূর্ণচন্দ্র বসু সেখানে দ্বারভাঙ্গা মহারাজার জমিদারিতে বন-বিভাগে চাকরি করতেন৷ নন্দলালের ছেলেবেলাটা সেই বনের ধারে সেই ছোট্টো গ্রামটিতেই কেটেছে৷
খড়্গপুর গ্রামের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে মণি বলে ছোট্টো একটি পাহাড়ি নদী৷ বর্ষার ক’দিন সে নদী দুরন্ত হয়ে উঠে দুই কূল ভাসিয়ে নেয়৷ বছরের আর ক’টা দিন সে নদীতে থাকে একটি ক্ষীণ জলের ধারা৷ গরুর গাড়ি, মোষের গাড়ি সে নদী স্বচ্ছন্দে পার হয়ে চলে যায় মানুষ পার হতে গেলে তার হাঁটুতেও পৌঁছায় না৷
বনের পিছনে আছে ছোট ছোট পাহাড়, বাদামী থেকে পাঁশুটে বেগুনী হয়ে তাদের ঢেউ গিয়ে মিলেছে দূরে নীল বিন্ধ্য পর্বতশ্রেণীতে৷ ছোট্টো ছেলে নন্দলাল অবাক হয়ে এ দৃশ্য দেখতেন৷ কাছে ছিল কয়েকঘর কুমোর আর চাষি৷ চাষিদের চাষ করা, বীজ থেকে অঙ্কুর, অঙ্কুর থেকে গাছ ওঠা, শস্য কেটে ঘরে আনা এসব দেখতেন। দেখতেন কুমোরের ঘরে গিয়ে তাদের কাছে বসে থেকে— কুমোরের চাকা ঘুরছে আর তার থেকে বেরিয়ে আসছে ঘড়া-সরা-খুরি সব নানা মাপের নানা আকারের জিনিস কুমোরের আঙুলের স্পর্শের জাদুতে৷ ঐ ছোট্টো ছেলেটি নিজেও বসতেন নরম মাটির তাল নিয়ে৷ এটা ওটা পুতুল গড়া হত৷
ঘরে আছেন মা ক্ষেত্রমণি৷ মাটি দিয়ে গড়েন চন্দ্রপুলির ছাঁচ, ক্ষীরের ছাপ ছুঁচের ফোঁড়ে তুলছেন কাঁথার নকশাতে ফুল লতাপাতা পাখি মাছ হাত— কত কী! নন্দলাল মায়ের কাছে বসে দেখতেন সব ভুলে গিয়ে৷
বাড়িতে মা-বাবা ভাইবোনদের সঙ্গে কথা হত বাংলাতে, আর বাইরে সর্বদা কথা চলত ওখানকার দেহাতি হিন্দিতে৷ এইজন্য তাঁর পরবর্তী জীবনে যদিও সর্বদা বাংলাতেই কথা বলতেন তবু কতগুলি হিন্দি কথার ঠাঁট তাঁর কথার মধ্যে এসে যেত৷
নন্দলাল খড়্গপুর গ্রামের পাঠশালা, যাকে তিনি বলতেন ‘মক্তব’— তাই ছাড়িয়ে ওখানে মধ্য-ইংরেজি স্কুল থেকে পাস করেন৷ ও পর্যন্ত লেখাপড়া হিন্দিতেই করতে হয়েছে৷ তার পরে পূর্ণচন্দ্র সেখান থেকে বদলি হয়ে মহারাজার রাজধানী দ্বারভাঙ্গা শহরে এলেন মহারাজার স্টেটের ম্যানেজার হয়ে৷ এখানে এসে নন্দলাল আর একটি বাঙালি পরিবারের ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতালেন৷ সে ছেলেটির নাম রাজশেখর বসু৷ এই রাজশেখর বসু পরে হলেন নামকরা কেমিস্ট, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের প্রিয় শিষ্য, প্রসিদ্ধ বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে প্রধান নায়ক যিনি ‘পরশুরাম’ ছদ্মনাম গ্রহণ করে বহু কৌতুককর গল্প লিখে গেছেন, চলিত বাংলা ভাষায় অভিধান লিখেছেন, সংস্কৃত রামায়ণ-মহাভারতের অনুবাদ করেছেন সরল বাংলা ভাষায়, সংস্কৃত কাব্য মেঘদূতের ভাষা না জেনেও তার রসগ্রহণ করবার মতো ব্যবস্থা করেছেন চলিত বাংলায়— এমন কত বলব৷ দ্বারভাঙ্গা ছেড়ে আসবার বহুদিন পরে আবার এই দুই বন্ধুর মিলন হয়েছিল শান্তিনিকেতনে৷ সে গল্প পরে বলছি৷
দ্বারভাঙ্গাতে চলে আসবার কিছুদিন পরেই পূর্ণচন্দ্র তাঁর সন্তানদের নিয়ে এলেন তাঁর পৈতৃক ভদ্রাসনবাড়ি বাণিপুরে৷ কুড়িটি সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা তো সোজা নয়৷ বাণিপুর থেকে কলকাতা দশ মাইল পথ৷ যাতায়াতের ব্যবস্থা হয় নৌকা না হয় পোর্ট কমিশনারের স্টিমার— চাঁদপাল ঘাট থেকে রাজগঞ্জ পর্যন্ত৷ আর তা না হলে আসতে হত শিবপুর পর্যন্ত হেঁটে এসে যানবাহন জোগাড় করে গঙ্গার ওপরে নৌকার পুল পার হয়ে৷ তার পরে দ্বিতীয়, ইডেন গার্ডেন থেকে, নয় তো বড়বাজার থেকে আবার কলকাতার স্কুলপাড়া— কর্ণওয়ালিশ স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট৷ সে অনেক দূর৷ তাই কলকাতার স্টার থিয়েটারের দক্ষিণে জোড়াবাগান লেনে একখানা বাড়ি কিনে সেখানে ছেলেদের রেখে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হল৷
কলকাতায় হেদুয়ার বাগানের উত্তরে কর্ণওয়ালিশ স্ট্রিটের ওপরে ছিল ক্ষুদিরাম বোসের সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুল৷ নন্দলালকে সেখানে ভর্তি করে দেওয়া হল৷ সেখান থেকেই এন্ট্রান্স পরীক্ষা পাস করলেন নন্দলাল৷ তোমরা এখন যে পরীক্ষাকে বলে ‘স্কুল ফাইনাল’— সেটিকে তখন বলা হত ‘এন্ট্রান্স’ পরীক্ষা৷ এন্ট্রান্স পাস করে হেদুয়ার উত্তরে জেনারেল এসেম্বলি কলেজে ভর্তি হলেন৷ সে কলেজটির এখন নাম হয়েছে স্কটিশ চার্চ কলেজ৷
এন্ট্রান্স পাস করার পরেই নন্দলালকে বিয়ে দেওয়া হল৷ তখন স্কুলের ওপরের ক্লাসেই ছেলেদের বিয়ে দেওয়া হত৷ কনে— সুধীরা সেই খড়্গপুরের প্রকাশচন্দ্র পালের বড় মেয়ে৷ জানা ঘর৷ পূর্ণচন্দ্র আর প্রকাশচন্দ্রের বাড়ি ছিল খড়্গপুর সেই মণিদীর এপারে আর ওপারে৷
নন্দলালের বাবার ইচ্ছা ছেলে হবে ইঞ্জিনিয়ার, শ্বশুরের ইচ্ছা জামাই হবেন ডাক্তার৷ কিন্তু নন্দলালের ইচ্ছা ওর একটাও নয়৷ ছেলেবেলা থেকেই তাঁর মন টানছে ছবিতে৷ সে ছবিও বিলিতি কায়দায় তেল-রং জল-রং নয়৷ দেশি ছবিতে মন পড়ে আছে৷ আর্ট স্কুলে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথের ছাত্র হবেন৷ অবনীন্দ্রনাথ তখন শিল্পগুরু বলে স্বীকৃত হয়েছেন বিদেশি সরকারের কাছে৷ তাঁকে বাড়ি থেকে খাতির করে, ডেকে নিয়ে সরকারি আর্ট স্কুলে উপাধ্যক্ষ করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ অবনীন্দ্রনাথের ইচ্ছামতো সেখানে মেঝেতে ফরাস বিছিয়ে সামনে ছোটো ডেস্ক রেখে ছবি আঁকা শেখানো হচ্ছে৷ অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে এসেছে তাঁর প্রিয় গড়গড়া৷ সুগন্ধি তামাকে ভুড়ুক্-ভুড়ুক্ করে টান দিতে দিতে ছবি আঁকা তাঁর অভ্যাস৷ তাই এটা জোর করে আদায় করে নিয়েছেন ইংরেজ অধ্যক্ষ হ্যাভেল সাহেবের কাছ থেকে৷
তখনকার দিনে নিতান্ত বাপে-চাড়ানো মায়ে-খেদানো ছেলে ছাড়া আর্ট স্কুলে কেউ ভর্তি হত না৷ ছাত্রদের বেশিরভাগই আসত স্যাকরা কিংবা ছাপাখানার কারিগরের ছেলেদের ভিতর থেকে৷ আর্ট স্কুল থেকে নকশা-কাজ আর কাঠ খোদাই করা ছবি, পাথরে আঁকা লিথোগ্রাফ— এই সব কাজ, কিংবা বড়জোর তেল রং-এ মানুষের ছবি আঁকতে শিখে বের হবে৷ এতে স্যাকরা দোকানে গহনার নকশা, ছাপাখানাতে ছবি ছাপা— আর খুব বড়জোর সরকারি কাজ হিসেবে জুটত ড্রইং মাস্টারের কাজ সরকারি স্কুলে৷
তাই সম্পন্ন ভদ্রঘরের শিক্ষিত ছেলে তখন ওর ত্রিসীমানায় ঘেঁষত না৷ নন্দলাল এলেন সেই আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে৷ ইচ্ছা সত্যিকারের শিল্পী হবেন অবনীন্দ্রনাথের কাছ থেকে৷ ভয়ে ভয়ে এগিয়ে গেলেন অবনীন্দ্রনাথের কাছে— যাঁকে ছেলেবেলা থেকেই গুরু বলে মনে মনে স্বীকার করে নিয়েছেন৷
অবনীন্দ্রনাথ ঐ কাঁচুমাচু ছেলেটির দিকে তাকিয়েই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন—‘কী হে— এসেছ তো আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে? লেখাপড়া তো কিচ্ছুই হল না— তাই?’ নন্দলাল তাঁর সঙ্গে কাগজের তাড়া থেকে এন্ট্রান্সের সার্টিফিকেট বার করে দেখালেন— বললেন কলেজে পড়ছেন৷ অবনীন্দ্রনাথ তখন অবাক হয়ে দেখছেন ছেলেটিকে— বিনীত নম্র অথচ নির্ভয়— সম্পন্নঘরের শিক্ষিত ছেলে কলেজ ছেড়ে এসেছে আর্ট স্কুলে ভর্তি হতে! দেখতে চাইলেন হাতে কাজ— ছবি৷ দেখে মুগ্ধ হলেন৷ তারপর সেই যে আদর করে ডেকে নিলেন— তা থেকে যতদিন জীবিত ছিলেন ততদিন পর্যন্ত ছিল এই শিষ্য-অন্ত-প্রাণ৷
নন্দলাল ক্রমে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচিত হলেন৷ রবীন্দ্রনাথ কেবল ছবি নয়— ছবি আঁকে যে মানুষটি তাঁকে দেখেও মুগ্ধ হলেন, শ্রদ্ধান্বিত হলেন৷ রবীন্দ্রনাথ চাইলেন নন্দলাল শান্তিনিকেতনে এসে কলাভবনের ভার নেন৷ ওদিকে তখন অবনীন্দ্রনাথও সরকারি আর্ট স্কুল ছেড়ে দিয়ে আর এক ছবি আঁকার স্কুল খুলছেন কলকাতায়৷ তিনিও চাইছেন প্রিয়তম শিষ্য নন্দলাল সে স্কুলের ভার নেন৷ তখন দু’দিক থেকেই কিছুদিন টানাটানি চলল৷ শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথেরই জয় হল৷ নন্দলাল অতি সামান্য বেতনে শান্তিনিকেতনে কলাভবনের অধ্যক্ষের কাজ নিয়ে সেখানেই থেকে গেলেন৷
এর পরে কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ পদের জন্য তখনকার ইংরেজ সরকার থেকে তাঁকে নেবার জন্য বহু চেষ্টা করা হয়৷ দশগুণ মাইনে, চৌরঙ্গীর ওপরে প্রাসাদতুল্য বাসস্থান, বহুসংখ্যক ভৃত্য, অনুচর, রাজসম্মান, সব কিছুর প্রলোভন ছেড়ে নন্দলাল খুশি হয়ে থাকলেন দারিদ্র্য আঁকড়ে, শান্তিনিকেতনের মাটির ঘরখানিতে৷
শান্তিনিকেতনের চারদিক তখন ফাঁকা৷ যেদিকে তাকানো যায়, কেবল গেরুয়া রং-এর মাটি চলছে ঢেউ খেলে উঁচু-নিচু হয়ে৷ তার মধ্যে বৃষ্টির জলে মাটি ক্ষয়ে গিয়ে এখানে ওখানে আছে গভীর খাদ— যাকে ওদেশে বলে ‘খোয়াই’৷ আছে কিছু শাল-মহুয়া-তাল-খেজুরের গাছ এদিকে ওদিকে৷ লাল কাঁকরের মেঠো পথের রাস্তা ধুলো উড়িয়ে চলেছে মন্থর গরুর গাড়ি তেলবিহীন চাকার আর্তনাদ ছেড়ে৷ শান্তিনিকেতনের উত্তর-পশ্চিম কোণে আছে এক সাঁওতাল পল্লী৷ সেখানে থাকে কয়েক ঘর সাঁওতাল তাদের মুরগি, পায়রা, গরু, ছাগল আর শুয়োর নিয়ে৷ কিছু সামান্য চাষবাস আর দিনমজুরি করে তাদের দিন চলে যায় হেসে খেলে৷ জ্যোৎস্না রাত হলে সারারাত ধরে চলে ওদের দলবদ্ধ হয়ে নাচ— মাদল আর বাঁশির সঙ্গে৷ দক্ষিণে আছে ছোট্টো গ্রাম ভুবনডাঙ্গা৷ সেখানে আছে কিছু বাঙালি গৃহস্থ চাষির বাস৷ সুখে দুঃখে নীরব তাদের জীবনযাত্রা৷ নন্দলাল ঘুরে ঘুরে দেখতেন এদের ঘরদোর, আচার-অনুষ্ঠান৷ গৃহস্থালির সামান্যতম উপকরণও তাঁর চোখ এড়িয়ে যেত না৷ সব কিছুর মধ্যে থেকে তিনি সৌন্দর্য আহরণ করে আনতেন— মৌমাছি যেমন করে মধু সংগ্রহ করে এনে জমিয়ে রাখে তার মধুচক্রে৷ নন্দলাল দেখতেন নানা গাছ, তার ফুল-ফল-পাতার বৈচিত্র্য— পশুপাখি এমন কী কীটপতঙ্গও তাঁর সন্ধানী দৃষ্টির মধ্যে ধরা পড়ত৷ মনে করে নিয়ে আসতেন তাদের রূপ রেখা, তাদের রং, তাদের গতিভঙ্গী৷ বাড়িতে এসে টুকে রাখতেন স্কেচ করে৷ পরে ছবিতে করতেন তার অপরূপ প্রয়োগ৷ কেবলমাত্র দেখা নয়; করতেন তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা৷ তাদের সুখ-দুঃখ নিজের মনে তুলে নিতেন নিজেরই মতো করে৷ তাঁর এই ভালবাসাতে কেবল মানুষ নয়, পশুপাখি সকলেই সমান ভাগ পেত৷
আমরা দরকারে পড়লে লোককে শুনিয়ে শুনিয়ে বলি—‘চাষি-ভাই মজুর-ভাই’ কিন্তু সত্যিই তো তাদের ভাইয়ের মতো দেখি না৷ কিন্তু পাড়াগাঁয়ের নিতান্ত অশিক্ষিত দরিদ্রতম লোকটির সঙ্গেও তিনি কেমন করে এক হয়ে যেতেন ভাবলে অবাক হতে হয়৷
একবার স্থির হল কলাভবনে কেবল ছবি আঁকা ছাড়াও নানা কারুশিল্পের কাজ ছাত্রদের শেখানো হবে৷ সেজন্য দূর পল্লী থেকে এক বৃদ্ধ ওস্তাদকে নিয়ে আসা হল— তার কাছে বীরভূমের প্রসিদ্ধ গালার কাজ শিখে নেওয়া হবে৷ নন্দলাল নিজেও শিখবেন৷ সে এসেছে এমন পাড়াগাঁ থেকে যেখানে তখন পর্যন্ত কেউ একখানা সাইকেলও চোখে দেখেনি৷ এদিকে নন্দলালের নাম তখন ভারতবর্ষের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে৷ নানা দূর দেশ থেকে ছেলেরা এসেছে তাঁর ছাত্র হবার গৌরব অর্জনের জন্য৷
গালার পুঁটুলি নিয়ে লোকটি এসে চারদিক দেখে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল৷ আমতা আমতা করে বলতে লাগল—‘আমি হলাম তো গরীব মুরুক্ষু লোক—আমি আপনকারদের ডেঙার বাচ্চাদিগেরকে কী করে শেখ্খাবো বলুন৷ আর গালার কাজ? এ তো অতি নোংরা কাজ হল গিয়ে! বাচ্চাদের এ কাজ শিখে কী হবেক?’
নন্দলাল তাকে হাতে ধরে এনে পাশে বসিয়ে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে বলতে লাগলেন—‘তোমাকে আমরা গুরু বলে মানব বলেই তো এখানে নিয়ে এসেছি৷ তোমার ঘরে বসে তোমার সাকরেদদের যেমন করে শেখাও, তেমন করেই আমাদেরও শেখাবে৷’
‘ওরা না পারলে ধমক লাগাই—এখেনে বাবুদিগেরকে ধমক দিতে পারব কেনে?’ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করে ওস্তাদ৷
নন্দলাল অত্যন্ত বিনীত হলেন৷ বললেন—‘আমিও তো শিখব তোমার কাছে৷ আমি যদি ভুল করি আমাকেও ধমক লাগাবে, নইলে শিখব কেমন করে?’
বৃদ্ধ ওস্তাদ নিঃশব্দ হলেন৷ গালার কাজ নন্দলালই শিখলেন তাঁর অপূর্ব নিষ্ঠায় আর অনুপম শ্রদ্ধায়৷ ছাত্রদের কারুরই তেমন শেখা হল না৷ হবে কী করে? ওস্তাদ একদিন দেখিয়ে দিচ্ছেন এক ছাত্রকে—বার বার বিফল হচ্ছে ছাত্র৷ ওস্তাদ চটে গিয়ে খিঁচিয়ে উঠলেন—‘‘মা’শায় ক’বার দেখালাম— তুমি পেরে উঠছ নাই৷ বুঝতে পাইরছো নাই! তুমি কি গোরু হে?’— ছাত্র এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলেন গুরু নন্দলাল দূরে কোথায় বসে আপন মনে কাজ করছেন৷ গলা খাটো করে বৃদ্ধকে শাসালেন—‘এই বুড়ো গালাগাল দিচ্ছ?’
ব্যস ওস্তাদ অমনি গুটিয়ে গেলেন৷ ছাত্রদের শেখাও হল ঐ পর্যন্ত৷
ছাত্র গুরুর রেখাঙ্কন অনুকরণ করবার চেষ্টা করেছে— কিন্তু মানুষ নন্দলালের অনুসরণ করতে পারেনি৷ যিনি মহান তাঁকে গুরু বলে মেনে নেবার মধ্যে কোনও শক্তির প্রয়োজন হয় না৷ কিন্তু যে আপাতত নিতান্তই ছোট তাকে গুরু বলে মেনে নেবার শক্তি যে কত বড় তা বড় হলে যেন বুঝতে পারো।
(ক্রমশ)
ঋণ: বার্ষিক শিশুসাথী, ১৯৬৬