শিব ঠাকুরের মেয়ে পদ্মাবতী৷ বিয়ে হয়েছিল তাঁর জরৎকারু মুনির সঙ্গে৷ কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পরেই স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন৷ একটি ছেলে হয়েছিল তাঁর— নাম আস্তীক৷ সেও মা-কে ছেড়ে চলে গেছে৷ স্বামী আর ছেলেটিকে হারিয়ে পদ্মাবতী কালীদেহের তীরে গিয়ে বাস করছেন৷ তাঁর সঙ্গে আছে ‘নেতা’— বোন বলতে বোন, সই বলতে সই৷ বাপের ঘরে গিয়ে পদ্মা থাকতে পারেন না৷ সেখানে সৎমা চণ্ডীর সঙ্গে তাঁর বনিবনা নেই৷
বাবা শিব আর সৎমা চণ্ডীর নামডাক খুব৷ তাঁরা দু’জনেই মানুষের কাছে পুজো আদায় করে নিজেদের ক্ষমতা বেশ কায়েম করে ফেলেছেন৷ জাতে যারা বড়, সমাজে নামডাক যাদের আছে—তারা শিব আর চণ্ডীকে পুজো করে৷ তাঁদের চিন্তা নেই৷
পদ্মাও বুঝেছেন, ক্ষমতা দেখাতে না পারলে লোকের কাছে মান-সম্মান পুজো পাওয়া যায় না৷ নিজের নিজের ক্ষমতা জাহির করেই এক-এক জনে লোকের কাছে পুজো পেয়েছেন, দেবতা হয়ে উঠেছেন৷ কিন্তু পদ্মারই বা ক্ষমতা কম কী? দুনিয়ার যত সাপ তাঁর দখলে৷ ইচ্ছা করলেই তিনি সাপ লেলিয়ে দিতে পারেন সকলের বিরুদ্ধে, সাপের বিষে ছারখার করে ফেলতে পারেন সব কিছু৷ এই কিছুদিন আগেই তো তিনি খোদ শিব ও চণ্ডীকেই নিজের বিষের ক্ষমতাটা টের পাইয়ে দিয়েছেন৷ যখন নেহাৎ ছোট তখনই তাঁর তেজ কী! বাপের সঙ্গে যেতে যেতে একদিন তো মাঠের মধ্যে গোয়ালা আর হালুয়া চাষির দু’টো ছেলেকে রেগে গিয়ে তিনি বিষের ঘায়ে কাত করেই ফেললেন৷ গোয়ালা চাষিরা ভয় পেয়ে পদ্মাকে পুজো করে তবে রেহাই পেল৷ পদ্মা তাঁর পুজো আদায় করেছেন আগেই৷ তবে সে হল ইতর লোকদের কাছে৷ সমাজে উপরতলার লোকদের কাছ থেকে পুজো আদায় করতে হবে এবার পদ্মাকে৷ ধনে যারা বড়, ক্ষমতায়ও তারা বড়৷ তারা যদি একবার পুজো করে পদ্মাকে, তবেই সারা সমাজে তাঁর পুজো চালু হবে৷
ধনী ধনী লোকের কাছে পুজো আদায় করবার জন্যে পদ্মা এবার উঠে পড়ে লাগলেন৷ প্রথমেই তাঁর নজর পড়ল চম্পকনগরের সদাগর চন্দ্রধরের ওপর— ডাকনাম তাঁর চাঁদ সদাগর৷ ধনে মানে সদাগরের সমান কেউ নেই দেশে৷ তাঁর কাছে পুজো আদায় করতে পারলে আর ভাবনা নেই৷ পদ্মা চললেন চম্পকনগরে৷
কিন্তু চাঁদ সদাগর বড় শক্ত লোক৷ শিব ও চণ্ডীর সে পরম ভক্ত৷ আর কাউকে সে দেবতা বলে স্বীকারই করেন না৷ সদাগরের হাতে পুজো পাবার জন্যে পদ্মা অনেক চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছুতেই মন টলাতে পারেন না তাঁর৷ চম্পকনগরে নিজের পুজো প্রচার করতে গিয়ে পদ্মা বাধা পান চাঁদ সদাগরের কাছে৷ সদাগরের বৌ সনকা পদ্মাকে ভক্তি করে কিন্তু সদাগর অনুমতি না দিলে সনকার সাধ্য কী সে পদ্মার পুজো করে৷ সদাগরের অটল পণ— চম্পকনগরে সে পদ্মার পুজো হতে দেবে না৷ একবার জেলেদের ঘর থেকে পদ্মার পুজোর ঘট এনে সনকা নিজের ঘরে পুজোর আয়োজন করেছিল গোপনে আর তাই দেখতে পেয়ে সদাগর ক্ষেপে গিয়ে ঘট ভেঙে পুজো পণ্ডই করে দিলেন৷ শুধু কি তাই? পদ্মাকে সনকার পুজোর নৈবেদ্য খেতে দেখে সদাগর তাঁর কোমরই ভেঙে দিল ‘হেমতাল’ কাঠের ঘায়ে৷ সদাগরের হাতে লাঞ্ছনা পেয়ে পদ্মার হল বিষম রাগ৷ অপমানের শোধ নেবার জন্যে পদ্মাও মরিয়া হয়ে উঠলেন৷ তিনি পণ করলেন, সদাগরের এমন দুর্দশা করবেন তিনি, যাতে সে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পদ্মার কাছে হার মানে৷ চাঁদে-পদ্মায় লড়াই শুরু হল৷
পদ্মার আদেশে সদাগরের ছয়-ছয়টি ছেলেকে সাপে কেটে মারল৷ তবুও সদাগরের মন টলল না, পণ ভাঙল না৷ পদ্মাকে পরোয়া না করে সদাগর, পুত্রশোকে কাতর হয় না একটুও৷ সাহসে বুক বেঁধে সদাগর তাঁর কাজ করে যায়৷
চম্পকনগরের সব চেয়ে বড় সদাগর চন্দ্রধর৷ দেশে দেশে বাণিজ্য তাঁর৷ বড় বড় ডিঙায় নানা নদনদী সমুদ্র পাড়ি দিয়ে সদাগর বাণিজ্যে যায়৷ ছয়-ছয়টি ছেলে মারা যাওয়াতেও তাঁর বাণিজ্য বন্ধ হয় না৷ সদাগরের বৌ সনকার আবার ছেলেপিলে হবে৷ বৌকে বাড়িতে রেখে ভাগীদারদের সঙ্গে সদাগর আবার বাণিজ্যে যাবার আয়োজন করে৷ এবার সে দক্ষিণ পাটনে যাবে৷ চোদ্দোখানা বড় বড় ডিঙায় বাণিজ্যের সওদা সব সাজানো হল৷ কিন্তু বৌ সনকা তাঁকে বাণিজ্যে যেতে বারণ করেন এবার৷ ছেলে ছয়টিই মারা গেছে, সংসারে কে আছে আর? এত ধন দিয়ে কী হবে? বুড়ো বয়সে না হয় চরকা কেটেই কাটাবে দু’জনে৷
কিন্তু সদাগর বারণ মানেন না৷ ভাগীদারদের সবাই এসে জড়ো হয়েছে; পাইক মাঝিরা ডিঙা সাজিয়ে তৈরি হয়ে আছে৷ এখন কি আর পিছনে ফেরা চলে?
সকালে যাত্রামঙ্গল পড়ে সাধু বেরিয়ে পড়ল৷ কিন্তু পথেই অমঙ্গল দ্যাখে— বাঁয়ে কাল সাপ আর ডাইনে শেয়াল৷ অমঙ্গল দেখে সনকা হাতজোড় ক’রে আবার বারণ করেন সদাগরকে— একেই তো পদ্মার সঙ্গে বিবাদ আছে, তার ওপর আবার এই অমঙ্গল বিপদের মধ্যে না যাওয়াই ভাল৷ পদ্মার নাম শুনেই সদাগরের রোখ চেপে যায় আরও। একচোখ-কানা পদ্মার নাগাল যদি সে পায়ই, তবে হেমতাল কাঠের এক ঘায়ে তাঁর মাথা ভেঙে দেবে, পৃথিবীতে নিজের অপযশ সে রাখবে না৷
ডিঙায় ওঠবার সময় সদাগর বৌকে বলে দিল, বৌয়ের সন্তান হলে তাঁর নাম কী রাখবে:
পুত্র হইলে নাম থুইয় সুন্দর লক্ষ্মীন্দর৷
কন্যা হৈলে তার নাম চন্দনিমালা কর৷৷
ভাগীদারদের সঙ্গে সদাগর ডিঙায় গিয়ে উঠল৷ সদাগরের সঙ্গে যায় সোমাঞী পণ্ডিত, দৈবজ্ঞ রমাই, শালা সাধু শ্রীপতি, আত্মীয়-কুটুম্ব, বন্ধু-বান্ধব, চাকরবাকর কত শত৷ সবাই উঠল একে একে চোদ্দোখানা ডিঙায়— আর ভাসল।
(ক্রমশ)
ঋণ: পদ্মাপুরাণ, নারায়ণ দেব, বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর-চাঁদ সদাগর কথা