কাপড় পরার উদ্দেশ্য কী? এক উদ্দেশ্য হল খারাপ আবহাওয়া থেকে দেহকে রক্ষা করা৷ দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল লজ্জা নিবারণ করা৷ কিন্তু এই সব নয়, আরও আছে: বিয়ের সময় কনেকে যে সুন্দর শাড়িখানা পরিয়ে দেওয়া হয়— সে তাকে সুন্দর দেখাবে বলে৷ পূজার সময়, নিমন্ত্রণ বাড়িতে বা উৎসব দিনে তোমরা যে রঙ-বেরঙের জামা-কাপড় পর সে-ও তোমাদের সুন্দর দেখাবে বলে, সুতরাং কাপড় পরার আর একটা উদ্দেশ্য হল— সৌন্দর্য বৃদ্ধি বা অপরের কাছে প্রশংসা পাওয়া৷
আমার সুন্দর কাপড়-জামা দেখে অপরে তারিফ করছে— এ কে না চায়? কিন্তু এ-ও সব নয়, এ ছাড়াও আছে: কাপড় পরে ভালই দেখাচ্ছে কিন্তু আরাম হচ্ছে না, তা হলেও চলে না— বিশেষ করে বড় লোকদের, রাজা বাদশাদের৷ টাকা যখন তাঁদের আছে, তখন সুন্দর মিহি মোলায়েম কাপড় তাঁদের চাই বই কী! তাই প্রাচীনকাল থেকে দেশ-বিদেশের ধনী লোকদের জন্য মিহি, মোলায়েম, শৌখিন সব কাপড় তৈরি হয়েছে বিভিন্ন দেশে৷ আর আমাদের সবচেয়ে আনন্দ আর গর্বের কথা— এই ব্যাপারে আমাদের এই বাংলাদেশ— অবশ্য অবিভক্ত সাবেক বাংলাই ছিল সবার চেয়ে এগিয়ে৷ বাংলাদেশে নানা রকমের সব শৌখিন কাপড় তৈরি হত৷ এদের মাঝে একটির কথাই আজ তোমাদের বিশেষ করে বলব৷ এর নাম হচ্ছে মসলিন৷ এই কাপড় ঢাকায় তৈরি হত বলে এর নাম ছিল ঢাকাই মসলিন৷ কবি গেয়েছেন—
বাংলার মসলিন, বোগদাদ, রোম, চিন
কাঞ্চন মূল্যেই কিনতেন একদিন।
এ কাপড় কতটা সূক্ষ্ম বা মিহি ছিল দু’একটা ঘটনার কথা বললেই তা তোমরা বুঝতে পারবে৷ পারস্যের রাজদূত মহম্মদ আলিবেগ পারস্যের সম্রাটের জন্য ষাট হাত একখানা কাপড় ছোট্টো একটা নারকেল মালায় পুরে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ ঢাকার বস্ত্রশিল্পের ইতিহাস যিনি লিখেছেন, তিনি তাঁর বইয়ের এক জায়গায় বলেছেন, ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে মসলিন তৈরির আধসের সুতো তাঁর সামনে খোলা হলে তিনি দেখলেন— এ সুতো ২৫০ মাইলের মতো লম্বা৷ অন্য বিবরণীতে পাওয়া যায়, ২০ হাত লম্বা ২ হাত চওড়া একখানা মসলিন একটা আংটির ভিতর দিয়ে অনায়াসে টেনে বের করা যেত৷ আর এদের ওজনের কথা শুনলেও তোমরা চমকে যাবে: ১৪০ থেকে ১৬০ হাত লম্বা একখানা মসলিনের ওজন হত মাত্র ৪ তোলা (৪৪ গ্রাম)৷ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ১৭৫ হাত লম্বা একখানা মসলিনের ওজন হয়েছিল চার তোলা৷
আর এই সব মসলিনের রকমও ছিল কত৷ দু’চারটির নাম শোনাচ্ছি তোমাদের৷ প্রথমেই ধরো— ঝুনা মসলিন৷ এর সুতো ছিল মাকড়সার জালের মতো মিহি৷ পাশ্চাত্যের লোকেরা বলতেন, এ কাপড় বিদ্যাধরী বা পরীদের তৈরি, মানুষের পক্ষে এ কখনও করা সম্ভব নয়৷
দুই— রং মসলিন৷ তিন— সাকর আলি মসলিন৷ নবাব বাদশারা এই সব মসলিন ব্যবহার করতেন৷ চার— খাস মসলিন৷ পাঁচ— শবনম বা সান্ধ্য-শিশির৷ শবনম মসলিন ঘাসের উপর মেলে দিলে দেখা যেত না৷ নবাব আলিবর্দী খাঁ পরীক্ষার জন্য এই মসলিন একবার ঘাসের ওপর মেলে দিয়েছিলেন৷ একটা গরু এসে সেখানকার ঘাস খেতে গিয়ে টের না পেয়ে কাপড় শুদ্ধই সেখানকার ঘাস খেয়ে ফেলেছিল৷ ইউরোপীয় কবিরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘বায়ুর জাল’৷ আর এক রকমের মসলিন ছিল, তার নাম হচ্ছে আবরোয়ান৷ এটা জলের মধ্যে ফেললে দেখাই যেত না৷
এছাড়া আরও ছিল। তাদের নাম হচ্ছে— আল্লাবাল্লে, তঞ্জেব, তরন্দাস, নয়নসুক, বদনখাস, সরবন্দ, সরবতি— ইত্যাদি৷ সরবন্দ আর সরবতি— এ দুটো দিয়েই পাগড়ি করা হত৷ কুমীস বলে এক রকম মসলিন ছিল, এ দিয়ে নবাব-বাদশারা তাঁদের কুর্তা বা জামা তৈরি করাতেন৷
সাদা প্লেন মসলিন ছাড়া ডুরে মসলিনও তৈরি হত৷ ডুরে মসলিনও অনেক রকমের ছিল। এদের নাম ছিল ডোরাকাটা, রাজকোট, ডাকান, পাদশাহীদার, কাগজাই, কলাপাত— ইত্যাদি৷
ডুরের মতো আর এক রকম মসলিন ছিল— তার নাম চারখানা৷ চারখানাও নানা রকমের ছিল— যেমন নন্দনসাহী, আনার-দানা, কবুতর-খোপা, সাকুতা, বাছাদার, কুস্তিদার৷
ফুলকাটা, বুটিদার মসলিনের নাম ছিল জামদানী৷ জামদানীও শুধু এক রকম নয়— তোড়াদার, কাবেলা, বুটিদার, তেরছা, জলবার, পাল্লাহাজার মেল, দুবলিজাল, ছাওয়াল, ডুরিয়া, গেদা, সাবুর-গা ইত্যাদি নানা রকমের পাওয়া যেত৷
জামদানী মসলিন শুধু নবাব-বাদশাদের জন্যই তৈরি করা হত৷ তিন গিনির বেশি দামের মসলিন তাঁতিদের অপরের কাছে বিক্রি করার অধিকার ছিল না, সুতরাং বিদেশি বণিকেরা এ নিয়ে ব্যবসা করতে তেমন সুযোগ পেতেন না৷
এ ছাড়া আর এক রকম মসলিন ছিল, তার নাম মলমল খাস৷
যেসব তাঁতি-জোলারা এই সব মসলিন তৈরি করত, নবাব-বাদশারা তাদের নিষ্কর ভূমি দান করতেন, তাছাড়া নগদ টাকাও পুরস্কার দিতেন৷ ভাল মসলিনের দাম সেকালেই ২০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত ছিল৷ এই ধরনের এক খানা মসলিন তৈরি করতে ছ’মাস থেকে এক বৎসর পর্যন্ত সময় লাগত৷ পলাশীর যুদ্ধের আগে পর্যন্ত ঢাকায় প্রতি বৎসর প্রায় ৩০ লক্ষ টাকার মসলিন বিক্রি হত৷ দেশ বিভাগের আগে পর্যন্ত ঢাকা জেলার বাবুর হাটে প্রতি হাটবারে মসলিন বিক্রি হত৷ এ থেকে আয়ও একলক্ষ থেকে দেড়লক্ষ টাকার কম ছিল না৷
তোমরা হয়তো জানতে চাইবে— কতদিন আগে আমাদের দেশে এই শিল্পটা শুরু হয়৷ তা হাজার তিনেক বৎসরেরও আগে বলা যেতে পারে৷ খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলে মসলিনের উল্লেখ আছে৷ তোমরা বলবে, ওরা জানলে কী করে? তার উত্তর হচ্ছে বহু প্রাচীনকাল থেকেই স্থলপথে আলেকজান্দ্রিয়া হয়ে মসলিন রোম, গ্রিস প্রভৃতি দেশে চালান যেত৷ তুরস্কের সুলতানরা এখান থেকে মসলিন নিয়ে ব্যবহার করতেন৷ এটা ছিল তাঁদের বিলাস৷ আর তুরস্কের রাজধানী ছিল মোসল নগর৷ এই মোসল নগর থেকেই কাপড়ের নামটা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তাই অনেক পণ্ডিতের অনুমান এই মোসল কথাটা থেকেই কাপড়ের নাম হয়েছে মসলিন৷
এখন তোমরা হয়তো জানতে চাইবে— এই এত মিহি মসলিন কী দিয়ে তৈরি হত— মানে তুলো, রেশম না অন্য কিছু দিয়ে? জেনে রাখো— মসলিন কাপড় তুলোর সুতো দিয়ে তৈরি হত, যা দিয়ে আমাদের সাধারণ সুতির কাপড় তৈরি হয়৷ কিন্তু তুলো হলেও, এ এক বিশেষ ধরনের তুলো— নাম এর কোটি বা শিরজ তুলো৷ ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ থেকে উত্তর দিকে মাত্র ৬৪-৬৫ মাইল জায়গা জুড়ে এই তুলোর চাষ হত৷ তাঁত চলত ঐ জেলারই সোনারগাঁও, নোয়াগাঁ, মুড়াপাড়া, কাপাসিয়া— এই সব জায়গায়৷ এছাড়া ময়মনসিংহের বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ি প্রভৃতি জায়গায়ও মসলিন তৈরি হত৷ ঢাকাই মসলিনের অর্ধেক আসত কিশোরগঞ্জ থেকে৷ সেখানকার তাঁতিরা এই মসলিনের টাকায় একুশরতন মঠ তৈরি করেছিল!
এখন মসলিনের সুতো কাটা সম্বন্ধেও দু’চার কথা জেনে রাখা দরকার তোমাদের৷ কার্পাস— গাছে ফেটে গেলে— তা দিয়ে মসলিনের সুতো কাটা চলত না৷ বীচির গায়ে তুলো লেগে থাকতে থাকতেই গাছ থেকে সেগুলি তুলে নেওয়া হত৷ এই তুলো ধোনা, পাট করা এবং তা থেকে সুতো কাটতে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করা হত৷
পনের থেকে বিশ বৎসর বয়সের স্থির, শান্ত, ধৈর্যবতী মেয়েরা টাকুতে সুতো কাটত৷ আবহাওয়া ভাল থাকলে বৃদ্ধারা পাড়ার সুতো কাটুনীদের ডাকতেন৷ কাটুনীরা সকালে স্নান করে ঠাণ্ডা মাথায় সুতো কাটা শুরু করত৷ আবহাওয়া খারাপ বুঝলেই সুতো কাটা বন্ধ করে দেওয়া হত৷ মসলিন তৈরির সময় ছিল সাধারণত আষাঢ়, শ্রাবণ এবং ভাদ্র মাস, কারণ এই সময়কার বাতাসে জোলো ভাব থাকায় সুতো কেটে যাবার সম্ভাবনা কম থাকত৷ এছাড়া কাপড় বোনবার সময় তাঁদের নিচে জলভরা সব পাত্র রেখে দেওয়া হত৷
এখনও অবশ্য ঢাকাই মসলিন আছে— কিন্তু মসলিনের সে দিন আর নেই৷ ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে নটিংহাম শহরে সুতোর কল প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকেই বাংলার মসলিন-শিল্পের অবনতি শুরু হয়ে গেল।
ঋণ: বার্ষিক শিশুসাথী, ১৯৬৬