Categories
পুরাণপাড়া |

দানবীর রাজা হরিশ্চন্দ্রের কথা

4118 |
Share
| ১৯ অক্টোবর, ২০২০
মনোমোহন রায়

লেখক কলিকাতা কমলা হাই স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন

রাজা হরিশ্চন্দ্রের এই দুটি ছবিই এঁকেছেন রাজা রবিবর্মা; চিত্র সৌজন্য: Wikipedia

অতি প্রাচীনকালে কোশলে (অযোধ্যায়) হরিশ্চন্দ্র নামে এক রাজা ছিলেন৷ তিনি যেমন দাতা, তেমনি ধার্মিক এবং সত্যবাদী ছিলেন৷ তাঁর কাছে যে যা চাইত তাই পেত৷ শীঘ্রই তাঁর সুনাম স্বর্গে ও মর্ত্যে ছড়িয়ে পড়ল৷ একদিন ইন্দ্রের সভায়, বশিষ্ঠ মুনির মুখে, বিশ্বামিত্র হরিশ্চন্দ্রের দানের সুখ্যাতি শুনলেন৷ ঋষির ইচ্ছা হল, তিনি পরীক্ষা করবেন হরিশ্চন্দ্র কেমন দাতা৷ এর কিছুদিন পরে সুযোগও এসে গেল৷

স্বর্গের পাঁচজন অপ্সরা কোনও অন্যায় করায় ইন্দ্র তাদের শাপ দেন৷ তারা মানবী হয়ে বিশ্বামিত্রের তপোবনে বাস করতে থাকে৷ একদিন তপোবনে ফুল তুলতে গিয়ে তারা গাছের ডাল ভেঙ্গে ফেলে৷ এতে বিশ্বামিত্র তাদের গাছের ডালে বেঁধে রাখেন৷ দৈবক্রমে রাজা হরিশ্চন্দ্র সেই বনে শিকার করতে আসেন৷ বালিকাদের করুণ কান্না শুনে রাজা তাদের বাঁধন খুলে দিলেন৷ তারা মুক্ত হয়ে স্বর্গে চলে গেল৷ পরদিন সকালে বিশ্বামিত্র ফুল তুলতে এসে তাদের দেখতে পেলেন না৷ তিনি ধ্যান করে জানতে পারলেন, রাজা হরিশ্চন্দ্র তাদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন৷ মুনির বড় রাগ হল৷ তিনি রাগে আগুন হয়ে অযোধ্যায় চললেন৷

রাজা ঋষিকে পরম আদরে বসিয়ে করজোড়ে বললেন, ‘রাজর্ষি! দাসের প্রতি কী আদেশ?’ বিশ্বামিত্র রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন— ‘রাজা! আমি যে বালিকাদের বেঁধে রেখেছিলাম, তুমি কার হুকুমে তাদের ছেড়ে দিলে?’ রাজা ভয়ে ভয়ে বললেন— ‘দেব! আমি না জেনে অন্যায় করেছি, আমাকে ক্ষমা করুন৷ এখন আপনি যা চান আমি তাই দেব৷’ বিশ্বামিত্র বললেন, ‘বটে! বড় দানের বড়াই হয়েছে তোমার! বেশ, আমাকে তোমার সমস্ত রাজ্যটা দান কর দেখি!’ হরিশ্চন্দ্র তাই করলেন৷ তিনি তাঁর সমস্ত রাজ্য বিশ্বামিত্রকে দান করলেন৷ তখন মুনি দানের দক্ষিণা চাইলেন৷ রাজা ভাণ্ডীকে সাত কোটি সোনার মোহর দক্ষিণে দিতে আদেশ করলেন৷ বিশ্বামিত্র বাধা দিয়ে বললেন, ‘রাজা! তুমি না ধার্মিক! কার ভাণ্ডার থেকে টাকা নিচ্ছো? ভুলো না, তুমি তোমার সমস্তই আমাকে দান করেছ! এখন এ রাজ্য, রাজপুরী, রাজভাণ্ডার, রাজভূষণ, রানির অলঙ্কার— সবই আমার৷ এতে তোমার কোনও অধিকার নেই৷ অন্য কোথাও থেকে টাকা এনে আমাকে দক্ষিণা দাও৷ আর রানি শৈব্যা ও পুত্র রোহিতাশ্বকে নিয়ে তুমি আমার রাজ্য থেকে বাইরে চলে যাও৷’

নিজের ভুল বুঝে রাজা লজ্জিত হলেন৷ তিনি মুনির কাছ থেকে সাত দিনের সময় চেয়ে নিলেন এবং রাজপোষাক ছেড়ে স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে কাশী চলে গেলেন৷ সেখানে রানি শৈব্যা ও রোহিতাশ্বকে এক ব্রাহ্মণের কাছে বিক্রয় করলেন৷ তিনি নিজেও এক শ্মশান-চণ্ডালের চাকর হয়ে থাকলেন৷ এইভাবে সাত কোটি মোহর যোগাড় করে বিশ্বামিত্রকে দক্ষিণা দিলেন৷

হায়! অদৃষ্টের কথা কে বলতে পারে! একদিন যিনি রাজচক্রবর্তী ছিলেন, যাঁর সুখের জন্য শত শত দাসদাসী ব্যস্ত থাকত, তিনি এখন শ্মশান-চণ্ডালের দাস৷ শ্মশানে ডোমের কাজ করেন ও শূকর চড়ান৷ আর রাজরাণী শৈব্যা, শত শত দাসী যাঁর সেবা করত, তিনি হলেন অন্যের কেনা দাসী৷ রাজকুমার রোহিতাশ্বর ব্রাহ্মণের পুজোর ফুল তোলে ও ফাইফরমাস খাটে৷

এইভাবে কিছুদিন গেল৷ তারপর একদিন ফুলবাগানে রোহিতাশ্বকে এক কালসর্প দংশন করল৷ কুমার ঢলে পড়ল৷ শৈব্যা জগৎ অন্ধকার দেখলেন৷ যার মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি সমস্ত দুঃখকষ্ট ভুলে ছিলেন, সেই স্নেহের পুতুলও আজ চলে গেল৷ তিনি পুত্রশোকে লুটিয়ে কাঁদতে লাগলেন৷ কিন্তু মৃত পুত্রের সৎকার না করলে নয়৷ আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই, সুতরাং নিজেই মরা ছেলে কোলে করে নিজেই শ্মশানঘাটে চললেন৷

সেদিন ভয়ানক দুর্যোগ৷ ঘোর অন্ধকার রাত৷ আকাশ মেঘে ঢাকা৷ ঘাটের কড়ি আদায় করবার জন্য হরিশ্চন্দ্র শ্মশানে দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ শৈব্যা মৃত-পুত্র নিয়ে শ্মশানে উপস্থিত হলেন৷ হরিশ্চন্দ্র বললেন, ঘাটের কড়ি না পেলে তিনি মড়া পোড়াতে পারবেন না৷ শৈব্যা কী করেন! তিনি অপরের কেনা দাসী, পয়সা কোথায় পাবেন! মনের দুঃখে তিনি হরিশ্চন্দ্রের নাম ধরে কাঁদতে লাগলেন৷ এই সময়ে একবার বিদ্যুৎ চমকাল৷ সেই আলোতে হরিশ্চন্দ্র শৈব্যা ও মৃতপুত্র রোহিতাশ্বকে চিনতে পেরে কেঁদে উঠলেন৷ শৈব্যাও ডোমের পোষাক পরা রাজাকে চিনে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন৷ দুজনে এভাবে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করলেন৷ পরে চিতা প্রস্তুতও করলেন৷ শেষে নয়নের মণি রোহিতাশ্বকে চিতায় শুইয়ে, রাজা ও রানি ঐ চিতায় প্রাণত্যাগ করবেন স্থির করলেন৷ এমন সময়ে স্বয়ং ধর্মরাজ উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে রাজন! ধর্ম ও সত্যের প্রতি তোমার অনুরাগে দেবতারাও তুষ্ট হয়েছেন৷ তুমি প্রকৃতই ধার্মিক ও সত্যবাদী৷ এই দেখ, তোমার পুত্র বেঁচে উঠেছে৷’ এই বলে রোহিতাশ্বের গায়ে হাত বোলাতে সে বেঁচে উঠল৷ বিশ্বামিত্রও তখন সেখানে এসে বললেন, ‘হরিশ্চন্দ্র! তোমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে৷ তুমি সত্যই দানবীর৷ তোমার রাজ্য তুমি ফিরিয়ে নাও৷ রাজ্যে ফিরে গিয়ে, স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে রাজ্যসুখ ভোগ করে, পরে অক্ষয় স্বর্গলাভ কোরো৷’

তখন রাজা ও রানি পুত্রসহ অযোধ্যায় ফিরে গেলেন৷ বহুদিন রাজ্যসুখ ভোগ করে অবশেষে হরিশ্চন্দ্র স্বর্গে যান৷

ঋণ: ছোটদের ইতিকথা