চিরিপ চিরিপ চিপ চিপ চিপ, কিচির কিচির কিচ কিচ কিচ . . . রাত ভোর হতে না হতেই খোলা জানলার পাশে ডাকাডাকি শুরু হয়ে যায়। বারান্দার কোনার টবে অ্যালামান্ডা গাছের সাথে জড়িয়ে জড়িয়ে উঠেছে সাদা অপরাজিতা লতা; সেই গাছেরই আশেপাশে এবং ডালের ওপর বসে থাকে অন্তত দশ থেকে বারোটা চড়াই পাখি। House Sparrow (১৫ সেমি)। বৈজ্ঞানিক নাম Passer domesticus। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি চলে ওদের আনাগোনা আর অবিরাম ডাকাডাকি। টবের পাশে থালায় করে চাল রেখে দিই। পাখিগুলো খুঁটে খুঁটে চাল খায়, সারা বারান্দা জোড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারপর ফু্রুৎ করে উড়ে চলে যায়।
পুরুষ চড়াইয়ের মাথার চাঁদি ছাই ধূসর। চোখের পেছনের গাঢ় বাদামী রঙ পিঠে এসে ছড়িয়ে পড়েছে। গাল সাদা, চোখের চারপাশ কালো। এছাড়া মোটা তিনকোনা ঠোঁট থেকে চোখ অবধি কালো টানা দাগ আছে। পিঠ ও ডানা ফিকে মরচে বাদামীর ওপর বড় বড় কালো ছোপে ভরা। ডানার ওপর আড়াআড়ি ভাবে সাদা দুটি টানা দাগ আছে। বুকের ওপরের অংশে টিপ ছাপের মতন একটি কালো ছাপ আছে। বুক ও পেট ধূসরাভ সাদা। সময় বিশেষে ঠোঁট কালো অথবা ধূসর রঙেরও হয়, পা ফিকে পাটকিলে রঙের।
স্ত্রী চড়াই; চিত্র সৌজন্য: উইকিপিডিয়া
স্ত্রী-পাখির গায়ের রঙ ধূলোর মতন ধূসর। চোখ বরাবর সরু বাদামী টানের ওপর লম্বা ঘি-রঙা ভুরু, যেটি চোখের পেছনে আরও স্পষ্ট। মাথা ও পিঠে ঘিয়ে বাদামীর ওপর কালো পাটকিলে ছোপ আছে। শরীরের নিচের অংশ ধূসর সাদা, পেটের দু’ধার হালকা ঘি-রঙা ঠোঁট ও পা ময়লা গোলাপী। অপরিণত পাখিগুলি স্ত্রী চড়াইয়ের মতোই দেখতে তবে আরও ফ্যাকাশে।
আবাসস্থল: চড়াই এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সর্বত্রই কম বেশি সংখ্যায় এদের দেখা যায়।
বিচরণক্ষেত্র: লোকালয়, বাজার, রেলস্টেশন। এছাড়া চারণভূমি ও কৃষিজমি সংলগ্ন গাছপালাতেও এদের আনাগোনা। তবে এরা ঘন জঙ্গল বাঁচিয়ে চলে।
স্বভাব: চড়াই সাধারণত জোড়ায় অথবা ছোট বড় দলে থাকে। এরা সর্বক্ষণ মানুষের কাছ-ঘেঁষে থাকে। সন্ধ্যারাতে ঝাঁকবেঁধে বাজার স্টেশন কিংবা গাছপালার মধ্যে আশ্রয় নিয়ে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দেয়। মাঝে মাঝেই এরা মাটিতে নেমে এসে ধূলো-স্নান করে।
খাদ্য: খাবার ব্যাপারে এরা মানুষের ওপর নির্ভরশীল। বাজার দোকানে ঢুকে চাল, ডাল, গম, চিনি যা পায় খুঁটে খুঁটে খায়। শস্য দানা, বীজ, ফুলের মধু, পোকামাকড় ইত্যাদি সবই খায়। রান্নাঘরের আবর্জনা থেকেও খুঁটে খেতে দেখা গেছে। কোথাও কোনও শস্য অথবা ছোট ফল পাকলে ঝাঁকে ঝাঁকে চড়াই গিয়ে সেখানে হাজির হয়।
বাসা: বাড়ির ঘুলঘুলিতে, দেওয়ালের ফাঁকে, কার্নিশে, ছাদের ফাটলে, ব্রিজের নিচে, গাছের কোটরে কিংবা খড়ের চালেও নানারকমের আবর্জনা জড়ো করে চড়াই পাখি বাসা বানায়। বাসার আকার সাধারণত গোল অথবা ডিম্বাকৃতি হয়।
ডিম: একটি চড়াই বছরে একাধিক বার ডিম পাড়ে ও বাসা বাঁধে। এপ্রিল থেকে জুন মাসই এদের ডিম পাড়বার প্রশস্ত সময়। স্ত্রী পুরুষ দুজনেই বাসা তৈরি ও বাচ্চা প্রতিপালনে পরস্পরকে সাহায্য করে। ডিম ফুটতে ১৪ দিন সময় লাগে। এরা একসাথে সাধারণত ৩টি থেকে ৫টি ডিম পাড়ে। ডিমগুলি ধূসর সাদাটে সবুজ রঙের হয় ও তার ওপর কালো ছোপ ছিটে ভরা থাকে। অনেক চড়াই ডিম পাড়ে না। তারা ঘরের মধ্যে বাসা না বেঁধে বাড়ির আশেপাশের ঘন পাতার গাছগুলিতে দল বেঁধে বাস করে। তাদের সমবেত ডাকাডাকিতে মনে হয় যেন বাজার বসেছে।
ঋণ: The Book of Indian Birds, Salim Ali; বাংলার পাখি, অজয় হোম; বাংলার পাখপাখালি: প্রথম খণ্ড, কনাদ, সন্দীপ, শান্তনু, ক্ষৌণীশ