Categories
বিজ্ঞানমন্দির |

চাপ নিওনা প্লিজ

1188 |
Share
| ২১ অক্টোবর, ২০২০
ড: সায়নী মুখোপাধ্যায়

স্নায়ু-অন্তঃস্রাব গবেষক, অন্তঃস্রাব গবেষণা কেন্দ্র, রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

(বাঁদিক থেকে) প্রথম ছবি: HPA Axis-এর ইলাস্ট্রেশন। চিত্র সৌজন্য: integrativepainscienceinstitute.com। দ্বিতীয় ছবি: অলংকরণ: ড: সায়নী মুখোপাধ্যায়।

প্লিজ আর চাপ নিওনা! আমি জানি তোমাদের অনেক চাপ— এই ধরো পড়াশুনার চাপ— যারা উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছ তাদের আবার শুধু ভাল রেজাল্ট করার চাপ নয়; এর পরে কোন কলেজে কী নিয়ে পড়বে সেইটার ও চাপ। এই পড়াশুনার চাপ ছাড়া আবার তোমাদের অন্যরকম চাপ ও নিতে হয়। যেমন ধরো, বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়ার চাপটা যুক্ত হয় তাহলে সেটা তো ঠিক গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতন।

কিন্তু এটা কী ভেবে দেখেছো এত্তো চাপ নিয়ে কারুর কোনও ভাল হয়েছে কি? বরং মানুষ বিভিন্ন রকম শারীরিক বা মানসিক সমস্যার কবলে পড়েছে। এখন ভাবছ এই এলেন একজন জ্ঞান দিতে যিনি নিশ্চয়ই কোনও দিন চাপ বাবাজীর খপ্পড়ে পড়েন নি।

সত্যি কথা বলব? . . . চাপ কিন্তু সবার জীবনে থাকে। তোমরা কোনও একটি মানুষকেও খুঁজে পাবে না যার জীবনে চাপ হানা দেয়নি। তাই, এরকম ভাবাটাই ভুল যে ‘দেখ, ও কী বিন্দাস আছে!’

আমি তো প্রচুর পরিমাণে চাপের সম্মুখীন হতাম (এখনও হই)। ঠিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার আগে অথবা পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার আগে। তখন আমার যা যা হত সেইগুলোর বর্ণনা দিলে হয়তো দু-একটা তোমাদের সাথেও মিলে যেতে পারে। যেমন ধরো, ঠিক ওই সময়গুলোতে সে কী পেট কামড়ানো— মনে হচ্ছে এই বুঝি পেটের ভিতর সব নাড়ি-ভুঁড়ি জড়িয়ে গেল, বুক ধড়ফড়, পা-কামড়ানো, বমি পাওয়া ইত্যাদি হত। আর আশ্চর্যজনক ভাবে প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার ঠিক পরে অথবা পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পরে সবকিছু গায়েব হয়ে যেত। মনে হত, শুধু ঐটুকু সময়ের জন্যই কেন এরকম হয়? এখন বুঝতে পারি যে কেন এরকম হয়; আর সেটাই তোমাদের আজকে বলব, আর কিছু টিপসও দেব কী করে এইরকম বেহাল অবস্থা থেকে তোমরা বাঁচতে পারো।

তাহলে চল, আগে জেনে নিই এই চাপের উৎপত্তি কোথা থেকে?

চাপের উৎসস্থল জানতে গেলে আগে তোমাদের মস্তিকের হাইপোথালামিক-পিটুইটারি-অ্যাড্রিনাল এক্সিস (HPA Axis) সম্পর্কে একটু বুঝতে হবে। আশাকরি এই নামগুলোর সাথে তোমাদের আগেই কিছুটা পরিচয় আছে; তবুও, আমি একটু সহজ করে তোমাদের বুঝিয়ে দিই।

হাইপোথ্যালামিক— পিটুইটারি— অ্যাড্রিনাল (এইচপিএ) অক্ষ হল কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের (central nervous system) হাইপোথ্যালামস এবং পিটুইটারি (হাইপোফাইসিস) গ্রন্থি এবং কিডনির বা বৃক্কের উপরে অবস্থিত অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিগুলির মধ্যে একটি নিউরোহর্মোন প্রতিক্রিয়া সিস্টেম।

হাইপোথ্যালামাসকে আমি আবার ছোট উস্তাদ বলে ডাকি। ভাবছ এও আবার হয় নাকি? . . . মানুষ তাদের কাছের মানুষ বা পোষ্যদের নামকরণ করে, আর আমি দেখো যত্তসব উদ্ভট কান্ড করছি! না না, কোনও অস্বাভাবিক ব্যাপার নয় কিন্তু এটা। এর কারণ, এই ছোট্ট একটা মস্তিষ্কের অংশতে অসংখ্য আন্তঃসংযুক্ত স্নায়ুকোষ রয়েছে যা স্নায়ুতন্ত্রকে অন্তঃস্রাব (endocrine) প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত করে এবং এই অন্তঃস্রাব প্রক্রিয়াটির জন্যই আমাদের চাপ ঘটিত অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, আবার অনেক সময় এটি সমস্যার সমাধানও করে থাকে। তাহলে এবার বুঝতেই পারছ কেন আমি এরকম নামকরণ করেছি।

ব্রেনের হাইপোথ্যালামাস দুটি খণ্ডে বিভক্ত; HPA অক্ষকে যেটি চালিত করে সেটি হল সামনের খণ্ড (Anterior lobe ) আর এই হাইপোথ্যালামাস থেকে স্ট্রেসের জন্ম হয়। কেবল মাত্র মনস্তাত্ত্বিক নয়, ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ, গর্ভাবস্থা এবং আমাদের হজমের গণ্ডগোলও কিন্তু এই HPA অক্ষের মাধ্যমে চাপ তৈরি করতে পারে।

আবার, আমাদের ঘুমের অভ্যাস (কম ও বেশি) দিন ও রাতের ছন্দ (সার্কেডিয়ান রিদম) চাপের প্রতিক্রিয়াগুলিকে বাড়াতে এবং কমাতে সাহায্য করে। অনেকক্ষেত্রে এইটা লক্ষ্য করা গেছে যে, দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ অনেকগুলি গুরুতর স্বাস্থ্য-সমস্যার কারণ হতে পারে— যার মধ্যে রয়েছে যেমন হতাশা, উদ্বেগ এবং ব্যক্তিত্বজনিত ব্যাধি। এছাড়াও রয়েছে উচ্চরক্তচাপ, অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন এবং স্ট্রোক-সহ সমস্ত প্রকার হৃদরোগ। এই অত্যাধিক চাপকে প্রতিরোধ করার জন্যও কিন্তু আমাদের দেহে একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে যেটাকে ‘ফাইট-বা-ফ্লাইট’ নামে ডাকা হয়। এখন চলো আমরা ‘ফাইট-বা-ফ্লাইট’কে বুঝে নিই আমাদের চারপাশের কিছু নিত্ত্যনৈমিত্তিক ঘটনা দিয়ে।

HPA অক্ষটি ঠিক আমাদের সমাজে বিচার ব্যবস্থার মতো। আর স্ট্রেস বা চাপকে আমি তুলনা করছি ছিঁচকে চোর (ছোট চাপ) বা ডাকাতের সাথে (বড় চাপ)।

একদিন অমাবস্যার রাতে হঠাৎ আমাদের মস্তিষ্কের বাড়িতে স্ট্রেস-চোর হানা দিল।

টের পেতেই মস্তিষ্কবাবু  থানায় অর্থাৎ হাইপোথ্যালামাস ও পিটুইটারিতে খবর দিল।

এখন থানায় কর্মরত পিটুইটারি-কনস্টেবল, বড় সাহেব হাইপোথ্যালামাসের কাছ থেকে এই খবর পেয়ে চোরকে ধরতে গেল। অর্থাৎ হাইপোথ্যালামাস থেকে CRH নিঃসরণ হল।

এই স্ট্রেস-চোরের নামে অভিযোগ নথিভুক্ত করল পিটুইটারি-কনস্টেবল। মানে পিটুইটারি থেকে ACTH নিঃসরণ হল।

এই অভিযোগের ভিত্তিতে (ACTH এর নিঃসরণে) মামলা আদালতে উঠল। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি হল আদালত। এবং সেই আদালতের বিচারপতির আদেশে অর্থাৎ glucocorticoids-এর (গ্লুকোকর্টিকয়েডস্‌) নিঃসরণে— স্ট্রেস-চোর এর শাস্তি হল। মানে স্ট্রেস বা চাপকে আয়ত্তে আনা গেল।

আশাকরি ব্যাপারটা বোঝাতে পারলাম। এখন আমাদের জেনে নিতে হবে কী করে এই HPA অক্ষকে আমরা নিজেদের মতন করে চালনা করতে পারি? সহজ কথায় বলতে গেলে বলতে হবে, কী করে আমরা স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট করব?

চাপ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল— শারীরিক অনুশীলন বা এক্সারসাইজ। তাই যখনই দেখবে একটু চাপ লাগছে . . . একটু হাঁটাহাঁটি করে এসো ছাদে গিয়ে। যাদের বাড়িতে ছাদ নেই, তারা উঠোনে, রাস্তায় যেখানে সুবিধা মনে হয় হাঁটো। তোমরা যারা খেলাধুলো করতে ভালবাসো তারা সেটাই করো; যারা নাচতে ভালবাসো তারা নাচ করো।

এই শারীরিক অনুশীলন ছাড়াও কিন্তু এইগুলো তোমরা চেষ্টা করতে পারো যেমন— লেখালিখি করো, আঁকো, বন্ধুবান্ধব ও পরিবারের সাথে সময় কাটাও, হাসির চলচ্চিত্র দ্যাখো; গান শুনলেও কিন্তু চাপ কমানো যেতে পারে। যেমন ধরো, ধীর গতির গান রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দনকে নিয়ন্ত্রণে আনে এবং স্ট্রেস হরমোনকে সাহায্য করে শিথিলতার প্রতিক্রিয়া জাগিয়ে তুলতে। পারলে প্রকৃতির শোভা দেখো, প্রকৃতি আমাদের শান্ত করে।

এছাড়াও গভীর শ্বাস প্রশ্বাসের অভ্যাস চাপ কমাতে সাহায্য করে। গভীর শ্বাস প্রশ্বাস দেহের প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রকে (Parasympathetic nervous system) সক্রিয় করে, যেটি শিথিলকরণ প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে।

তোমরা যারা বাড়িতে বেড়াল, কুকুর বা পাখি পোষো, ওদের সাথে আরও বেশি করে সময় কাটাও, দেখবে চাপ কখন পালিয়ে গেছে টেরও পাবেনা। এর কারণ কী জানো ? পোষা প্রাণীর সাথে আলাপচারিতা মস্তিষ্কে অক্সিটোসিনের (oxytocin) নিঃসরণ ঘটায়, যেটি আমাদের মনকে ফুরফুরে সতেজ বানাতে সাহায্য করে। এখন থেকে যখনই দেখবে যে চাপ বাবাজীবন তোমাদের জীবনে এন্ট্রি নিতে শুরু করছে, একদম ভয় পেওনা বরং নিজেকে এতটাই আত্মবিশ্বাসী করে তোলো যে চাপ যেন বাপ-বাপ করে পালায়।

১। Smith SM, Vale WW. The role of the hypothalamic-pituitary-adrenal axis in neuroendocrine responses to stress. Dialogues Clin Neurosci. 2006;8(4):383-395. ২। https://www.health.harvard.edu/mind-and-mood/six-relaxation-techniques-to-reduce-stress