Categories
ভাষাপুকুর |

মনসামঙ্গল (পর্ব ২)

604 |
Share
| ১৯ নভেম্বর, ২০২০
অনিল কাঞ্জিলাল

যামিনী রায়ের আঁকা মনসা ; সৌজন্য: Wikipedia

বাণিজ্যে চলল চাঁদ সদাগর৷ ষোলোশো মাঝিতে চোদ্দোখানা ডিঙা বায় রাতদিন৷ ডিঙা যেন উড়ে চলে আকাশে৷ হেকাদহ বেকাদহ, দহের পর দহ পেরিয়ে চলল সদাগর৷ জোকাদহে পড়ে হঠাৎ তাঁর ডিঙা আর চলতে চায় না৷ ঢেঁকির মতো পাঁচ সাতটা জোঁকে টেনে ধরেছে ডিঙা৷ চাঁদের ডিঙায় ছিল লাখো টাকার চুন৷ জলে গুলিয়ে সে-চুন ফেলে দিল জোঁকের গায়ে৷ সঙ্গে সঙ্গে রক্ত উঠে মরে গেল জোকাদহের যত জোঁক৷ আবার ছুটে চলল ডিঙা বাতাসের মতো বেগে৷ কাকড়দহ, কাঞ্চন নদী, হরিপুর এড়িয়ে ডিঙা পৌঁছল গিয়ে মহেন্দ্রনগরে৷ সেখানে সোনার শিবলিঙ্গ দেখতে পেয়ে চাঁদ পুজো করলেন দেবতাকে৷ ভবানীপুরে গিয়ে আবার চণ্ডীর সোনার প্রতিমা দেখে চাঁদ তাঁকেও পুজো করলেন আনন্দে৷ সমুদ্র বেয়ে যেতে যেতে চাঁদ খোঁজে কোথায় তাঁর দেবদেবীর ভাল প্রতিমা আছে৷ যেখানেই প্রতিমা দেখেন, সেখানেই ডিঙা থেকে নেমে পুজো করেন৷

যেতে যেতে এক সময় চাঁদ শুনতে পেলেন ডাঙায় কোথায় যেন খুব বাজনা বাজছে৷ নিশ্চয়ই কারা পুজো করছে দেবতার৷ ডিঙা তীরে ভিড়িয়ে চাঁদ পাইক মাঝি নিয়ে চললেন বাজনার জায়গায়৷ গিয়ে যা সে দেখলেন তাতে তাঁর মাথায় খুন চেপে গেল৷ একদল ‘তিয়র’ (জেলে) ঘর বানিয়ে ফুল ধুনো দিয়ে বাজনা বাজিয়ে পদ্মার ঘট পুজো করছে৷ আর যায় কোথায়? হেমতালের কাঠ দিয়ে পিটিয়ে চাঁদ নিজেই পদ্মার ঘট ভেঙে ফেললেন৷ তাঁর ষোলোশো পাইক মাঝি মিলে পদ্মার নৈবেদ্য লুট করল৷

পদ্মার পুজো পণ্ড করে সদাগর ডিঙায় গিয়ে উঠলেন৷ ডিঙা ছুটে চলল আবার৷ পদ্মাও চুপ করে বসে রইলেন না৷ সদাগরকে মজাটা টের পাইয়ে ছাড়বেন তিনি৷

নানা দহ পেরিয়ে চাঁদের ডিঙা দক্ষিণ সাগরে পড়তেই দারুণ ঝড় তুফান উঠল সাগরে৷ সে কী তুফান!

আকাশে উঠিয়া লাগে সাগরের পানি৷৷

ঝড় তুফানের মধ্যে অনেক কষ্টে সাবধানে ডিঙা বেয়ে পাইক মাঝিরা দক্ষিণ পাটনে এসে পৌঁছল৷ ঝড়ও তখন থেমে গেছে৷ আকাশ পরিষ্কার হয়েছে৷ সদাগরের আদেশে মাঝিরা ডিঙা ভেড়ালো চরে৷

রাক্ষসদের রাজ্য দক্ষিণ পাটন৷ রাজ্যের রাজা চন্দ্রকেতু৷ চোদ্দোখানা বড় বড় ডিঙা চরে ভিড়তে দেখে রাজা কোতোয়ালকে পাঠাল ব্যাপার কী দেখে তাকে জানাতে৷ কোতোয়াল চরে এসে ডিঙা ও অনেক লোকজন দেখে গিয়ে রাজাকে বলল, কোত্থেকে কারা যেন এসেছে রাজার রাজত্ব কেড়ে নিতে৷ রাজাও অমনি আদেশ দিল যুদ্ধের৷ সৈন্যসামন্ত নিয়ে কোতোয়াল গিয়ে হাজির হল চরে৷ ডাঙায় দাঁড়িয়ে কোতোয়ালের ফৌজ, আর ডিঙায় সদাগরের পাইক-মাঝি৷ দুই পক্ষে তুমুল ঝগড়া গালাগাল চলল কিছুক্ষণ৷ হাঁক ডাক শুনে সদাগর ডিঙা থেকে বেরিয়ে এসে কোতোয়ালকে বলল— সে এসেছে বাণিজ্য করতে, ঝগড়া লড়াইতে কী কাজ তাঁর? সদাগর একজনের হাত দিয়ে কোতোয়ালকে ভেট পাঠাল গুয়া (ভেজা সুপারি) আর পান৷ এ আবার কী জিনিস? কোতোয়াল তো ভেবেই পায় না, এ দিয়ে সে কী করবে৷ সদাগর বুঝতে পেরে কোতোয়ালকে বুঝিয়ে বলল যে, এর নাম ‘গুয়া পান’। এর চেয়ে ভাল জিনিস আর কিছু নেই। চিবিয়ে খেলে ঠোঁট সুন্দর হয় আর শরীরের তুষ্টি বাড়ে।

চাবাইয়া খাই যদি বড় পাই সুখ৷
শরীরেতে তুষ্টি বাড়ে সুন্দর হয় মুখ৷৷

সদাগরের কথা শুনে কোতোয়াল একমুঠো চুন পান আর গুয়া মুখে পুরে দিয়ে চিবোতে লাগল৷ আর যায় কোথায়? কোনও পুরুষ যারা এ-জিনিস কখনও খায়নি, সে পারবে কেন প্রথমেই খেয়ে সামলাতে? সুপারি চিবিয়ে কোতোয়ালের মাথা ঘুরতে থাকল৷ কাঁপতে কাঁপতে সে পড়ে গেল মাটিতে৷ মুখ দিয়ে রক্ত বেরলো তার৷

কোতোয়ালের অবস্থা দেখে তার লোকজনেরা তো কান্নাই জুড়ে দিল৷ সদাগর পড়ল বিপদে৷ ব্যাটা শেষে গোল না বাধায়৷ যাই হোক, মাথায় জল ঢেলে কোতোয়ালকে সে সুস্থ করে তুলল৷ কোতোয়াল আর কি সেখানে দাঁড়ায়! সে তখনি ছুটে গেল রাজার কাছে৷ রাজা পাত্রমিত্র নিয়ে বসে ছিল৷ কোতোয়াল গিয়ে তাকে বলল, কোথাকার কে এক সদাগর চোদ্দোখানা ডিঙায় ভ’রে মানুষের মুণ্ডুর মতো কী নারকেল আর গাছের ফল গুয়া না কী সব নিয়ে এসেছে তার পুরীতে বাণিজ্য করতে, সেই ফল খেয়ে সে মরেছিল আর কী!

কোতোয়ালের কথা শুনে রাজা হুকুম দিল, ফল সমেত সদাগরকে ধরে নিতে আসতে৷

কোতোয়াল চলল আবার সদাগরের কাছে৷ মনসা সদাগরকে জব্দ করবার সুযোগ খুঁজছিলেন৷ এই ফাঁকে তিনি এক বিধবা ঠাকরুণের রূপ ধরে চুপিচুপি গিয়ে রাজাকে বললেন— নারকেল বলে সাধু বিষফল নিয়ে এসেছে তাকে মারবার জন্য৷

রাজা ভয় পেয়ে গেল৷ সদাগরও কোতোয়ালের মুখে রাজার আদেশ শুনে সেই নারকেল নিয়েই রাজসভায় এসে হাজির হল৷ ঠাকরুণ যা বলেছেন, রাজা ঠিক তাই দেখল নিজের চোখে৷ সত্যিই বিষ কি না পরীক্ষা করবার জন্য রাজা তার বুড়ো দারোয়ান গিরিবরকে নারকেল খেয়ে দেখতে আদেশ করল৷ বুড়োর আয়ু তো এমনিতেই ফুরিয়ে এসেছে, বিষ ফল খেয়ে না-হয় দু’দিন আগে মরবে৷ বুড়োও রাজার মতলব বুঝতে পেরে জলে নেমে স্নান ও তর্পণ করে মরবার জন্যে তৈরি হয়েই নিল৷ তারপর নারকেলটা হাতে নিয়ে সে সেটায় ছোবড়া-সুদ্ধ  কামড় দিল।

ছোবা সহিতে বেটা কামড় ভেজাইল৷৷

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে না পেয়ে গিরিবর মাটিতে বসে দাঁতে শক্ত করে কামড়ে ধরে জোর টান দিল ছোবড়ায়৷

আর সঙ্গে সঙ্গেই দন্ত ভাঙ্গি গিরিবর মূর্ছিত হইল৷৷

রাজা চন্দ্রকেতু তাই দেখে কোতোয়ালকে আদেশ দিল সদাগরকে বেঁধে কারাগারে আটক করে রাখতে৷ কোতোয়াল আগে থেকেই চটে ছিল সদাগরের ওপর৷ রাজার হুকুম পেয়েই সে চটপট সদাগরকে ‘পোতা ঘরে’ নিয়ে গিয়ে তার হাত-পা শিকল দিয়ে বেঁধে একখানা পাথর চাপা দিয়ে ফেলে রাখল৷ দুঃখে হতাশায় সদাগর কেঁদে ফেললেন কারাগারে৷

এদিকে সদাগরের ডিঙার লোকজন খবর পেয়ে সদাগরকে ছাড়িয়ে আনবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল৷ সদাগরের চাকর তেড়া, ডাব ও ঝুনো নারকেল নিয়ে রাজার কাছে চলল৷ সঙ্গে একখানা কাটারিও সে নিল৷

তেড়ার হাতে নারকেল দেখেই রাজা তেড়ে উঠল৷ তেড়া শপথ করে বলল যে, নারকেল যদি বিষফল হয় তো চোদ্দোখানা ডিঙা ভরতি সমস্ত ধনই সে দিয়ে দেবে রাজাকে৷ তেড়ার কথা সত্যি কি না পরীক্ষা করবার জন্য রাজা আবার বুড়ো দারোয়ান গিরিবরকে ডেকে পাঠাল৷ বুড়ো আগেই নাকাল হয়েছে আবার নারকেল খাবার হুকুম পেয়ে সে তো মাথায় হাত দিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল৷ কিন্তু রাজার হুকুম— শেষপর্যন্ত গিরিবরকে রাজি হতেই হল৷ তেড়া তখন কাটারি দিয়ে একটা ডাব কেটে বুড়োর হাতে তুলে দিল৷ বুড়ো চোখ বুজে ভয়ে ভয়ে মুখে ঢেলে দিল ডাবের জল৷ কী মিষ্টি! কিন্তু এক ফোঁটা ডাবের জলে তার আশা মিটল না৷ তেড়া তখন দু’টো ঝুনো নারকেল কেটে দিল তাকে৷ বুড়ো সবটা জল খেয়ে ফেলল একসঙ্গে৷ খুব মিষ্টি শুনে রাজারও ইচ্ছে হল নারকেল খাওয়ার৷ তেড়াও ভাল একটা মিষ্টি নারকেল ভেঙে রাজাকে খেতে দিল৷ নারকেলের জল খেয়ে রাজা যেন আকাশের চাঁদ পেল হাতে-হাতে:

চক্ষু বুজিয়া রাজা জল পান কৈল৷
আকাশের চন্দ্র যেন হাতে হাতে পাইল৷৷
নারিকেল জল খাইয়া বোলে হরিহরি৷
এমত অমৃত পান কভু নাহি করি৷৷

রাজা তখন খুশি হয়ে সদাগরকে মুক্তি তো দিলই, তার সঙ্গে মিতালিও পাতাল৷ সদাগরও বুঝল, এই রাজার কাছেই তার বাণিজ্য জমবে ভাল৷ কম দামী জিনিসের বদলে বেশি দামী জিনিস নিয়ে সদাগর মুনাফা করতে পারবে অনেক৷ ডিঙা থেকে এক এক করে সমস্ত জিনিস এনে সদাগর রাখল রাজার সামনে৷ দাম যাচাই করবার আগেই সাধু রাজাকে খানিকটা ভাং খেতে দিল৷ ভাং খেয়ে রাজার লাগল নেশা৷ তখন সদাগর দিল একটা গোটা মর্তমান কলা৷ ভাঙের পর কলা খেতে ‘লাগে অতি মিঠা’৷

তারপর শুরু হল সদাগরের বদল-বাণিজ্য৷ এক একটি পানের বদলে দশগুণ মরকত আর গুয়ার বদলে মাণিক্য৷ পিপুলের বদলে সোনা, আর ঝিঙ্গা শশা বাঙ্গি ওল আলু কচুরমুখীর এক একটির বদলে এক একটি হীরা৷ কলাই, মুসুরী, খেসাড়ী ডালের বদলে ধামায় মেপে শতগুণ মুক্তা প্রবাল৷ এক একটি কুমড়োর বদলে পঞ্চাশ গুণ সোনা, আর পাকা ডালিম বেল ডৌয়া তরমুজ এক একটির বদলে দশ-দশটা সোনার ইঁট৷ ভেড়া ছাগলের বদলে সোনার হরিণ, মূলোর বদলে হাতির দাঁত৷

(ক্রমশ)

ঋণ: পদ্মাপুরাণ, নারায়ণ দেব, বেহুলা-লক্ষ্মীন্দর-চাঁদ সদাগর কথা