Categories
লোকশ্রুতির ঘাট |

সুলতান ও সন্ত

1002 |
Share
| ২১ নভেম্বর, ২০২০
রাজর্ষি চক্রবর্ত্তী

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক

চিত্র: (বাঁদিক থেকে প্রথম) টমাস ড্যানিয়েলের আঁকা নিজামুদ্দিন দরগার বাউলির ছবি, ১৮০২, (পাশের ছবি) তুঘলকাবাদের ধ্বংসাবশেষ; চিত্র সৌজন্য: ranasafvi.com ও wikipedia

আজ থেকে বহু বছর আগে— ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতাব্দীতে দিল্লিতে চলছিল সুলতানি শাসন। দিল্লি তখন পূর্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামীয় নগরী। বিভিন্ন সুলতানরা নিজের নিজের মতন করে বিভিন্ন দূর্গ, প্রাসাদ, মসজিদ-মাদ্রাসা, মিনার— আরও কত কী গড়ে তুলেছেন তখন! এভাবে একে একে তৈরি হয়েছে কুতুব-দিল্লি, কিলোখেরি, সিরি, জাহানপন্থা, তুঘলকাবাদ, ফিরোজাবাদ ইত্যাদি। এক এক সুলতান এক একটি শহর গড়ে তুলছেন ও এইভাবে দিল্লি হয়ে উঠছে বিভিন্ন শহরের সমষ্টি।

এত মানুষ এত কোলাহলের মধ্যে সাধনা করা মুশকিল। তাই মেহবুব-ই-ইলাহি, যাকে নিজামুদ্দিন আউলিয়া নামে আমরা বেশি চিনি, দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় থাকার পর গিয়াসপুরে এসে বসবাস করতে থাকেন কারণ জায়গাটা নিরিবিলি। এই গিয়াসপুরে তিনি যে খানকা (সুফি সাধকদের প্রার্থনা গৃহ) নির্মাণ করলেন, অচিরেই তা ধনী-দরিদ্র বিভিন্ন ধরণের মানুষের প্রাণের জায়গা হয়ে উঠল। এখানে তিনি সমস্ত ধরণের মানুষকে খাওয়াতেন ও তাদের ধর্মোপদেশ দিতেন। তাঁর গুরু, বাবা ফরিদগঞ্জ-ই-সক্করের মধুমাখা বাণী তিনি ছড়িয়ে দিতেন নিজের ভক্ত শিষ্যদের মধ্যে। তিনি মনে করতেন প্রেম-ভালবাসা দ্বারাই আল্লার কাছে পৌঁছানো যায়। তিনি দরিদ্র সাধারণ মানুষের কাছাকাছি থাকতে পছন্দ করতেন কিন্তু আমির ওমরাহ সুলতানের কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেন। তিনি মনে করতেন জীবনে দারিদ্রকে বরণ না করলে আল্লার কাছে পৌঁছনো যায় না।

তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতা গিয়াসুদ্দিন তুঘলক দিল্লির তক্তে বসে ঠিক করলেন তুঘলকাবাদ নামে একটি নতুন শহর নির্মাণ করবেন যা হবে তাঁর ক্ষমতার অভিজ্ঞান স্বরূপ। তিনি নির্দেশ দিলেন দিল্লির যত শ্রমিক আছে তাদের এই নির্মাণকার্যে অংশগ্রহণ করতে হবে। চার বছর ধরে চলল এর নির্মাণকাজ।

অন্যদিকে দিল্লির লোকেদের জলকষ্ট দূর করার জন্য মেহবুব–ই–ইলাহি ঠিক করলেন একটি বাওলি (কূপ) খনন করবেন তাঁর খানকার পাশে। এখান থেকে তৃষ্ণার্ত মানুষ পাবে তৃষ্ণা মেটানোর জল। এই কূপ খননের জন্য বিনা পারিশ্রমিকে শ্রমিকরা কাজ করতে লাগল। দিনের বেলা তারা তুঘলকাবাদ দূর্গ নির্মাণের কাজ করে আর রাতের বেলা চিরাগ (প্রদীপ) জ্বালিয়ে কূপ খননের কাজ করে।

এই খবর যখন সুলতানের কানে পৌঁছল তিনি খুব রেগে গেলেন। তিনি পয়সা দিয়ে শ্রমিকদের দূর্গ নির্মাণ করাবেন আর ঐ ফকির বিনা পয়সায় ঐ শ্রমিকদের দিয়ে কূপ খনন করিয়ে নেবেন? তিনি সুলতান। তাঁর ক্ষমতা, অর্থ, সম্মান সব কিছু আছে। তিনি তৈরি করছেন বিশাল তুঘলকাবাদ দূর্গ, যেখান থেকে তিনি হিন্দুস্থান শাসন করবেন। আর ঐ ফকির যার না আছে অর্থ, না আছে ক্ষমতা সে কি না মুফতে তারই শ্রমিকদের দিয়ে কূপ খনন করিয়ে নেবেন? এসব কি তার মতো ক্ষমতাবান সুলতানের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব? তিনি হুকুম জারি করলেন ঐ ফকিরের লোকেদের কেউ তেল বিক্রি করতে পারবে না। তেল না পেলে কী করে রাতে শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করায় ঐ ফকির দেখা যাক।

নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কাছে যখন এই খবর পৌঁছল তিনি তখন তাঁর এক শিষ্যকে ডেকে বললেন, যে কূপ যতটা খোঁড়া হয়েছে তাতে কোনও জল উঠছে কি না দেখতে। যদি জল ওঠে তবে সেই জল যেন তার কাছে নিয়ে আসা হয়। তাঁর প্রিয় একজন শিষ্য গিয়ে দেখলেন যে যতটা মাটি খোঁড়া হয়েছে তাতে চুঁইয়ে চুঁইয়ে খানিকটা জল উঠেছে ও জমা হয়েছে। সেই জল তিনি অঞ্জলি ভরে খোয়াজা (শিক্ষক/ গুরু) বাবা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার কাছে নিয়ে আসলেন। নিজামুদ্দিন আউলিয়া এই জলে মন্ত্র পড়ে দিলেন ও সেই জলেই চিরাগ জ্বলে উঠল।

নিজামুদ্দিন আউলিয়ার এই শিষ্যই পরে নাসিরুদ্দিন মাহমুদ চিরাগ দেহেলভি নামে পরিচিত হয়েছিলেন। আর কোনও সমস্যা রইল না। কুয়োর জলে চিরাগ জ্বালিয়ে কূপ খননের কাজ চলতে লাগল। ওদিকে চলতে লাগল তুঘলকাবাদের নির্মাণ কাজ। তবে নিজামুদ্দিন আউলিয়া তুঘলকাবাদের সম্পর্কে বললেন, ‘ইয়া বসে গুর্জর, ইয়া রহে উজার’ অর্থাৎ হয় যাযাবর গুর্জররা এই দূর্গে বাস করবে কিংবা এই দূর্গ জনশূন্য থেকে যাবে।

জল দিয়ে প্রদীপ জ্বালানোর কথা সুলতানের কানে গেল কিন্তু তিনি তখন বাংলা অভিযান নিয়ে ব্যস্ত। তাই তিনি ঠিক করলেন বাংলা অভিযান সেরে দিল্লি ফিরে নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে উচিৎ শাস্তি দেবেন।

নিজামুদ্দিন আউলিয়ার শিষ্যরা তাঁকে বললেন, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা যায় না। তাই তাঁর উচিৎ দিল্লি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়া। সুলতান ফিরে এসে কী না কী করে তার কোনও ঠিক নেই। নিজামুদ্দিন আউলিয়া উত্তর দিলেন ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’— অর্থাৎ দিল্লি এখনও সুলতানের জন্য অনেক দূর।

বাংলায় তখন শামসুদ্দিন ফিরোজশাহের পুত্রদের মধ্যে মসনদ নিয়ে দ্বন্দ্ব চলছিল। শামসুদ্দিনের তৃতীয় পুত্র নাসিরুদ্দিন তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাইদের বিরূদ্ধে গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের সাহায্য চাইলে সুলতান নিজে বাংলা অভিযান করেন ও লখনৌতির তখত-এ নাসিরুদ্দিনকে বসান। তাঁর ভাই গিয়াসুদ্দিন ফিরোজ শাহকে বন্দি করেন। এরপর সুলতান বিজয় গর্বে দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হন।

যতই সুলতানের নিকটবর্তী হবার খবর আসতে থাকে ততই নিজামুদ্দিন আউলিয়ার শিষ্যরা শঙ্কিত হয়ে উঠল। তারা নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে তাড়া দিতে থাকে দিল্লি থেকে অন্য কোথাও চলে যাবার জন্য। কিন্তু নিজামুদ্দিন কোথাও যেতে রাজি হন না। যতবার তারা নিজামুদ্দিন আউলিয়াকে অনুরোধ করতে থাকল অন্য কোথাও চলে যাবার জন্য, ততবার নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সেই এক কথা, ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’। বাবার শিষ্যরা অবাক হয়ে যায়। এখনও দিল্লি দূর?

শেষে সুলতান দিল্লির দোরগোড়ায় এসে পৌঁছলেন। সুলতানের বড় পুত্র জুনা খাঁ পিতার অভ্যর্থনার জন্য এক বিরাট তোরণ নির্মাণ করালেন আফগানপুরে। যেদিন সুলতান সেই তোরণ দিয়ে প্রবেশ করবেন তার আগের দিন নিজামুদ্দিন আউলিয়ার শিষ্যরা তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে তাঁকে দিল্লি ছেড়ে চলে যাবার অনুরোধ করলেন। বাবার সেই এক কথা ‘দিল্লি হনুজ দূর অস্ত’। শিষ্যরা হতবাক হয়ে গেল। আফগানপুর থেকে দিল্লির দূরত্ব যে মাত্র ছয় মাইল।

নির্দিষ্ট দিনে সুলতান গিয়াসুদ্দিন ও তাঁর ছোট পুত্র মামুদ খান যখন সেই বিশাল তোরণ দিয়ে প্রবেশ করছিলেন তখন হঠাৎ সেই বিশাল তোরণ ভেঙে পড়ে ও সুলতান এবং তাঁর ছোট ছেলের মৃত্যু হয়। সুলতানের আর দিল্লি পৌঁছনো হল না। দিল্লি দূরেই থেকে গেল।

যে তুঘলকাবাদ দূর্গ গিয়াসুদ্দিন নির্মাণ করালেন তা কখনোই সম্পূর্ণ রূপে আবাদ হয়নি এবং মাত্র পনেরো বছরের মধ্যে জলের অভাবে তা পরিত্যক্ত হয়। আজও কেউ দিল্লি গেলে দেখতে পাবেন সেই বিশাল তুঘলকাবাদ দূর্গ ধ্বংসস্তুপ হয়ে পড়ে আছে। অন্যদিকে খোয়াজা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার খানকাতে আজও বহু ভক্ত সমাগম হয়। আজও কাওয়ালির সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে খোয়াজা বাবার সমাধিস্থল। সেই বাউলির জল আজও মানুষের কাছে পবিত্র।

ক্ষমতার দম্ভ ক্ষণস্থায়ী, ভালবাসাই চিরস্থায়ী।