Categories
বিজ্ঞানমন্দির |

মুছে যাওয়া স্মৃতিগুলি

1186 |
Share
| ২১ নভেম্বর, ২০২০
ডঃ সায়নী মুখোপাধ্যায়

স্নায়ু-অন্তঃস্রাব গবেষক, রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়, নিউ জার্সি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

ছবি সৌজন্য: www.nia.nih.gov/health/alzheimers-disease-fact-sheet; www.alzheimersresearchuk.org/blog/untangling-tau-in-the-brain/

আমরা সবাই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরেই বড় হই, বাঁচি! মাঝে মাঝে মনে হয় এই স্মৃতিগুলো যদি হারিয়ে যেত, কী হত? আমাদের প্রত্যেকের জীবনে যেমন সুখকর স্মৃতি আছে, সেই রকমই দুঃখের স্মৃতিও আছে। কী ভাল হত যদি আমাদের মস্তিষ্কে একটা মেমরি এডিটিং টুল থাকত আর আমাদের মনের ইচ্ছেমতো যত্তসব দুঃখের স্মৃতি মুছে দিয়ে আনন্দের স্মৃতিগুলো রেখে দিতে পারতাম। কিন্তু বাস্তবে কি আর তা হয়? আমাদের দুটোকে নিয়েই বাঁচতে হয়। আর যাদের এই সব রকমের স্মৃতিই আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে মাথা থেকে, তাদের কথা ভাবলে খুব কষ্ট হয়। খুব কাছ থেকে একজনকে দেখেছি যিনি শেষ পর্যন্ত তাঁর নাতি, নাতনি এমনকি নিজের ছেলেমেয়েদেরও ভুলে গিয়েছিলেন! আবার এরকম একজনকেও দেখেছি যিনি বিকেলে আইসক্রিম কিনতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে হঠাৎ করে তাঁর অতি পরিচিত বাড়ির রাস্তা ভুলে গিয়ে হারিয়ে গেলেন। দিনে তিনবার খাবার খেয়েও তাঁর মনে হচ্ছে তিনি কিছুই খাননি আজ সারাদিন! আসলে যাঁরা এরকম পরিস্থিতির শিকার তাঁরা নিজেরাই বুঝতে পারেন না যে তাঁরা সত্যি সব কিছু ভুলে যাচ্ছেন! অথচ তাঁরা কিন্তু ভাবছেন যে তাঁরা ঠিকই বলেছেন আর অযথাই বাড়ির লোকেরা তাঁদের কথা বিশ্বাস করতে চাইছেন না। আর বাড়ির লোকেরা হিমশিম খাচ্ছে তাঁদের এই অস্বভাবিক আচরণ-এর সম্মুখীন হয়ে!

বাড়ির লোকের, আত্মীয়স্বজনের একটাই প্রশ্ন যে, এরকম কেন হচ্ছে? অনেকসময় বাড়ির লোকেরা ভাবছেন যে হয়তো সেই ব্যক্তিটি মজা বা মস্করা করছেন। আর এরকম ভাবাটা খুবই স্বাভাবিক কারণ অনেক মানুষই জানেন না যে এটি একটি রোগের লক্ষণ। আসলে আলজাইমার অসুখটাই যে এরকম। এই অসুখে মানুষের মস্তিষ্কের আকার ছোট হতে থাকে এবং এটি একটি ক্রমবর্ধমান ব্যাধি যা মস্তিষ্কের কোষগুলি নষ্ট করে দেয়। গড়ে, আলজাইমার রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা রোগ নির্ণয়ের পর ৩ থেকে ১১ বছর অবধি বাঁচেন। এই রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলি হল— এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি সাম্প্রতিক ঘটনা বা কথোপকথনকে মনে রাখার ক্ষমতা হারায়। রোগটি বাড়ার সাথে সাথে আক্রান্ত ব্যক্তির স্মৃতিশক্তি ক্রমশ আরও দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাঁর দৈনন্দিন স্বাভাবিক কর্মক্ষমতাও হ্ৰাস পায়। তাহলে কোনও উপায় কি আছে এই অসুখ থেকে সেরে ওঠার? না! বলতে খুব কষ্ট হলেও এটাই সত্যি যে আলজাইমার রোগ নিরাময় বা মস্তিষ্কে এই রোগের বিস্তার কমাতে পারে এমন কোনও চিকিত্সা এখনো নেই। বর্তমান আলজাইমার রোগের ওষুধগুলি শুধুমাত্র অস্থায়ীভাবে এই স্মৃতিভ্রংশের লক্ষণগুলিকে কমিয়ে দিতে পারে, তবে পুরোপুরি ভাবে সুস্থ করে তুলতে অক্ষম।

এঁকেছেন: লেখিকা

যেহেতু এটি একটি ক্রমবর্ধমান অসুখ তাই এই অসুখের শেষ পর্যায়ে, মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপের মারাত্মক ক্ষতি থেকে জটিলতা আরও বাড়তে থাকে— এবং শেষ পর্যন্ত ডিহাইড্রেশন, অপুষ্টি বা সংক্রমণ— এসবের ফলে এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়।

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে আলজাইমার রোগ জিনগত বা লাইফস্টাইল বা পরিবেশগত কারণগুলির সংমিশ্রণের কারণে ঘটে যা সময়ের সাথে সাথে মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে। এই রোগের সূত্রপাত অল্প বয়সীদের (৩০ বছরের পরে) মধ্যেও হয়, সেইক্ষেত্রে একে ‘early onset’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তেমনই বয়স্কদের মধ্যেও দেখা যায় ঠিক ৬৫ বছর বা তার পরে হলে তাকে ‘late onset’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

আলজাইমার রোগের সঠিক কারণগুলি পুরোপুরি ভাবে এখনও অবধি বোঝা না গেলেও, এটা বোঝা গেছে যে এর মূল কারণটি হল মস্তিষ্কের কিছু নির্দিষ্ট প্রোটিন তাদের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারায় যার ফলে মস্তিষ্কের কোষগুলির স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় বা ব্যাহত হয়। সব শেষে নিউরনগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে একে অপরের সাথে সংযোগ হারায় এবং শেষ পর্যন্ত মারা যায়। আস্তে আস্তে এই ক্ষয়টি ছড়িয়ে পড়ে মস্তিষ্কের সেই অঞ্চলে (এন্টোরহিনাল কর্টেক্স এবং হিপ্পোক্যাম্পাস) যেটি আমাদের স্মৃতিশক্তি ধরে রাখতে সাহায্য করে ও নিয়ন্ত্রণ করে। এর পরে এই ক্ষয়টি আস্তে আস্তে সেরিব্রাল কর্টেক্সেও ছড়িয়ে পরে যার ফল স্বরূপ ভাষা, যুক্তি এবং সামাজিক আচরণেরও ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং রোগের শেষ পর্যায়ে দেখা যায় মস্তিষ্ক উল্লেখযোগ্যভাবে ছোট হয়ে গেছে।

গবেষকরা দুটি প্রোটিনের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন: ১। আমায়লয়েড বিটা (amyloid-beta ) ২। টাউ (Tau)।

বিটা-অ্যামাইলয়েড একটি বৃহৎ প্রোটিনের একটি ক্ষুদ্র অংশ যেটি সাধারণত স্নায়ুবৃদ্ধি এবং মেরামতের জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। কিন্তু আলজাইমার রোগে এই প্রোটিনের একটি দূষিত রূপ স্নায়ুকোষকে ধ্বংস করতে পারে, যার ফলে চিন্তাভাবনা এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়। স্বাভাবিক অবস্থায়, বিটা-অ্যামাইলয়েড একটি বৃহৎ প্রোটিনের অণুগুলির ভাঙনের দ্বারা গঠিত হয়, এবং সময়মতো মস্তিস্ক থেকে পরিষ্কারও হতে থাকে। কিন্তু আলজাইমার রোগে, আক্রান্ত-ব্যক্তির মস্তিষ্কে এটি পরিষ্কার হওয়ার পরিবর্তে এই প্রোটিনগুলি একটি অস্বাভাবিক স্তর তৈরি করে, যার বিষাক্ত প্রভাবে নিউরনগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে একে অপরের সাথে সংযোগ হারিয়ে শেষ পর্যন্ত মারা যায়।

এবার টাউ প্রোটিন এর কথায় আসি। একটি পরিপুষ্ট, সুঠাম চেহারার স্নায়ুকোষ গঠনে এই প্রোটিন এর কাজ অতুলনীয়।

এখন ঝামেলাটি বাধে তখন যখন আলজাইমার রোগে এই টাউ প্রোটিনগুলি আকার পরিবর্তন করে পুরো জটাধারী হয়ে ওঠে এবং নিজেকে ‘নিউরোফিব্রিলারি ট্যাংলস’ নামে কাঠামোতে রূপান্তরিত করে। এটা নিশ্চয়ই জান যে, যেকোনও প্রকার জট আমাদের জীবনে খুবই খারাপ প্রভাব ফেলে। সে যানবাহন জট থেকে শুরু করে, জটলা করে ফিসফিসানি বা ধরো মাথার চুলের জট— যেখানেই জট সেখানেই কিন্তু বিপদ। এখন ভাবো মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের ভিতরে যদি এই রকম জট বাধে তাহলে স্বাভাবিকভাবে পরিবহন ব্যবস্থা (একে অপরের সাথে সংযোগ) ব্যাহত হবে এবং কোষগুলি পুষ্টির অভাবে আস্তে আস্তে মরে যাবে।

এখন গবেষকরা এই প্রোটিনগুলির কাজকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে বা দেখছে অন্য কোন উপায়ে এই জট ছাড়িয়ে ভেঙে-পড়া ক্ষতিগ্রস্থ স্নায়ুকোষকে আবার পুনরায় সতেজ ও কর্মক্ষম বানানো যায়। আশা করছি অদূর ভবিষ্যতে এমন কোনও উপায় পাওয়া যাবে যাতে খুব তাড়াতাড়ি এই অসুখের চিকিৎসা করা যাবে ও সেটা চিরস্থায়ী হবে।

ঋণ: www.nia.nih.gov/health/alzheimers-disease-fact-sheet; Barnes J, Dickerson BC, Frost C, Jiskoot LC, Wolk D, van der Flier WM. Alzheimer's disease first symptoms are age dependent: Evidence from the NACC dataset. Alzheimers Dement