বিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রহরে বিশ্বপ্রকৃতির উদার প্রাঙ্গণে ছেলেদের মুক্তি দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ তৈরি করলেন শান্তিনিকেতন—বিদ্যালয়।
শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী বয়ে নিয়ে চলেছে রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের কর্মসাধনার পরিচয়। এই সাধনা তাঁর মতে, মনুষ্যত্বসাধনা। এই সাধনায় যাঁরা স্থপতি, এই সহযোগীর দল, এঁরা আশ্রমের সৃষ্টিকার্যে নিজেদের সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। এই সঙ্গী কর্মী এবং বন্ধুদের কথাই ধরা রয়েছে ‘শান্তিনিকেতনের গোড়ার কথা’য়।
আজ জগদানন্দ রায়ের কথা।
মাস্টারমশাই। চোখে মোটা কাঁচের চশমা, চাপা ঠোঁট, বিরক্তিতে ভুরু দুটো কুঁচকেই আছে, খড়্গের মতো বাঁকা নাক। এমন মাস্টারমশাইকে ক্লাসে দেখলে ছাত্ররা ভয় পাবে না? ভয় তারা বিলক্ষণ পেত বৈকি। তার ওপর তিনি পড়ান অঙ্ক আর বিজ্ঞান। এই দুটি বিষয়েও গড়পড়তা ছাত্রদের বিরাগ তো থাকেই। সব মিলিয়ে প্রথম দেখায় ছাত্ররা তাঁকে কেউ খুব পছন্দ করেছে বলে শোনা যায়নি।
কিন্তু তাঁর ক্লাসের ছাত্র গণিতে তেমন ব্যুৎপত্তি দেখাতে পারেনি, বা সামান্য পিছিয়ে পড়েছে, এই সত্য তিনি শিক্ষক হয়ে পারতপক্ষে সহ্য করতে পারতেন না। অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন তিনি নিজে। আর ছাত্রটির কাছ থেকে প্রত্যাশা করতেন পূর্ণ মনোযোগ আর অধ্যবসায়। সব মিলিয়ে তাঁর ছাত্রদের জন্য তাঁর এই অশেষ ধৈর্য দেখে দ্বিজেন্দ্রনাথ লিখলেন:
জগদানন্দ বিলান জ্ঞান
গিলান পুঁথি ঘর-জোড়া।
কাঁঠাল গুলান কিলিয়ে পাকান,
গাধা পিটি করেন ঘোড়া।
নীরস অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়ান তিনি। কিন্ত নীরসকে সরস আর মজাদার করবেন বলেই তো তাঁর সর্বক্ষণের চেষ্টা। যে ছাত্র তাঁকে প্রথমদিনেই ভয় পেতে শুরু করে, সে অচিরেই বুঝতে পারে, শুকনো কঠিন আবরণের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে মাতৃস্নেহ। তাঁর শাসনের সবটুকুই যেন ভান, ছেলেদের তিনি সুহৃদ, তিনি সঙ্গী, তিনি শিক্ষক এবং তিনি অধিনায়ক। ছেলেরা সকলেই তাঁকে সম্মান করত। শুধু নিয়মের অনুবর্তী হয়ে নয়, তাঁরা মনপ্রাণ দিয়ে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করত তাঁদের এই মাস্টারমশাইকে।
‘সন্ধ্যার সময় ছাত্রদের নিয়ে তিনি গল্প বলতেন। মনোজ্ঞ করে গল্প বলবার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তিনি ছিলেন যথার্থ হাস্যরসিক, হাসতে জানতেন। তাঁর তর্জনের মধ্যেও লুকানো থাকত হাসি। সমস্ত দিন কর্মের পর ছেলেদের ভার গ্রহণ করা সহজ নয়। কিন্তু তিনি তাঁর নির্দিষ্ট কর্তব্যের সীমানা অতিক্রম করে স্বেচ্ছায় স্নেহে নিজেকে সম্পূর্ণ দান করতেন’— এ কথা লিখছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাঁর স্বপ্নের আশ্রমে এইরকম একজন শিক্ষককে তিনি পেলেন কোথায়?
তার জন্য যেতে হবে শিলাইদহে।
রবীন্দ্রনাথ তখন ‘সাধনা’ পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। কৃষ্ণনগরের এক অল্পবয়সী ছাত্র সেই পত্রিকায় নিয়মিত পাঠান বিজ্ঞান-বিষয়ক বিভিন্ন প্রবন্ধ। সেই প্রাঞ্জল ভাষা আর সহজ কথায় চমৎকার সব প্রবন্ধ দেখে আকৃষ্ট হন স্বয়ং সম্পাদক। ১৮৯২ সালে বি এ পরীক্ষা দেওয়ার পরেই ছাত্রটির পিতৃবিয়োগ হয়েছে; আর্থিক সংকটে তাকে শিক্ষকতা শুরু করতে হয়েছে গোয়ারি মিশনারি স্কুলে। রবীন্দ্রনাথ এই তথ্য জানামাত্র ডেকে নিলেন তাকে শিলাইদহে জমিদারি সেরেস্তাখানার কাজে। অবসর সময়ে কুঠিবাড়িতে তখন তিনি পড়াতেন রথীন্দ্রনাথ, মাধুরীলতাদের। কিন্তু এমন একজন বিজ্ঞান-অনুরাগী শিক্ষককে সেরেস্তার কাজে বন্দি করে রাখতে পারলেন না রবীন্দ্রনাথ। তিনি যে ততদিনে শান্তিনিকেতনের আশ্রম-বিদ্যালয় তৈরির স্বপ্ন দেখছেন।
একদিন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে তাঁকে ডেকে পাঠালেন রবীন্দ্রনাথ।
‘তুমি জমিদারির কাজে থাকতে চাও, না আমার সঙ্গে শান্তিনিকেতন যেতে চাও?’
উত্তর দিতে তিনি এক মুহূর্ত দ্বিধাবোধ করেননি।
‘আমি নায়েব হতে চাই না। আপনার সঙ্গে শান্তিনিকেতন নিয়ে চলুন’।
শিলাইদহের পাট গুটিয়ে শান্তিনিকেতনে এলেন জগদানন্দ রায়। তাঁর স্মৃতিচারণে রয়েছে ১৯০১ সালের শ্রাবণ মাসে কবির ডাকে একবাক্যে তিনি কীভাবে এসে যুক্ত হয়েছিলেন এই আশ্রম-বিদ্যালয়ে। ৭ পৌষ, ইংরেজি ২২ ডিসেম্বর বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা-উৎসব। এই অনুষ্ঠানে আশ্রমের প্রথম পাঁচজন ছাত্র দীক্ষা নিল এই বিদ্যালয়ের আশ্রমিক হিসেবে। শিবধন বিদ্যার্ণবের সঙ্গে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং জগদানন্দ রায়।
শুধুমাত্র একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে নয়, বিদ্যালয় পরিচালনার কাজেও তিনি সহযোগিতা করেছেন নিষ্ঠাভরে। ১৯১০ সালে বিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা তাঁকে নির্বাচিত করেন আশ্রমের সর্বাধ্যক্ষ পদে। বিদ্যালয়ের গণ্ডিতে শুধু নয়, ১৯২১ সালে যখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়, তার ঠিক পরেই প্রধান কর্মসচিব হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেন। ১৯২৩ সালে তিনি নির্বাচিত হন শান্তিনিকেতনের মুখ্য-প্রশাসক ‘শান্তিনিকেতন-সচিব’ পদে। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতন পত্রিকার সম্পাদক, শান্তিনিকেতন প্রেসের পরিচালক, বিশ্বভারতী সমবায় কেন্দ্রীয় কোষের প্রথম সম্পাদক, উদ্যান বিভাগের তত্ত্বাবধায়কের গুরুদায়িত্ব নিখুঁতভাবে পালন করেছেন তিনি। প্রশাসক হিসেবে তাঁর এই দক্ষতা ছিল প্রশ্নাতীত।
কিন্তু শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। কারণ, শিক্ষাদান তাঁর সহজ দক্ষতা। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং বলেছেন, ‘শিক্ষাদানে তাঁর স্বভাবের ছিল অকৃত্রিম তৃপ্তি। ছাত্রদের কাছে সর্বতোভাবে আত্মদানে তাঁর একটুও কৃপণতা ছিল না। শিক্ষার উচ্চ আদর্শ রক্ষার জন্য তাঁর অক্লান্ত চেষ্টা ছিল। যে শিক্ষকেরা আশ্রমের সৃষ্টিকার্যে আপনাকে সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছিলেন, জগদানন্দ তাঁর মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন’।
বিজ্ঞান-শিক্ষক জগদানন্দ। শিক্ষক হিসেবে তাঁর অসম্ভব জনপ্রিয়তা ছিল ছাত্রদের কাছে। গল্পচ্ছলে বিজ্ঞানের কথা বলার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। ছেলেদের একের পর এক তথাকথিত অবান্তর প্রশ্ন, কৌতূহলে এতটুকুও ক্লান্ত হন না তিনি। হাসিমুখে সমস্ত প্রশ্নের জবাব দেন। কোথাও কোনও নির্দিষ্ট পাঠক্রমে তিনি আবদ্ধ থাকতেন না। ছোটোখাটো যন্ত্রপাতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন তিনি, জড়িয়ে নিতেন ছাত্রদের। তাঁর এই প্রকৃতি-পাঠ বা প্রকৃতি-পর্যবেক্ষণের উৎসাহে সমর্থন করেছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। হুগলিতে এক ভদ্রলোক নিজের হাতে টেলিস্কোপ তৈরি করেছেন শুনে সেই তিন ইঞ্চির একটি টেলিস্কোপ তিনশো টাকা দিয়ে কিনে ফেললেন তিনি। সুদূর বিদেশ থেকে বাক্স ভর্তি বিজ্ঞানের বই-ম্যাগাজিন পাঠিয়েছেন তাঁকে। রবীন্দ্রনাথের অনুমোদন, প্রশংসা আর অনাবিল স্নেহের প্রশ্রয়ে পড়ার বইয়ের বাইরের পৃথিবী আর প্রকৃতিকে চিনিয়েছেন জগদানন্দ। এই পর্যবেক্ষণ তাঁর ছাত্রদের আরও আগ্রহী করে তুলেছিল বিজ্ঞান বিষয়ে। বাঙালির ঘরে ঘরে পৌঁছেছে তাঁর সরল গদ্যে লেখা ‘গ্রহ-নক্ষত্র’, ‘পোকামাকড়’, ‘গাছপালা’, ‘মাছ ব্যাং সাপ’, ‘পাখি’, ‘আলো’, ‘তাপ’ ও ‘চুম্বক’-এর কাহিনি। একের পর এক বাইশটির বেশি বই রয়েছে তাঁর। বাংলায় বিজ্ঞান সাধনা এবং বিজ্ঞান সাহিত্যিক হিসেবে তাঁর অবদান ভুললে চলবে না। ‘জ্ঞানের ভোজে এদেশে তিনিই সর্বপ্রথম কঁচা বয়সের পিপাসুদের কাছে বিজ্ঞানের সহজপথ্য পরিবেশন করেছিলেন’।
বাইরে গম্ভীর। অত্যন্ত শুষ্ক, রুক্ষ, কঠোর। মনের মধ্যে স্নেহের ফল্গুধারা। একইসঙ্গে ছেলেদের বন্ধু ও শিক্ষক, সঙ্গী ও অধিনায়ক হওয়া বড় কম কথা নয়। তাঁর অন্যতম ছাত্র প্রমথনাথ বিশী জানিয়েছেন, মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকুনি বা কিলচড় খেলে পরক্ষণেই বিস্কুট-লজেন্স জুটে যেত। ‘সন্ধ্যার সময় ছাত্রদের নিয়ে তিনি গল্প বলতেন। মনোজ্ঞ করে গল্প বলবার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তিনি ছিলেন যথার্থ হাস্যরসিক, হাসতে জানতেন। তাঁর তর্জনের মধ্যেও লুকোনো থাকত হাসি’। এই কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের।
বিজ্ঞান এবং অঙ্কের কড়া মাস্টারমশাই গানে আর অভিনয়ে পাল্লা দিচ্ছেন তাঁর ছাত্রদের সঙ্গে—এ তো একমাত্র শান্তিনিকেতনেই সম্ভব। ১৯০৮ সালের আশ্বিন মাসে রবীন্দ্রনাথের ‘শারদোৎসব’ নাটকে জগদানন্দ মঞ্চে এলেন লক্ষেশ্বর হয়ে। পাশে সহ অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ, দিনেন্দ্রনাথ! কৃপণ লক্ষেশ্বরের অনবদ্য অভিনয়ের স্মৃতিচারণ করেছেন রথীন্দ্রনাথ স্বয়ং। একই দক্ষতায় ‘অচলায়তন’ নাটকে তিনি মহাপঞ্চক, ‘ফাল্গুনী’তে দাদাঠাকুর, ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে রামচন্দ্র, ‘রাজা’ নাটকে কোশলরাজ . . . একের পর এক অপ্রধান চরিত্রে দর্শকদের রীতিমতো মনোযোগ কেড়ে নিতেন জগদানন্দ। অবকাশে বেহালা এবং এসরাজ বাজাতেন। আবার গান আর ছবি নিয়েও তাঁর আগ্রহ এবং আকর্ষণ কিছু কম ছিল না।
ব্রিটিশ সরকার এই মানুষটিকে ‘রায় সাহেব’ উপাধি দান করেন। নৈহাটিতে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনে বিজ্ঞান শাখার সভাপতি হন তিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই বিজ্ঞান শিক্ষককে দিয়েছিলেন এক আশ্চর্য স্বীকৃতি; বি এ পরীক্ষায় বাংলাভাষার অন্যতম পরীক্ষক নিযুক্ত করে তাঁরা সম্মানিত করেছিলেন এই বিজ্ঞান-সাহিত্যিককে। এ এক বিরল সম্মান। একজন আদর্শ শিক্ষক, দক্ষ সংগঠক, বৈজ্ঞানিক গ্রন্থকার এই মানুষটি ছিলেন শান্তিনিকেতন আশ্রম-বিদ্যালয়ের এক অন্যতম সম্পদ। প্রেরণাদাতা আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রশস্তিও তাই মনে রাখার মতো। ১৯৩৩ সালের ২৫ জুন তাঁর প্রয়াণে বাংলাভাষায় সরল সাবলীল বিজ্ঞানসাধনার ক্ষেত্রটিও অসম্পুর্ণ থেকে যায়।
জগদানন্দ রায় (১৮৬৯- ১৯৩৩)। ঋণ: রবীন্দ্র পরিকর: পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়; রবিজীবনী: প্রশান্তকুমার পাল; জগদানন্দ রচনাসমগ্র