ভারত, বাংলা তথা কলকাতার ইতিহাসে ১৯৭৫ সালটি তাৎপর্যপূর্ণ। ওই বছর ২৩ জানুয়ারি দেশনায়ক সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিনে শহর কলকাতায় উদ্বোধন হয় তাঁর নামাঙ্কিত দেশের প্রথম ইনডোর স্টেডিয়াম— নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম। এই স্টেডিয়ামে তখনও পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা টেবিল টেনিস বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। এই ক্রীড়া যজ্ঞের আয়োজনের পর থেকেই দেশের খেলার মানচিত্রে কলকাতার মুখ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কেবল ফুটবলের মক্কা নয় কলকাতা হয়ে ওঠে জাতীয় স্তরে প্রতিভাবান টেবিল টেনিস খেলোয়াড় পৌঁছে দেওয়ার এক স্বতঃস্ফূর্ত কারখানা।
সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের অনুপ্রেরণায় গড়ে ওঠে নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম। অথচ কলকাতা কিন্তু প্রথম পছন্দ ছিল না এই ক্রীড়া যজ্ঞের ভেন্যু হিসাবে। এই প্রতিযোগিতা আয়োজন করার ক্ষেত্রে বম্বে (আজকের মুম্বাই) আর দেশের রাজধানী দিল্লি ছিল প্রথম দুই দাবিদার। শহর বম্বের এগিয়ে থাকার কারণ একটা অবশ্যই ছিল। ১৯৫২ সালে প্রথমবার বিশ্ব টেবিল টেনিস টুর্নামেন্ট আয়োজন করার অভিজ্ঞতা ছিল, তাই তারা দৌড়ে কিছুটা হলেও এগিয়ে ছিল। মিস্টার রামানুজম ছিলেন সেই সময়ে টিটিএফআই-এর (টেবিল টেনিস ফেডারেশান অফ ইন্ডিয়া) সভাপতি আর ইন্টারন্যাশনাল টেবিল টেনিস ফেডারেশানের সভাপতি ছিলেন রয় এভান্স। রয় প্রথম থেকেই একটা কথা বলে আসছিলেন যে কোনও শহরে এই আসর বসুক না কেন ‘সাইট না দেখে সিধান্ত নেওয়া যাবে না’।
দিল্লিতে একটি চুড়ান্ত বৈঠক বসে এবং সেই বৈঠকে বাংলা থেকে উপস্থিত ছিলেন টেবিল টেনিসের কর্তা শ্রীযুক্ত প্রবীর মিত্র। তিনি এভান্সের সাথে একটি গোপন প্রজেক্ট রিপোর্ট তুলে দেন। এর পরে পরেই রাইটার্স বিল্ডিংয়ে সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের সাথে একটি মিটিং করেন।
গোপীনাথবাবু স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘মুখ্যমন্ত্রীর সাথে মিটিং-এর সময়ের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র তিরিশ সেকেন্ডের’। সেই তিরিশ সেকেন্ডের সময়কালে সিদ্ধার্থবাবু বলেছিলেন দুটি শব্দ ‘গো আহেড’।
সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের ক্রীড়ামন্ত্রী ছিলেন প্রফুল্ল কান্তি ঘোষ বা শত ঘোষ। তিনি বলেছিলেন এত বড় মাপের প্রজেক্ট করার জন্য সরকারের বাজেট নেই। এর সাথে সাথে গোপীনাথবাবু এবং প্রবীরবাবুরা তৎকালীন পূর্তমন্ত্রী ভোলা সেনের সাথে দেখা করেন। তিনি আবার বলে ওঠেন, মুখ্যমন্ত্রী না বললে কোনও সিধান্ত নেওয়া যাবে না। এ এক ঘোর সমস্যার মধ্যে এসে উপস্থিত হন এই দুই বাংলার টেবিল টেনিস কর্তা। এভান্সের সম্মতি পাওয়া গেছিল এরপর সিদ্ধার্থবাবুর, কিন্তু তারপরের প্রায় প্রত্যেকটা হার্ডেল আর তারা কিছুতেই পেরোতে পারছিলেন না। কিছু না কিছু ভাবে আটকে যাচ্ছিল। তখুনি জে. সি. তালুকদারকে মুখ্যমন্ত্রী প্রজেক্ট হেড হিসেবে নিযুক্ত করেন। এই নিযুক্তির পরেই বাকি পথ চলা অনেকটা সহজ হয়ে যায়।
এত বড় কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য এই সরকারি অফিসার জে. সি. তালুকদার ছিলেন সেরা এবং সঠিক মানুষ। পথ মসৃণ হবার পরেই শুরু হল ভেন্যু বাছাইয়ের কাজ। তিনটি জায়গা দেখানো হয়েছিল। এক, পার্ক স্ট্রিট সংলগ্ন ময়দানের একটি স্থান। দুই, সল্টলেকের ইন্দিরা ভবনের কাছে একটি জমি আর তৃতীয়টি স্ট্র্যান্ড রোডের ধারে একটি জায়গা। রয় এভান্স কিছুদিন পর কলকাতায় আসেন এবং সম্ভাব্য ভেন্যুগুলি দেখেন। শেষ অবধি পছন্দ হয় স্ট্র্যান্ড রোডের ধারে অবস্থিত জমিটি। রাইটার্স-এ এভান্স এবং সিদ্ধার্থ রায়ের মিটিংয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন ‘রাজ্য সরকার আপনাদের দাবি মেনে নিয়ে স্ট্র্যান্ড রোডের জমিতে স্টেডিয়াম বানাবে। আপানারা বিয়ের কনে ঠিক করুন, তাকে সাজানোর দায়িত্ব আমাদের’।
এই বিরাট কর্মযজ্ঞের এক একটা করে ধাপ পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এবার পালা কন্ট্রাক্টর ঠিক করার। চারটি সংস্থা আর্কিটেক্ট প্ল্যান জমা দিয়েছিল। তাদের মধ্যে বাংলা থেকে ঘোষ-বোস অ্যান্ড কোম্পানিও ছিল। এদের সবাইকে টপকে একদা ভারত সরকার দ্বারা ব্ল্যাকলিস্টেড পাঞ্জাবি কোম্পানি উত্তম সিংহ দুগালকে কন্ট্রাক্ট দেওয়া হয়। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামের ভূমি পুজো হয় ২৪শে জুন ১৯৭৪ সালে। দিনরাত এক করে প্রবীরবাবু, গোপীবাবু এবং আরও অনেক টেবিল টেনিসের কর্মকর্তারা পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে পাশে পেয়ে তিলে তিলে গড়ে তোলেন আজকের নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম।
নেতাজি ইনডোরের উদ্বোধন ঘটে ২৩শে জানুয়ারি ১৯৭৫ সালে, নেতাজির জন্মদিনে। ঠিক তার পরের মাসে ৬ই থেকে ১৬ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ। দেশের প্রথম ইনডোর স্টেডিয়ামে গ্লোবাল মেগা স্পোর্টস ইভেন্টের উদ্বোধন করেছিলেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় ও ইন্টারন্যাশনাল টেবিল টেনিস ফেডারেশনের সভাপতি রয় এভান্স। দুজনে একটি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছিলেন। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত নেতাজি সেজে উঠল হ্যালোজেনের আলোয় আর বাইশটা টেবিল টেনিস বোর্ডে। সে এক মহাযজ্ঞ। বাষট্টিটা দেশ অংশগ্রহণ করেছিল এবং সেই সব দেশের সহস্র খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা সবাই এসে জড়ো হয়েছিলেন প্রাণের শহর কলকাতায়। সেই সময়ে আমাদের শহরে এতগুলো পাঁচতারা হোটেল ছিল না। গ্র্যান্ড, গ্রেট ইস্টার্ন, রঞ্জি কন্টিনেন্টাল আর পার্ক হোটেলের মত আরও কিছু হোটেল মিলিয়ে এই সব অতিথিদের রাখা হয়েছিল। এছাড়াও পূর্ত দপ্তরের গেস্ট হউস আর অভিজাত ক্লাবগুলিতে রাখা হয়েছিল কিছু কর্মকর্তা ও অতিথিদের।
নেতাজি ইনডোরের পাশেই খেলোয়াড়দের প্র্যাকটিসের জন্য তৈরি করা হয় ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র। এই ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র স্টেডিয়ামটি আগে থেকেই ছিল। তখন এই স্টেডিয়ামটিকে রঞ্জি ইনডোর স্টেডিয়াম বা পঙ্কজ গুপ্ত ইনডোর স্টেডিয়াম বলে পরিচিত ছিল। সেই সময় এখনকার মতো কাঠের ফ্লোর ছিল না, তার বদলে সিমেন্টের ফ্লোর আর মাথায় ছিল টিনের ছাদ। এই স্টেডিয়ামে রাশিয়া, নর্থ কোরিয়া, সাউথ কোরিয়া ও জাপান এই সব দেশ এসে খেলে গেছে। সেই সব খেলার জন্য তখন ক্রীড়া প্রেমীরা বসতো অস্থায়ী কাঠের গ্যালারিতে। হ্যালোজেনের ব্যাবস্থাও ছিল না; ঝুলত বড় বড় বাল্ব। তবে এই ১৯৭৫ সালের বিশ্ব টিটি-র জন্য ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্র নাম দেওয়া হয় ও আধুনিকভাবে সাজানো হয়। এখানেই মূল স্টেডিয়াম নেতাজিতে খেলার আগে খেলোয়াড়রা গা ঘামিয়ে নিত।
এখানে এটাও বলে রাখা দরকার যে পশ্চিমবঙ্গে শুধুমাত্র টেবিল টেনিসের জন্য গড়ে উঠেছে তিনটি স্টেডিয়াম। ১৯৭৫-এ বিশ্ব টিটি-র জন্য নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম, ১৯৮০-তে ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য দুর্গাপুরে সিধু-কানু স্টেডিয়াম আর ১৯৯৮-তে রাজ্য টিটি চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য হাওড়ায় ডুমুরজলা স্টেডিয়াম। টেবিল টেনিস ছাড়া আর কোনও খেলার জন্য রাজ্যের ক্রীড়া-ইতিহাসে এতগুলো স্টেডিয়াম তৈরি হয়নি— যা এক বিরল নজির।
গঙ্গায় বয়ে গেছে অনেক জল আর সেই জলীয় ঝোড়ো হাওয়া বারবার নতুন রূপে এসে গায়ে লেগেছে ইনডোর স্টেডিয়ামে। এই দীর্ঘ ৪৫ বছরে টেবিল টেনিস বাদ দিয়ে ইনডোরের উডেন ফ্লোর সাক্ষী থেকেছে অন্যান্য খেলার এবং নানা কর্মকাণ্ডের। দেশ-বিদেশের নানান রাষ্ট্রনেতাদের অভ্যর্থনা জানানো, দেশের তাবড় তাবড় শিল্পীদের নিয়ে কনসার্ট বা নাইট, রাজনৈতিক সভা সমাবেশ, রকমারি মেলা, কলেজ সোশ্যাল, মাদার টেরেসাকে শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন, রাশিয়ান সার্কাস, হালের প্রিমিয়াম কাবাডি লিগ কিংবা আশির দশকে অমিতাভ বচ্চনের গায়ে আলো নিয়ে ‘ইয়ারানা’ ছবির সেই বিখ্যাত গানের দৃশ্যর শুটিং!
নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়াম সাক্ষী থেকেছে নানাবিদ কর্মকাণ্ডের সাথে, কিন্তু বিশ্ব টিটি ছাড়াও একাধিকবার অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা, বিশ্ব পাওয়ার লিফ্টিং প্রতিযোগিতা, এশিয়ান বাস্কেটবল চ্যাম্পিয়নশিপ, কমনওয়েলথ ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপ এবং ফিফ্থ এশিয়ান টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়নশিপ। আর পাঁচ বছরের মাথায় ইনডোর স্টেডিয়ামের সুবর্ণজয়ন্তী, পঞ্চাশ বছরের উদযাপনে। সেই উদযাপনে আবার যদি ওই উডেন ফ্লোরে, সুসজ্জিত গ্যলারির সামনে, উজ্জ্বল হ্যালোজেনের মাঝে টেবিল টেনিস বোর্ড পাতা যায়! যদি দুর্দান্ত ফোরহ্যান্ড, চপ আর টপস্পিন দেখার সুযোগ মেলে দর্শকদের— তাহলে সুবর্ণজয়ন্তীর উৎসব হবে সার্থক আর সম্পূর্ণ হবে একটি ঐতিহাসিক বৃত্ত।