উইম্বলডন জায়গাটা হল ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরের দক্ষিণ পশ্চিম শহরতলীতে। এখানেই হয় বিশ্বের চারটি প্রধান বা গ্র্যান্ডস্ল্যাম টুর্নামেন্টের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো টুর্নামেন্ট উইম্বলডন। ১৮৭৭ সাল থেকে শুরু হয়েছে এই টুর্নামেন্ট। প্রতি বছর জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে শুরু হয় প্রতিযোগিতা। আর টিকিট বিক্রি শুরু হয় তার আগের বছরের সেপ্টেম্বর মাস থেকে। তখন শুধু আগাম টিকিটের জন্য আবেদন পত্র পাঠাতে হয়। তারপর লটারি করে ঠিক হয় কারা টিকিট পাবে। আমি তো অনেকবার আবেদন করেও টিকিট পাইনি। এখানে মোট আঠারোটি কোর্টে খেলা হয়। তার মধ্যে তিনটি প্রধান কোর্ট আছে। সেন্টার কোর্ট, এক নম্বর কোর্ট আর দু’নম্বর কোর্ট। এইসব কোর্টে বড় বড় খেলা বা নামকরা খেলোয়াড়দের খেলা থাকে আর তাই ওইসব কোর্টের টিকিটের চাহিদাও বেশি থাকে। শুধু কিছু টিকিট থাকে দৈনিক বিক্রির জন্যে। প্রতিদিন খেলা শুরুর আগে দৈনিক টিকিট বিক্রি শুরু হয় আর যেহেতু খুব কম সংখ্যক টিকিট দেওয়া হয় ভাল কোর্টের জন্যে তাই লোকেরা একদিন বা দু’দিন আগে থেকেই লাইন দেয়। তাঁবু নিয়ে যায়, স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে যায়, খাবার দাবার নিয়ে যায়। উইম্বলডন ক্লাবের বাইরের মাঠে এই লাইন পড়ে এবং কর্তৃপক্ষ জনতার জন্যে অস্থায়ী টয়লেটেরও ব্যবস্থা করে দেয়।
২০১০ সালের ২৩ জুন আমি আমার মেয়েকে নিয়ে চলে গেলুম টেনিস খেলা দেখতে। না, রাতে গিয়ে তাঁবু খাটাইনি। ভোরবেলায় প্রথম বাসে গিয়ে ছ’টা নাগাদ পৌঁছে গেলুম মাঠে। তখনই বিশাল লাইন। কিছু লোক ঘুম থেকে উঠে মাঠে বসে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছে। চার ঘন্টা লাইন দিয়ে যখন টিকিট কাউন্টারে পৌঁছলুম তখন প্রধান কোর্টের টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। তবে আমরা তিন থেকে আঠারো যে কোনও কোর্টের খেলা দেখতে পাব। মনে হল ভালই হয়েছে। একদম প্রথম সারির খেলোয়াড়দের দেখতে না পেলেও আরও অনেক খেলা তো দেখা যাবে। জায়গাটা ঘুরেও দেখা যাবে।
টিকিট কাউন্টার থেকে বেরিয়েই দেখি সামনে এক বিশাল বোর্ড আর সেখানে ওই দিনের খেলার সূচী দেওয়া আছে। দেখি কোথাও লিয়েন্ডার পেজ ডাবলস্ খেলছে, কোথাও সানিয়া মির্জা, কোথাও সোমদেব দেববর্মণ বা কোথাও রোহন বোপান্না। এইসব ভারতীয় খেলোয়াড়দের খেলা দেখতে উৎসাহিত হলুম। ঘুরে ঘুরে নানা দেশের খেলোয়াড়দের খেলা দেখলুম। ঘুরে বেড়াতে খুব ভাল লাগছিল। চারদিকে সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ। বেগুনী আর সাদা রংয়ের প্রাধান্য বেশি। এছাড়া নানা রকমের গোলাপ। অতি মনোরম দৃশ্য। টেনিস ছাড়া উইম্বলডনের আর একটা আকর্ষণ হল এখানকার স্ট্রবেরি আর আইসক্রীম। প্রচুর লোকে দেখি তাই খাচ্ছে। আমরাও খেলুম। ঘুরতে ঘুরতে দেখি কিছু চেনা প্লেয়ার হেঁটে যাচ্ছে। লোকে অটোগ্রাফ নিচ্ছে। এক জায়গায় দেখি ভেনাস আর সেরিনা উইলিয়ামস-এর বাবাকে কিছু লোক ছেঁকে ধরেছে। এরপর হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলুম ‘হেনম্যান হিল’। এটা আর কিছুই নয়, একটা উঁচু ঢিবির মতো জায়গা। ওখান থেকে একদিকে আঠারো নম্বর কোর্ট দেখা যায় আর একদিকে একটা বিশাল টেলিভিশন স্ক্রীন লাগানো। সেইখানে সেন্টার কোর্ট বা এক নম্বর কোর্টের খেলা দেখানো হয়। প্রচুর দর্শক এখানে বসে ঐ পর্দায় খেলা দেখেন। এর নাম হেনম্যান হিল হওয়ার একটা কারণ আছে। ১৯৩৪ সালে ফ্রেড পেরি হয়েছিলেন শেষ ব্রিটিশ চ্যাম্পিয়ন। তারপর থেকে দু’একবার কিছু সম্ভাবনা হলেও কেউ ভাল ফল দেখাতে পারেনি। তাই কেউ একটু ভাল খেললেই ব্রিটিশরা তাদের খুব উৎসাহ দেয়। টিম হেনম্যান চারবার সেমিফাইনালে উঠেছিলেন। তখন দর্শকরা ঐ ঢিবিতে জমায়েত হয়ে খুব গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে হেনম্যানকে উৎসাহ দিত। সেই থেকে নাম হয়ে গেল হেনম্যান হিল। দুর্ভাগ্যবশত এত উৎসাহতেও উনি ফাইনালে উঠতে পারেন নি।
লিয়েন্ডার পেয়েস, সানিয়া মির্জা ও সোমদেব দেববর্মণ; চিত্র:লেখক
আমরা খানিকক্ষণ ঐ হিলে বসে পরিবেশ উপভোগ করলুম। এরপর আমরা চললুম লিয়েন্ডার পেয়েসের খেলা দেখতে। হঠাৎ দেখি আমার পাশ দিয়ে কাঁধে একটা ব্যাগ ঝুলিয়ে একটা দৈত্যের মত লম্বা লোক যাচ্ছে। মনে হল আমেরিকার জন ইসনার। বিশ্বের উনিশ নম্বর খেলোয়াড়। ছ’ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি লম্বা। প্রচণ্ড জোরে সার্ভ করে। অটোগ্রাফ চাইব কিনা ভাবতে ভাবতেই সে লম্বা লম্বা পা ফেলে উধাও হয়ে গেল। যাই হোক, লিয়েন্ডার পেয়েসের খেলা দেখলুম। হাজার হোক কলকাতার ছেলে। তারপরে গেলুম সানিয়া মির্জার খেলা দেখতে। সানিয়ারা খুব সহজেই জিতছে দেখে বেরিয়ে পড়লুম। সন্ধ্যে হয়ে আসছে। যদিও গরমকালে এখানে প্রায় দশটা পর্যন্ত আলো থাকে। হঠাৎ দেখি একটা টিভি মনিটারে সব খেলার রেজাল্ট দেখাচ্ছে। দেখি জন ইসনার আর ফ্রান্সের নিকোলাস মাহু পঞ্চম সেট খেলছে আঠারো নম্বর কোর্টে। খেলাটা আসলে শুরু হয়েছিল আগের দিন ২২ তারিখে। দুজনে দু’সেট করে জিতে সমান সমান ছিল। কিন্তু অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় খেলা বন্ধ করতে হয়। ওখানে ফ্লাড লাইটে খেলার কোনও নিয়ম নেই, ব্যবস্থাও ছিল না। আজ খেলা শুরু হয়েছে দুপুরে, শুধু পঞ্চম সেট। প্রথমে ঐ কোর্টে কোনও ভিড় ছিল না। কিন্তু যখন হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছে ঘন্টার পর ঘন্টা তখন ঐ কোর্টে আর তিলধারণের জায়গা ছিল না। আমরা তখন হেনম্যান হিলে গিয়ে দেখার চেষ্টা করলুম। খুব একটা ভাল দেখা গেল না ভিড়ের জন্যে। স্কোর তখন ৪৭-৪৬। কিছুক্ষণ মনিটারে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে স্কোর দেখতে লাগলুম। কেউ কাউকে হারাতে পারছে না আর এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। সেদিন আর নিষ্পত্তি হল না ৫৮-৫৮-তে সেদিনকার মতো খেলা শেষ। আমরা বাড়ির দিকে রওনা দিলুম।
জন ইসনার আর নিকোলাস মাহু পরদিন আবার উইম্বলডনে ফিরে ওদের লড়াই শুরু করল। পাঁচ ফুট আট ইঞ্চির বিশ্বের ১৪৮ নম্বর খেলোয়াড নিকোলাস মাহু অনেক চেষ্টা করেও ছ’ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চির বিশ্বের ১৯ নম্বর জন ইসনারকে হারাতে পারল না। ৭০-৬৮ গেমে পঞ্চম সেট জিতল ইসনার— টেনিসের ইতিহাসে দীর্ঘতম ম্যাচ যা কিনা ২২ তারিখে শুরু হয়ে ২৪ তারিখে শেষ হল। আংশিকভাবে সেই ম্যাচের সাক্ষী থাকতে পেরে আজও অবাক লাগে।