Categories
ভাষাপুকুর |

বিধুশেখর শাস্ত্রী

1413 |
Share
| ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০
শ্যামলী আচার্য

গল্পকার ও বেতার উপস্থাপক

চিত্র: আশ্রমে বিধুশেখর শাস্ত্রী পাঠ দিচ্ছেন অনন্ত শাস্ত্রীকে; সৌজন্য: বিশ্বভারতী আর্কাইভ

বিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রহরে বিশ্বপ্রকৃতির উদার প্রাঙ্গণে ছেলেদের মুক্তি দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ তৈরি করলেন শান্তিনিকেতন-বিদ্যালয়।

শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী বয়ে নিয়ে চলেছে রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনের কর্মসাধনার পরিচয়। এই সাধনা তাঁর মতে, মনুষ্যত্বসাধনা। এই সাধনায় যাঁরা স্থপতি, এই সহযোগীর দল, এঁরা আশ্রমের সৃষ্টিকার্যে নিজেদের সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। এই সঙ্গী কর্মী এবং বন্ধুদের কথাই ধরা রয়েছে ‘শান্তিনিকেতনের গোড়ার কথা’য়।

আজ বিধুশেখর শাস্ত্রীর কথা।

‘শান্তিনিকেতনে এসে প্রথম দেখাতেই স্থানটি আমার চোখে লেগে গেল। আশ্রমটি শাল ও তালের শ্রেণীতে পরিবেষ্টিত বাগানের মধ্যে। আশ্রমের বহু স্থানে উপনিষদের বহু কথা উৎকীর্ণ অথবা লিখিত। অদূরেই পুস্তকালয়— পুস্তকের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও খুব ভালো ভালো বাছাই বই ছিল। দেখলাম, আমার মনের চাহিদার সঙ্গে এর সবকিছু মিলে যাচ্ছে। তাই, আত্ম-উৎসর্গ করলাম এই স্থানটিতে’।

লিখছেন বিধুশেখর শাস্ত্রী।

১৯০৬ সালের জানুয়ারি মাসে কাশী থেকে শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছন পণ্ডিত বিধুশেখর শাস্ত্রী। ক্ষিতিমোহন সেনের সঙ্গে কাশীর সংস্কৃত সাময়িকী ‘মিত্রগোষ্ঠী পত্রিকা’য় লেখালেখিসূত্রে তাঁর পরিচয়। এই ক্ষিতিমোহন সেন পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতন আশ্রমে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এর আগে তাঁর সাক্ষাৎ বা পরিচয় পর্যন্ত ছিল না। এন্ট্রান্স পাশ করার পর রথীন্দ্রনাথকে সংস্কৃত ভাষায় পারদর্শী করে তোলার জন্য রবীন্দ্রনাথ একজন সংস্কৃতজ্ঞের সন্ধান করছিলেন। শান্তিনিকেতন আশ্রম-বিদ্যালয়ের পরিচালক ভূপেন্দ্রনাথ সান্যাল আর অধ্যক্ষ মোহিতচন্দ্র সেন বিধুশেখরকে প্রথম থেকেই চিনতেন। তাঁরাই কাশীতে ডেকে পাঠান শাস্ত্রীমশায়কে। যেদিন তিনি বেনারস থেকে শান্তিনিকেতনে পৌঁছন, তখন সদ্য লোকান্তরিত হয়েছেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ কলকাতায়। কাজেই আশ্রমগুরুর সঙ্গে সেদিন তাঁর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু যখন দেখা হয়েছে তখন থেকেই এই জ্ঞানতপস্বীকে শ্রদ্ধা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। বিধুশেখরও তাঁর প্রজ্ঞা ও মনীষায় অভিভূত হন। বিধুশেখর নিজেই অর্ঘ্যদান অনুষ্ঠানে প্রতিভাষণে বলেন, “প্রথমে রবিঠাকুরের কাছে এসেছিলাম। তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তায় ক্রমশই তাঁর দিকে বেশি আকৃষ্ট হই। কিছুদিনের মধ্যে কেউ রবিঠাকুর বললে কানে বাধত। যেমন দিন কাটতে লাগল মনের গতিও তেমন-তেমন পরিবর্তন হতে লাগল। তাঁকে গুরুদেব বলে উল্লেখ করতে লাগলাম . . . গুরুদেবের মহত্ত্ব প্রতিপদে অনুভব করতে লাগলাম। প্রথমে এসে তাঁকে নমস্কার করতে লাগলাম। বেশিদিন এ চলেনি। মাথা আপনা-আপনিই নিচু হয়ে এল। প্রণাম করতে আরম্ভ করলাম। অভিবাদন করতে আরম্ভ করলাম, তারপর শেষে প্রণিপাত করে ধন্য হয়েছি’।

১৮৭৮ সালের ১০ অক্টোবর তাঁর জন্ম। মালদহের হরিশচন্দ্রপুরের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত তাঁর পিতামহ ছিলেন কাশীর পণ্ডিত মহলে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন। তাঁকে সকলে সম্বোধন করতেন ‘আগমচূড়ামণি’। বিধুশেখরের পিতা ত্রৈলোক্যনাথ ভট্টাচার্য নিজেও সেই পাণ্ডিত্যের যোগ্য উত্তরাধিকারী। এইরকম একটি পরিবারের সন্তান বিধুশেখর ভট্টাচার্য, বাবার আগ্রহে টোলের একজন ছাত্র হিসেবে বিধুশেখরের সংস্কৃত শিক্ষা শুরু হয়। মাত্র সতেরো বছর বয়সেই তিনি ‘কাব্যতীর্থ’ উপাধি লাভ করেন। ফলে, সংস্কৃতে উচ্চশিক্ষালাভের জন্য তাঁর গন্তব্য এবার কাশী। টানা দশ বছর কাশীতে বেদান্ত, ন্যায়দর্শন, কাব্যে অগাধ জ্ঞান অর্জন তাঁকে ক্রমাগত সমৃদ্ধ করে। একের পর এক পণ্ডিতের সান্নিধ্যলাভ করেন তিনি। ভূষিত হন ‘শাস্ত্রী’ উপাধিতে।


রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিধুশেখর শাস্ত্রীর ছবি; চিত্র সৌজন্য: রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, সার্ধশতবার্ষিক স্মরণ, বিশ্বভারতী; বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার: মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

এই সময় অ্যানি বেসান্তের থিয়োজফিক্যাল সোসাইটির লাইব্রেরি তাঁকে অসম্ভব আকৃষ্ট করেছে। মনোরম, নির্জন, শান্ত পরিবেশের ওই গ্রন্থাগারে বসে তাঁর জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। বিধাতাপুরুষ তাঁর এই নীরব অধ্যয়নের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছিলেন। তাঁর এবার ডাক পড়ল শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনের গ্রন্থাগারে এসে এই নবীন আশ্রমিক খুঁজে পেয়েছেন তাঁর ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি’। সংস্কৃত বইয়ের ভাণ্ডারের মধ্যে আকণ্ঠ ডুবে থেকেছেন বিধুশেখর। রবীন্দ্রনাথ নানারকম আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যেও তাঁকে অকৃপণ হাতে জোগান দিয়েছেন একের পর এক সংস্কৃত গ্রন্থ। একদিকে শাস্ত্রীমশায় ছাত্রদের সংস্কৃত পড়াচ্ছেন, অন্যদিকে গুরুদেবের নির্দেশে অবসর সময়ে অবগাহন করছেন বৌদ্ধ ইতিহাস আর দর্শনের গভীর সমুদ্রে।

পড়া আর পড়ানো, এর ফাঁকেই হঠাৎ বিধুশেখরের সাধ হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দেবেন। কেন যেন তাঁর মনে হয়েছিল এতকাল তো তিনি শুধু সংস্কৃতচর্চাই করেছেন, আধুনিক যুগের উপযোগী তেমন কিছু করা হয়ে ওঠেনি। অতএব পড়েশুনে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসলেন তিনি। ফলাফল কিন্তু ভয়াবহ। বিধুশেখর শাস্ত্রী পাশ করতে পারলেন না কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রান্স পরীক্ষায়! আর এই ঘটনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ডেকে পাঠালেন তাঁকে। বললেন, ‘খুব ভাগ্য যে ফেল করেছেন। আপনার একটা মস্ত ফাঁড়া কেটে গেল। পাস করলেই আপনি এফ এ, বি এ, এম এ, পাস করবার চেষ্টায় গতানুগতিক পথে চলে গিয়ে নিজেকে অত্যন্ত সাধারণ করে ফেলতেন। আপনি যে মানুষটি সাধারণ নন, সে কথা আপনি ভুলে যাচ্ছেন। পরীক্ষা পাসের চেয়ে ঢের বড় কাজ আপনার কাজের মুখ চেয়ে বসে আছে। . . . আপনার কাজের অন্ত কি? আমাদের দেশে বৌদ্ধ সভ্যতা-সংস্কৃতি একটা মস্ত বড় জিনিস। এর মূল গ্রন্থাদি এবং বুদ্ধের বাণী বহুলাংশে লেখা পালিভাষায়। দেশে আজ পালিভাষার চর্চা নেই। আপনি পালিভাষা শিখে নিয়ে বৌদ্ধ সংস্কৃতির লুপ্তরত্নাদি উদ্ধার করে দিন’।

একজন জ্ঞানতপস্বীকে আলোকবর্তিকায় সামনের সঠিক পথটি চিনিয়ে দিলেন আরেক মহামানব। উদ্বুদ্ধ সেই মানুষটি রচনা করেছিলেন পালিভাষার প্রথম ব্যকরণ—‘পালি-প্রকাশ’।

কিন্তু এই জ্ঞানপিপাসু মানুষটি শুধু সংস্কৃত আর পালিভাষার চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেননি। তিনি ছিলেন যথার্থ বিশ্বপথিক। শান্তিনিকেতনে তিব্বতি ও চীনা ভাষার চর্চা শুরু হয় তাঁরই আগ্রহে। বৌদ্ধ দর্শনের পাশাপাশি তিনি অনুশীলন করেছিলেন জোরাস্ট্রিয়ান ধর্মশাস্ত্র। প্রাচীন পারসিক জেন্দে ভাষা ছিল তাঁর করায়ত্ত। পারসিক ধর্মগ্রন্থ জেন্দ-আবেস্তার ওপর তাঁর গভীর জ্ঞানে মুগ্ধ হয়েছেন ভারতবিখ্যাত বহু পণ্ডিত অধ্যাপক। সিলভা লেভিঁ, তুচ্চি, কলিন্স, ফর্মিকি, বেনোয়ার মতো সুপণ্ডিত মানুষজন তখন রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণ পেয়ে দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসছেন শান্তিনিকেতনে। এসেছেন দীনবন্ধু এণ্ড্রুজ। রয়েছেন পিয়র্সন। তাঁদের সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে আদান-প্রদানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছেন বিধুশেখর।

তিনি নিজে বলেছেন, ‘গুরুদেব সমগ্র পৃথিবীর সঙ্গে বিশ্বভারতীর এইরূপ একটি যোগস্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন যাতে মনে হত আমরা যেন শান্তিনিকেতন নামে কোনও পরিচ্ছন্ন স্থানে নয়, কিন্তু সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে বাস করছি। জাতি-ধর্ম-দেশ নির্বিশেষে জগতের সকলের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ। সকলের সঙ্গে আমাদের মৈত্রী। জগতে সত্য-সত্যই যাঁরা মনীষী জ্ঞানী ও বিশ্বহিতৈষী তাঁদের সঙ্গে ভাববিনিময়ে গুরুদেব যে সম্বন্ধ স্থাপন করেছিলেন সমগ্র আশ্রমবাসীকে তিনি তার ফল উপভোগের সুবিধা দিয়েছিলেন। . . . টাকা দিয়ে সহজেই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যায়, বিশ্বভারতী স্থাপন করা যায় না’।

দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছেন ‘নিখিল পারাবারের অগস্ত্য মুনি’। দ্বিজেন্দ্রনাথের কাছে শান্তিনিকেতনের সূর্য ও চন্দ্র হলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও বিধুশেখর। মহাত্মা গান্ধীজি অনুরাগী এই মানুষটি আশ্রমে চরকা কেটেছেন। খিলাফত আন্দোলনের সময় মহাত্মাজি যখন শান্তিনিকেতনে আসেন, তাঁর সঙ্গী ছিলেন শওকত আলি। সব ধর্মীয় গোঁড়ামি অগ্রাহ্য করে এঁকে নিয়ে শাস্ত্রীমশাই স্বয়ং চলে যান আশ্রমের রান্নাঘরে। এমনকি বাংলার গভর্নর লর্ড লিটন শান্তিনিকেতনে এলে যে সংবর্ধনা-সভা হয়, সেই সভা কিন্তু বয়কট করেছিলেন বিধুশেখর। এমনই ছিল তাঁর স্বাজাত্যাভিমান।

বিশ্বভারতীর সত্য এবং আদর্শ বিধৃত যে বেদমন্ত্রে, সেটি হল ‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম’। বিধুশেখর এই মন্ত্রটি সংকলন করে উপহার দেন বিশ্বভারতীর প্রতিষ্ঠাতা-আচার্যকে। এই সূত্রেই শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন ঋতু-উৎসব, অনুষ্ঠানের জন্য মন্ত্র, বেদগান, স্নাতকদের জন্য উপদেশ সংকলিত করেন শাস্ত্রীমশায়। তাঁর মনীষার স্বীকৃতি দিয়েছেন ইংরেজ সরকার। ‘মহামহোপাধ্যায়’ উপাধি পেয়েছেন তিনি। ১৯৩৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের ‘আশুতোষ অধ্যাপক’ পদে যোগ দিলেও ১৯৪২-এ তিনি ফিরে আসেন শান্তিনিকেতনে। বিশ্বভারতী ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে এই বিশ্বপথিককে। বাস্তবিকই বিশ্বভারতীর অন্যতম সার্থক রূপকার এই মানুষটির সম্পূর্ণ অনাড়ম্বর জীবন এক আলোকশিখার মতো দীপ্যমান রয়েছে আজও।

ঋণ: বিশ্বভারতী: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; শান্তিনিকেতনের একযুগ: হীরেন্দ্রনাথ দত্ত; রবীন্দ্র-পরিকর: পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়; রবিজীবনী: প্রশান্তকুমার পাল