Categories
গল্পগ্রাম |

প্রতিশোধ

584 |
Share
| ২৯ ডিসেম্বর, ২০২০
দেবাশিস ভট্টাচার্য

অলংকরণ: প্রণবশ্রী হাজরা

এই গল্প আমার এক দাদুর কাছে শোনা, গল্পটা সত্যি কী মিথ্যা জানি না, তবে গল্পটা সেই বয়সে আমার মনে খুবই দাগ কেটেছিল।

আমার এই দাদু মায়ের এক দূর-সম্পর্কের কাকা। তিনি ছিলেন অকৃতদার আর বিশাল ধনী। মাকে ছোটবেলা থেকেই কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছিলেন। যার ফলে মাকে ভালবাসতেন নিজের মেয়ের মতো।

আর আমার তো ভীষণ প্রিয় ছিলেন দাদু, কারণ উনি ছিলেন গল্পের খনি। কত ধরনের গল্প যে আমাকে বলতেন তা আর বলার নয়।

দাদু এলে মা অনেক নতুন নতুন রান্না করতেন। যেসব খাবার দাদুর খুব প্রিয় সেগুলোর ভাগ আমিও পেতাম। না হলে সারা বছর হয় স্টু, নয়তো সেদ্ধ খাবার ছিল আমার জন্য বরাদ্দ। সেইজন্য আমিও অপেক্ষায় থাকতাম দাদুর আসার জন্য।

আর দাদুও আমাদের বাড়িতে এসে দু’হাতে খরচা করতেন আমাদের তিনজনের জন্যে। আমাদের নিয়ে ভাল ভাল হোটেলে খাওয়াতে নিয়ে যেতেন আর দামী দামী উপহার দিতেন।

সর্বোপরি ছিল গল্প বলা। এর জন্য দাদু আমার কাছে ছিলেন হীরের খানি। এই কাহিনি দাদুর নিজের জীবনেরই গল্প। তাই এরপরের অংশ পুরোটাই দাদুর জবানিতে।

 

আমার বয়স তখন বছর কুড়ি বাইশ হবে। আমার বাবা ছিলেন গঞ্জের একজন বড় আড়তদার। যার জন্য পয়সার অভাব কোনওদিনই বুঝি নি। আর আমি আমার বংশের একমাত্র ছেলে হওয়ার জন্য যখনই যা চেয়েছি তাই-ই পেয়েছি।

এই সময় আমাদের গ্রামে আমাদের এক জ্ঞাতি জেঠুর জামাই নরেন ঘোষ এসেছিলেন উড়িষ্যা থেকে। এক বড় কোম্পানির হয়ে ওখানে কাজ করতেন নরেনদা। পেশায় ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আমাদের সঙ্গে ওনার খুব ভাল সম্পর্কও ছিল, প্রায় বন্ধুর মতো। আমাদের চেয়ে বয়সে কিছু বড় ছিলেন, কিন্তু অত্যন্ত অমায়িক ও আন্তরিক ছিলেন।

একদিন বিকেলবেলায় আমাদের বন্ধুদের সাথে নরেনদা মাঠে বসে গল্প করছিলেন। একথা-সেকথার পর আমাদের বন্ধু তিমির নরেনদাকে জিজ্ঞেস করল, তোমার বাড়ির থেকে গন্ধমাদন পর্বত কত দূর। নরেনদা বললেন, সে অনেক দূর— প্রায় বারো ঘন্টা জার্নি করে যেতে হয়। কিন্তু আমার কর্মস্থলের কাছেই একটা নাম-না-জানা পাহাড় আছে, যদি তোরা পাহাড় দেখতে চাস আমার বাড়ির কাছে একটা ছোট পাহাড় আছে সেটা তোরা ঘুরে আসতে পারিস।

তিমির বলল, পাহাড়টার নাম কী গো?

নরেনদা হাসতে হাসতে বললেন, যেকোনও একটা নাম দিলেই চলবে, ধরে নে নতুন পাহাড়।

অনেকে বেড়াতে যায় ওখানে। এছাড়া এই পাহাড়ে অনেক ওষধি গাছও আছে, যার জন্য আয়ুর্বেদ-পড়ুয়াদের কাছে এই পাহাড়ের মূল্য অসীম।

পারলে তোরা সবাই একবার আয়। আমি আশপাশে যা যা দেখার আছে সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেব।

আমি তখন জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা নরেনদা তুমি কি মৃতসঞ্জীবনীর ব্যাপারে আমাদের কিছু বলতে পারবে?

নরেনদা বললেন— না রে! শুধু রামায়ণ মহাভারত মহাকাব্যেই তার উল্লেখ আছে। আজ অবধি কেউ চোখে দেখে নি। তবে ওই পাহাড়ে মৃতসঞ্জীবনী বলে একরকম গুল্ম পাওয়া যায় যা বিভিন্ন রোগ সারাতে কাজে লাগে, বিশেষ করে চর্ম রোগ। কিন্তু প্রাণ ফেরাতে পারে বলে শুনিনি।

এর দিন পনেরো বাদে নরেনদা পুনরায় তার কর্মস্থলে চলে গেলেন, যাওয়ার আগে বারবার করে আমাদের বলে গেলেন ওঁর ওখানে যাওয়ার জন্যে।

এর দু’মাস বাদে আমাদের কলেজের পার্ট ওয়ানের পরীক্ষার পর একদিন খেলার মাঠে বসে ঠিক হল আমরা নরেনদার ওখানে যাব। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেইমতো আমি, তুহিন, রানা আর শিশির মিলে তোড়জোড় শুরু করলাম। ঠিক করলাম আগামী পনেরো দিনের মধ্যে রওনা দেব উড়িষ্যা।

নরেনদাকে সেইমতো চিঠিও পাঠিয়ে জানিয়ে দিলাম আমরা কবে আসছি। নরেনদার কাছ থেকেও চিঠি পেয়ে গেছি। প্রথমে বাড়ির সবাই আপত্তি করলেও পরে আমাদের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হল। মা খুব কান্নাকাটি করছিল, পরে ভাল করে বুঝিয়ে শান্ত করলাম মাকে।

নির্দিষ্ট দিনে সবাই ট্রেনে উঠে রওনা দিলাম উড়িষ্যার দিকে। চারজনের বাড়ি থেকেই অনেক রকম খাবার এসেছিল, তাই রাতে ট্রেনের খাওয়াটা খুব জম্পেশ হল।

উড়িষ্যার একটি গ্রামে নরেনদা এখন আছেন একটি ব্রিজ নির্মাণ-এর কাজের তদারকির দায়িত্বে।

পুরো একদিন ট্রেন জার্নি করে আমরা এসে নামলাম ভুবনেশ্বর স্টেশনে। এখন থেকে গাড়ি করে যেতে হবে নরেনদা যেখানে আছেন সেই গ্রামে।

সব ব্যবস্থা করাই ছিল, স্টেশন থেকে বেরতেই এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। বললেন, আমি রঘুনাথ পানিগ্রাহী, হিসাবরক্ষক। মিস্টার ঘোষ আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাদের নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

গাড়িতে সব জিনিসপত্র ওঠানোর পর রওনা হলাম আমরা। জায়গাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

চারিদিক সবুজ আর সবুজ। পুরো রাস্তার দু’পাশে নাম-না-জানা প্রচুর গাছ, মাঝে মাঝে জঙ্গল। তারই ফাঁকে নাম-না-জানা ছোট ছোট গ্রাম, ক্ষেত, জমি। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছি সবাই। কারুর মুখে কোনও কথাই সরছে না। একটা অদ্ভুত গন্ধ, মাটির সাথে বুনো ফুল মিলে যে গন্ধ হয়— সেই গন্ধ ছাড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকে, সে এক অদ্ভুত মাতাল করা সুগন্ধ।

কখন যে সেই গ্রামে পৌঁছে গেছি জানি না! হুশ ফিরল নরেনদার ডাকে— কি রে তোদের রাস্তায় কোনও অসুবিধা হয়নি তো? আয়, নেমে আয় সবাই।

গাড়ি থেকে নেমে সবাই নরেনদার কোয়ার্টারে গেলাম। বিশাল বিশাল তিন চারটে ঘর, রান্নাঘর, ডাইনিং রুম, টয়লেট নিয়ে নরেনদার কোয়ার্টার।

এর মধ্যে একটা বিশাল ঘর আমাদের জন্যে রাখা হয়েছিল। দিপাদি আমাদের গ্রামের মেয়ে নরেনদার স্ত্রী। আমাদের দেখে খুব খুশি হল বলল, ভেতরে আয়, কেমন আছিস তোরা? রাস্তায় কোনও অসুবিধে হয়নি তো? আগামী দশ পনেরো দিন বাড়ি ফেরার নাম করবি না। যা— এবার তোরা হাত মুখ ধুয়ে নে, আমি তোদের জলখাবার তৈরি করেছি।

দিন কতক সারাদিন ধরে প্রচুর খাওয়া আর আশেপাশে ঘোরার পর, একদিন রাতে খাবার টেবিলে আমরা সবাই নরেনদাকে ধরলাম ‘নতুন পাহাড়’ নিয়ে যাওয়ার জন্যে।

নরেনদার খুব কাজের চাপ চলছিল, তাছাড়া দিল্লি থেকে কোম্পানির একজন বড় অফিসার আসছেন কাজের অগ্রগতি দেখার জন্য। তাই নরেনদা আমাদের বললেন— না রে, এবার আর আমার সময় হবে না। তবে আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তোরা বরং ঘুরে আয়! আমি না হয় পরে তোদের সাথে অন্য কোথাও যাব। নতুন পাহাড়ে তোরা পরশু সকালে যাবি আর রাতে চলে আসবি। কোনও অসুবিধা হবে না। তখন কি জানতাম সামনে কি আতঙ্ক অপেক্ষা করে আছে?

এরপর দু’দিন বাদে ভোরবেলায় আমরা রওনা দিলাম নতুন পাহাড়ের দিকে। আস্তে আস্তে সমতল ছেড়ে আমাদের গাড়ি পাহাড়ের ওপরের দিকে উঠতে আরম্ভ করল। একটা নির্দিষ্ট উচ্চতার পর আর গাড়ি যাবে না। তাই গাড়িটা সেই জায়গায় রেখে দেওয়া হল। ড্রাইভার বলল— বাবু, আপনাদের এখান থেকে হাঁটতে হবে।

সেই জায়গা থেকে শুরু হল আমাদের হাঁটা। স্থানীয় একজন অধিবাসী আমাদের সঙ্গে পথপ্রদর্শক হিসাবে ছিলেন। যাওয়ার আগে ড্রাইভার বারবার বলে দিয়েছিল বিকেলের আগে যেন আমরা নেমে আসি, কারণ অন্ধকার হয়ে গেলে নামতে অসুবিধে হবে।

অসাধারণ নিসর্গ চারিদিকে। সবুজ বড় বড় গাছ তার মধ্যে দিয়ে শুরু হল পায়ে চলা পথ। এক দিকে দুরন্ত খাদ, তার পাশ দিয়ে চলার শুড়িপথ বেশ রোমাঞ্চকর। অনেকটা ওঠার পরে আমরা এক জায়গায় দাঁড়ালাম। ভীষণ ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিল। গাইড যে ছিল, সে বলল কম করে খাওয়ার জন্যে, না হলে উঠতে কষ্ট হবে। দু’পাশে নাম-না-জানা কত ধরনের গুল্মলতা, কত নাম-না-জানা গাছ। গাইডের কাছেই শুনলাম, এগুলো সবই ঔষধি গুল্ম। তার মানে মৃতসঞ্জীবনীও আছে। আমিই জিজ্ঞেস করলাম, মৃতসঞ্জীবনী লতা কোথায় দেখতে পাওয়া যাবে?

গাইড বলল, রাস্তায় অনেক জায়গাতে ওই গুল্ম আছে। এই বলে একটা গুল্মর দিকে হাত দেখিয়ে বলল, এইটা মৃতসঞ্জীবনী গুল্ম ।

আমরা খুব নিরাশ হয়ে বললাম, এখানে কি এমন কোনও গাছ, গুল্ম বা লতা আছে যা কোনও মানুষ কখনও দেখেনি? গাইড বলল, সেরকম কিছু নেই, তবে একধরনের গুল্মর কথা ও জানে যার নাম— শিখরভেদী গুল্ম। আমরা চাপাচাপি করতে বলল, ও শুনেছে এই গুল্ম এখানে পাওয়া যায়, কিন্তু তাকে পাহারা দেয় নাগমনি গাছ। যে বা যারা এই শিখরভেদী আনার চেষ্টা করেছে তারাই মারা গেছে, কিন্তু কীভাবে তা কেউ জানে না। এই গাছ যে ছুঁয়েছে সেই মারা গেছে। এই গাছ ছোঁয়া পাপ, এই গাছ অভিশপ্ত।

আমরা বুঝতে পারছিলাম যে ও জায়গাটা জানে, কিন্তু নিয়ে যেতে চাইছে না। আমি তখন ওকে বললাম— ভাই, আমরা শুধু দূর থেকে দেখে চলে আসব, আর তার জন্যে তোমাকে আমরা টাকাও দেব।

প্রথমে রাজি না হলেও, শেষ অবধি আমাদের চাপে রাজি হল। বলল, নিয়ে যাচ্ছি বাবু কিন্তু আপনারা কথা দিয়েছেন দেখেই চলে আসবেন। আমার কোনও টাকার দরকার নেই। আর একটা জিনিস মনে রাখবেন, শুধু দেখবেন . . . কিছু নেওয়ার চেষ্টা করবেন না, বড় ভয়ানক গাছ।

এরপর শুড়িপথ ছেড়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটা রাস্তা ধরে উঠতে লাগলাম আমরা, আরও ওপরের দিকে। এদিকের পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা, কত নাম-না-জানা গাছের জঙ্গল। উঠতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু আমরা চারজন দাঁতে দাঁত চেপে উঠছিলাম ওপরে আরও ওপরে।

অনেকক্ষণ থেকেই একটা হালকা সুগন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। সারা জঙ্গল জুড়ে গন্ধটা ছড়িয়ে পড়ছিল। কিন্ত আমরা এত ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে একটা সমতল জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম, পা বিদ্রোহ করতে শুরু করেছে। বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে একটু খাওয়া দাওয়া করে আবারও ওঠা শুরু হল।

যত ওপরে উঠছি, ওই গন্ধের তীব্রতা ততই বাড়তে আরম্ভ করেছে। শেষ অবধি আরও কিছুটা ওঠার পর গাইড হাত দিয়ে একটা জায়গা দেখালো। দূর থেকে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। চারিদিকে জঙ্গল আর গাছ। আর একটু এগোতেই গাইড আমাদের বারণ করতে লাগল। আমাদের চারজনেরই জেদ চেপে গিয়েছিল শেষ অবধি দেখার— কী সেই শিখরভেদী গুল্ম যার বিষ স্পর্শে প্রাণ হারিয়েছে প্রচুর মানুষ।

দূর থেকে দেখতে পাওয়া গেল, শিখরভেদী লতাকে। গাইড বলল, ওই দেখুন বাবু— ওটাই সেই সর্বনাশা শিখরভেদী লতা। তার ঠিক আগেই সামনের অংশটা ঢেকে রেখেছে অন্যজাতের গুল্ম দিয়ে। কী অদ্ভুত রং এই শিখরভেদী গুল্মর, সবুজ পাতা তার সাথে লাল আর সাদা ছিট ছিট দাগ। তার সাথে একটা পাগল করা সুগন্ধ।

আমাদের মধ্যে শিশির ছিল খুবই সাহসী। ও বলল, এতদূর যখন এসেছি একটা পাতা নিয়েই যাব। না হলে কেউ বিশ্বাসই করবে না আমাদের কথা।

এবার গাইড লোকটি প্রচণ্ড রেগে গেলেন এবং আবার বারণ করে বললেন, এই গাছ স্পর্শ করলেই মৃত্যু অবধারিত। এছাড়া আপনারা কথা দিয়েছিলেন গাছ স্পর্শ করবেন না।

আমরাও শিশিরকে বারণ করলাম। ও কিন্তু নাছোড়। একটা পাতা ও নিয়েই যাবে। আমাদের সকলের নিষেধ না মেনেই শিশির এগিয়ে গেল শিখরভেদী গুল্মর দিকে। ওর ব্যাগে একটা ছোট ছুরি ছিল। গুল্মর ঝোপটার সামনে দাঁড়িয়ে ছুরিটা বের করে একটা পাতা কাটল। দূর থেকে আমরা সবাই রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে আছি শিশিরের দিকে। কী হয়, কী হয়?

পাতাটা কাটা মাত্র একটা কালো মতো আঠা বের হতে শুরু করল কাটা জায়গাটা দিয়ে। শিশিরের হাতেও আঠাটা লেগে গিয়েছিল। ও হাতটা ওর প্যান্টের গায়ে মুছতে মুছতে আমাদের কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, কী রে ভীতুর দল— দেখ আমি নিয়ে এসেছি শিখরভেদীর পাতা। কিছু হল আমার?

মনটা কু গাইছিল, মনে হচ্ছিল একটা ভয়ানক কিছু ঘটতে চলেছে।

আচমকা শিশির চেঁচিয়ে উঠল ‘মাগো’ বলে! তারপরই ওর হাতে যেখানে রসটা লেগেছিল সেই জায়গাটা প্যান্টের গায়ে ঘষতে আরম্ভ করল।

আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কী হল রে?

শিশির বলল, কিছু নয়— চল ফেরা যাক।

আচমকাই আমারই চোখটা গেল ওর হাতের দিকে— কী একটা উঠে আসছে ওর চামড়া ভেদ করে— একটা ছোট গাছের মাথা! এরপর বলতে যতক্ষণ সময় লাগছিল তারও কম সময়ে শিশিরের হাত, চোখ, মুখ, মাথা চতুর্দিক থেকে বেরিয়ে আসতে লাগল সেই সবুজ গুল্ম।

আস্তে আস্তে ওর মুখ, চোখ, কান দিয়েও বেরতে আরম্ভ করল সবুজ গুল্ম . . .  সঙ্গে সেই তীব্র সুগন্ধযুক্ত কালো রস।

মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে ওর শরীরের নানা অংশ দিয়ে বেরতে আরম্ভ করল আরও শিখরভেদী লতা অথবা সেই দানব লতা। শিশির শেষবারের মতো চিৎকার করে উঠল ‘প্লিজ আমাকে তোরা বাঁচা’।

বাঁচাব কী! আমরা সবাই কাঁপছি তখন থরথর করে। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশির পুরোপুরি একটা লতা বা গুল্মে পরিণত হল।

আমাদের সামনে থেকে এরপর গুল্মটা সড়সড় করে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে গেল আরও অনেকগুলো গুল্মর সাথে। একটু আগেই দাঁড়িয়ে থাকা একটা প্রাণবন্ত ছেলে নিমেষে পরিণত হল একটা লতায়।

গাইডের চিৎকারে হুঁশ ফিরল আমাদের। অনেকগুলো লতা নিঃশব্দে সড়সড় করে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। সারা অরণ্যভূমি যেন উঠে পড়ে লেগেছে এক না-বলা প্রতিহিংসা মেটাতে।

আমরা তিনজন আর গাইড পেছন ফিরে দৌড়তে শুরু করলাম। হাত-পা কেটে যাচ্ছে কাঁটাতে। সে-খেয়ালও নেই, শুধু একটাই চিন্তা— নিচে নামতে হবে; না হলে আমাদেরও দশা হবে শিশিরের মতো।

কতক্ষণ দৌড়েছিলাম মনে নেই। গাড়ির কাছে এসে আমাদের সকলের জিভ তখন বেরিয়ে গেছে। নিঃশ্বাস মনে হচ্ছে বন্ধ হয়ে যাবে। একটু বিশ্রাম নিয়ে তাকালাম পাহাড়ের মাথার দিকে, যেখানে চিরজীবনের মতো রয়ে গেল আমাদের প্রিয় বন্ধু শিশির— একটা গুল্ম হয়ে।

এরপর যা হয়। পুলিশ কেস, কোর্ট কাছারি—অনেক ভুগতে হয়েছিল আমাদের। শেষে আমরা বেকসুর খালাস হই উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে।

এখনও মাঝেমাঝে রাত্তিরে স্বপ্নের মধ্যে দেখি একটা গুল্ম তার কালো কালো আকর্ষ দিয়ে টানছে আমায়। আমি চিৎকার করছি, ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে।

কেউ নেই আমাকে বাঁচানোর জন্যে। আস্তে আস্তে আমি পরিণত হচ্ছি একটা গুল্মে . . .