Categories
গল্পগ্রাম |

মনসুর আলির বাগানবাড়ি

1049 |
Share
| ২০ জানুয়ারী, ২০২১
শর্মিষ্ঠা বসু

চিত্র: বিশ্বজিৎ দে ও কমলাকান্ত পাকড়াশী; গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী

মৌখালি থেকে পাঁচ-ছয় কিলোমিটার দূরে বাড়িটা। প্রকাণ্ড বাড়ি। কম্পাউন্ড ঘিরে উঁচু পাঁচিল, বড় লোহার গেট দিয়ে ঢুকলেই মস্ত বাগান – তাতে আম, জাম, কাঁঠাল, বেদানার গাছ। বাগান পেরিয়ে মূল বাড়ি। বাড়ি না বলে অবশ্য প্রাসাদ বলাই ভাল। চওড়া বারান্দার দু’পাশে মস্ত বড় বড় ঘর, শ্বেতপাথরের মেঝে, বৈঠকখানা পেরিয়ে বাঁধানো চাতালের চারদিকে কারুকার্য করা মোটা মোটা থাম, চওড়া শ্বেতপাথরের সিঁড়ি উঠে গেছে ছাদে।বাড়ির পেছনেও অনেকখানি জমি। একসময় হয়তো বাগান ছিল, তবে এখন আগাছা আর বুনো ঝোপঝাড়ে ঢাকা।

এমন বাড়ি এত কম ভাড়ায় পেয়ে একটু অবাক হয়েছিলাম। তবে এ বাড়িতে থাকতে পারব ভেবে মন ভাল হয়ে গিয়েছিল। এত বড়, এত সুন্দর একটা বাড়ি, তাও আবার নামমাত্র ভাড়া।

মৌখালিতে একমাস আগেই এসেছি আমি। এখনও তেমন চেনাজানা হয়নি, তবু অফিসেই দু’চারজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম বাড়িটার ব্যাপারে। কেউই তেমন কিছু বলতে পারল না। শুধু রামতনু বলল, ‘ও বাড়িটা নেবেন না কুন্তলদা। ওটা মনসুর আলির বাগানবাড়ি। আপনার আগে অনেকেই থাকতে গিয়েছিল ওখানে, কেউই থাকতে পারেনি। রাত বাড়লে নাকি বাড়িটা জীবন্ত হয়ে ওঠে। ঝাড়লন্ঠন জ্বলে, নাচগানের আওয়াজ ভেসে আসে’।

রামতনুর কথায় কর্ণপাত করিনি। এমনিতে পরোপকারী, ভাল ছেলে বলে যথেষ্ট সুনাম আছে রামতনুর, তবে ছেলেটিকে আমার একটু ভীতু প্রকৃতির বলেই মনে হয়। আর তাছাড়া আমি বিজ্ঞানের ছাত্র। ভূত প্রেতে আমার কোনওদিনই বিশ্বাস নেই। সুতরাং রামতনুর কথায় আর তেমন গুরুত্ব দিলাম না।

নতুন বাড়িতে এসে মন বেশ ভাল হয়ে গেল। খোলামেলা বাড়ি, চারদিকে গাছগাছালি, ভোর না হতেই অসংখ্য পাখির কূজন। আমার বহুদিনের সঙ্গী রতনও এ বাড়িতে এসে খুব খুশি। নিজের মতো করেই সে গুছিয়ে নিয়েছে তার নতুন সংসার। দিনরাত ঘষেমেজে সাফসুতরো করে রাখছে নতুন বাড়ি।

মাসখানেক ভালই ছিলাম। তারপর একদিন হঠাৎ একটু গণ্ডগোল করল রতন। সেদিন রবিবার। একটু বেলা করেই উঠেছিলাম ঘুম থেকে। হঠাৎ চিৎকার শুনে বাইরে গিয়ে দেখি থরথর করে কাঁপছে রতন। মুখখানা ভয়ে সাদা। আমার ধমক খেয়ে কেঁদে ফেলল রতন।

বলল, ‘এ বাড়িতে ভূত আছে দাদা। এখনই পেছনের বাগানে জঞ্জাল ফেলতে গিয়ে দেখি একটা লোক, চোখ দুটো জবা ফুলের মতন লাল, কটমট করে দেখছে আমাকে। চোখ দু’খানা দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে। তারপর হঠাৎ এক নিমেষে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল লোকটা’। কথা বলার সময় হাঁপাচ্ছে রতন।

আমি হেসে ফেললাম। এই একবিংশ শতাব্দীতে দিনদুপুরে ভূত! এসব আজগুবি গল্প যত কম গুরুত্ব দেওয়া যায়, ততই ভাল। রতনকে সেদিনের মতো ধমকে শান্ত করলেও কয়েকদিন পরেই আবার ঘটল সেই ঘটনা।

একদিন গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনে বাইরে যেতেই দেখি অর্ধচেতন হয়ে পড়ে আছে রতন। চোখেমুখে জল ছিটিয়ে দিতেই চোখ খুলে তাকাল সে। তারপর সেই একই গল্প শোনাল আমায়। আজও জঞ্জাল ফেলতে গিয়ে নাকি লোকটাকে সে দেখতে পেয়েছে আবার। এবার একটু সন্দেহ হচ্ছিল আমার। কোনও চোর-টোর নয়তো! বাড়িটাতে দামি আসবাবপত্র রয়েছে বেশ কিছু, সেসবের দিকেও নজর থাকতে পারে। সাবধান হতে হবে।

রতনের কথা শুনে পেছনের বাগানটা নিজেই একবার দেখতে বেরোলাম। অযত্নে ঝোপঝাড়ে ভরে গেছে বাগানটা। তার ওপরে ওখানেই জঞ্জাল ফেলে ডাঁই করেছে রতন। ভনভন করছে মশা মাছি। দেখে রাগ হচ্ছিল আমার। এমন অপরিষ্কার করে কেউ রাখে বাগানটাকে!

ঘরে ঢুকে রতনকে আবার খানিক ধমকধামক দিলাম আর মনে মনে ঠিক করলাম এবার থেকে পেছনের বাগানটার নিজেই যত্ন করব আমি।

পরের রবিবারই লোকজন ডেকে বাগানটা পরিষ্কার করালাম। মৌখালির নার্সারি থেকে চারাগাছ এনে পুঁতলাম বেশ কিছু, মরা গাছগুলোকে ছেঁটে কেটে ফেলে দিলাম। বাগানের ভেতরে একটা বাঁধানো বেদির পুরোটাই জঞ্জালে ঢেকেছিল, সেটাকেও লোক দিয়ে সাফসুতরো করালাম। ফুলের টব বসালাম বেদিটার ওপর। সব মিলিয়ে একদিনেই চেহারা বদলে গেল বাগানটার। বিকেলে অফিস থেকে ফিরে প্রায়ই বসে চা খেতাম ওখানে। নানা রঙের ফুলের গাছ, নাম না জানা পাখির ডাক, সব মিলিয়ে বেশ অন্যরকম একটা অনুভূতি হত।

এভাবেই বছরখানেক কেটে গেল। আর তেমন কোনও সমস্যা হয়নি। দিব্যি ছিলাম বাড়িটাতে। রতনও আর কখনও কাউকে দেখেনি। এর মধ্যেই আমার হঠাৎ হরিশপুরে অফিসের কাজ পড়ল। রাতের ট্রেন। কামরায় উঠে দেখলাম লোক প্রায় নেই বললেই চলে। রতন টিফিন ক্যারিয়ারে কিছু খাবার দিয়ে দিয়েছিল। খেতে গিয়ে মনে পড়ল জলের বোতলটা বাড়িতেই ফেলে এসেছি।

নবীপুর স্টেশনে ট্রেন দাঁড়াতেই নেমে পড়লাম। জলের বোতল কিনে গাড়িতে উঠতে যাব, হঠাৎ দেখি একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে।

‘তুমি মৌখালির কুন্তল চৌধুরী না?’ অচেনা জায়গায় নিজের নাম শুনে অবাক হলাম।

ভুরু কুঁচকে বললাম, ‘হ্যাঁ , আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না’। লোকটা একটু চুপ করে রইল। তারপর বলল, ‘চিনে কাজ নেই। যা বলছি তাই শোনো। ঐ গাড়িতে আর উঠতে হবে না। এখানেই থেকে যাও আজ রাতটা’। তার মানে! রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছিল আমার। কে এই লোকটা! পাগল নাকি! এদিকে দেখছি আমার নামধামও জানে। কোনও কুমতলব নেই তো! স্টেশনের আবছা আলোয় ভাল করে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করলাম একবার। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। আপাদমস্তক কালো কম্বলে ঢাকা লোকটার জ্বলজ্বলে দুটো চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লোকটার কথায় পাত্তা না দিয়ে ট্রেনের দিকে এগিয়ে যেতেই আবার পথ আটকাল লোকটা। কিছু বলার আগেই প্রায় ধমকে বলল, ‘খবরদার! ঐ গাড়িতে উঠবে না তুমি। নেহাৎ আমার যত্ন আত্তি করো, তাই এত কথা বলা, না হলে . . .’।

এবার আমার আবার অবাক হওয়ার পালা। যত্নআত্তি করি? আমি ? মানেটা কী! কস্মিনকালেও দেখিনি লোকটাকে, যত্ন করা দূরে থাক। বদ্ধ পাগল হবে, কোথা থেকে উদয় হল কে জানে। বিরক্ত লাগছিল আমার। তবু লোকটাকে সরিয়ে কেন যেন এগোতে পারছিলাম না। বেশ বুঝতে পারছিলাম কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সব। চোখের সামনে দিয়ে ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যেতে সম্বিৎ ফিরল আমার। কিন্তু তখন ট্রেনে ওঠার উপায় আর নেই।

মাঘ মাস। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা। হিমেল হাওয়ার কামড়ে যেন অবশ হয়ে আসছে শরীর। চারদিকে তাকিয়েও লোকটাকে দেখতে পেলাম না আর। রাগে, বিরক্তিতে অসহ্য লাগছিল। কে কোথাকার একটা লোক এসে দিল সব ভণ্ডুল করে। এদিকে মালপত্র সব ট্রেনেই পড়ে আছে। কিন্তু তখন আর কীই বা করতে পারি! বাধ্য হয়ে সে-রাতটা ওয়েটিং রুমে কাটিয়ে, ভোরবেলার ট্রেনে মৌখালি ফিরে এলাম।

বাড়ি ঢুকতেই চা নিয়ে এল রতন। বলল, ‘কাল সারারাত ছিলে কোথায়? কে একজন এসে তোমার সুটকেসখানা দিয়ে গেল। বলল তুমি নাকি আজ ভোরে ফিরবে’। অবাক হয়ে তাকাতেই পাশের টেবিলে রাখা খবরের কাগজখানা চোখে পড়ল। আর তারপরেই মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করতে লাগল। গতকাল রাতের এক্সপ্রেস ট্রেনটাতে নবীপুরের পরের স্টেশনেই আগুন লেগেছে। কামরার মধ্যেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে বহু মানুষ। ঐ ট্রেনেই তো আমার হরিশপুরে যাওয়ার কথা ছিল! তাহলে যে লোকটা আমায় ট্রেনে উঠতে দিল না সে কে? আর আমার সুটকেস বাড়িতে পৌঁছেই বা দিল কে?

কেমন যেন শিরশির করে উঠছিল গা! কোনও কিছু ভাবার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে যেন। ভাবলেশহীন হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। পরদিন অফিসে গিয়ে আর কাউকে কিছু না বললেও রামতনুকে খুলে বলেছিলাম সব কথা। রামতনু খোঁজখবর নিয়েছিল। তারপর ওর কাছেই জানতে পেরেছিলাম সবটা।

আমি যে বাড়িতে থাকি সেটি প্রায় একশ বছরের পুরনো। মৌখালির জমিদার মনসুর আলির বাগানবাড়ি। একসময় বেজায় দাপট ছিল মনসুর মিয়াঁর। বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খেত তাঁর ভয়ে। তারপর জমিদারি চলে গেল একসময়। বৃদ্ধ মনসুর মিয়াঁ মারা গেলেন একদিন। পেছনের বাগানেই কবর দেওয়া হল ওঁকে। বাগানে যে বেদিটা, সেটা আসলে মনসুর মিয়াঁর কবর। ওর নিচেই ঘুমিয়ে আছেন মনসুর আলি। বেশ বুঝতে পারলাম, রতন ওখানে জঞ্জাল ফেলত বলে মনসুর আলিই এসে ভয় দেখাত ওকে। আর আমি কবর আর তার আশেপাশে সব পরিষ্কার করে রেখেছি বলে সেদিন আমাকে স্টেশনে দাঁড়িয়ে ঐ যত্নআত্তি করার কথাটা বলেছে। শুধু তাই নয়, ঐ বাগান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেছি বলে প্রাণও বাঁচিয়ে দিয়েছে আমার।

সেই থেকে ও-বাড়িতেই থেকে গেছি। মনসুর মিয়াঁর সঙ্গে আর কোনওদিন দেখা হয়নি। এখনও প্রতি রবিবার কবরের আশপাশটা নিজেই পরিষ্কার করি। ফুল গাছগুলোর যত্ন করি। যার বাড়ি তাঁকে তো একটু খুশি রাখতেই হয়। তবে গত পাঁচবছর ধরে এ বাড়িতে দিব্যি আছি আমি আর রতন। এমন সুন্দর খোলামেলা বাড়ি! শুধু তাই নয়, কোথাও একটা বিশ্বাস জন্মে গেছে যে এ বাড়িতে থাকলে কেউ আমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না কোনওদিন।