Categories
গল্পগ্রাম |

দত্যির মাঠ

573 |
Share
| ২৩ জানুয়ারী, ২০২১
রাজর্ষি চক্রবর্ত্তী

ছবি ও গ্রাফিক্স: কমলাকান্ত পাকড়াশী

অনেকদিন আগের কথা। ২৪ পরগণার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দুটি গ্রাম ছিল— বিষ্ণুপুর ও হরিপুর। দুটি গ্রামের মধ্যে ছিল একটি তেপান্তরের মাঠ। মাঠে খুব একটা বড় গাছ ছিল না, খালি মাঠের মাঝ-বরাবর একটি বড় প্রাচীন বটগাছ ছিল। এই বটগাছ ছিল দুটি গ্রামের লোকের কাছেই ভয়ের কারণ। এই গাছে নাকি এক ব্রহ্মদত্যি বাস করত। দিনমানে এই গাছ পেরিয়ে লোক একগ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেত বটে, কিন্তু একবার সূর্য ডুবলে এই পথ আর কেউ মাড়াত না। কেউ যে ব্রহ্মদত্যিকে দেখেছে তা কিন্তু নয়। তবে শোনা যায় অনেক আগে একবার এক সাহসী যুবক নাকি সন্ধ্যার পরে ঐ দিক দিয়ে যাচ্ছিল আর ব্রহ্মদত্যি তাকে বটগাছের মগডালে তুলে নিয়েছিল। পরদিন সেই যুবককে গ্রামের মানুষ বটগাছের তলায় পড়ে থাকতে দেখে। জ্ঞান ফেরার পর সে ব্রহ্মদত্যির এমন বর্ণনা দিয়েছিল যে আর কোনওদিন কেউ সন্ধ্যার পর ঐ মাঠ পেরোবার সাহস দেখায়নি। লোকমুখে ঐ মাঠের নামই হয়ে গিয়েছিল দত্যির মাঠ।

সে সময় বিষ্ণুপুরে এক গরীব ব্রাহ্মণ যুবক থাকত, নাম অভয়চরণ। তারা এক ভাঙা জমিদার বাড়িতে বসবাস করত। মা ঠাকুমার মুখে অভয়চরণ শুনেছিল যে তার পূর্বপুরুষরা নাকি বিষ্ণুপুরের জমিদার ছিল। তাই উত্তরাধিকার সূত্রে তারা এই বাড়িতে থাকে। এখন আর সে জমিদারিও নেই আর সে প্রভাব-প্রতিপত্তিও নেই। তবে একসময় তারা যেহেতু জমিদার ছিল তাই অভয়চরণ একটু সম্মান তখনও বিষ্ণুপুরে পেত, কিন্তু তাই দিয়ে তো আর পেট ভরে না। পেট ভরার জন্য অভয়চরণ পূজা-অর্চনা করত। তাতেই তার ও তার মা ও ঠাকুমার কষ্টেসৃষ্টে দিন চলে যেত। যে বাড়িতে পুজো বা অন্য ধর্মীয় কাজে অভয়চরণ যেত সেখানে সে ভরপেট খেয়ে আসত আর নৈবেদ্যর ভাগ মা ও ঠাকুমার জন্য নিয়ে আসত। তার খাওয়া দেখে অনেক সময় গ্রামের লোক আড়ালে বলত, ‘কালিচরণের ব্যাটা খুব পেটুক’। গ্রামের লোকের মুখে মুখে আর একটা কথা ঘুরত। লোকে বলত অভয়চরণের এক পূর্বপুরুষ অন্নদাচরণ নাকি মারাঠা আক্রমণের সময় প্রচুর মোহর কোথাও লুকিয়ে রেখেছিল। বহু মানুষ সেই গুপ্তধনের খোঁজ করেছেন কিন্তু কেউ পায়নি। লোকে বলত সেই গুপ্তধন যদি অভয়চরণ বা তার কোনও উত্তরপুরুষ পায় তবে তাদের ভাগ্য ফিরে যাবে। অভয়চরণ অবশ্য এইসব কথাকে খুব একটা পাত্তা দিত না। তার স্থির বিশ্বাস ছিল ওইসব আর পাওয়ার কোনও আশা নেই, তার থেকে বরং ভাল খাবার চিন্তা করাই ভাল। কারণ খেতে সে খুব ভালবাসত।

একবার অভয়চরণ হরিপুরে একটা বড় পুজো করার আমন্ত্রণ পেল। ওই গ্রামের জমিদারদের বাড়ির বিশালাক্ষী পুজো। এটা অভয়চরণের কাছে পরম সৌভাগ্য মনে হল। সে সব গোছগাছ করে হরিপুরের দিকে রওনা দিল। যাবার সময় মা ঠাকুমাকে আশ্বাস দিয়ে গেল যে সে আজ অনেকদিন পরে ভাল খাবার নিয়ে আসবে।

হরিপুরে জমিদার বাড়িতে সে ঠিক সময় পৌঁছে গেল ও দেবী বিশালাক্ষীর মন দিয়ে পুজো করল। পুজো যখন শেষ হল তখন অভয়চরণের পেটে আগুন জ্বলছে। জমিদার বাড়ির মেয়ে বউরা খুব যত্ন করে অভয়চরণকে খেতে দিল। একে প্রচণ্ড খিদে তায় এত রকম সুস্বাদু পদ— অভয়চরণ গোগ্রাসে খেল। খাওয়ার পর জমিদার মশাই অভয়কে একটু জিরিয়ে নিতে বললেন। কিন্তু এত খাওয়ার ফলে জিরতে গিয়ে অভয় পড়ল ঘুমিয়ে। যখন অভয়ের ঘুম ভাঙল তখন সূর্য পাটে বসেছে। তাই সে তাড়াতাড়ি তার পাওয়া জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বিষ্ণুপুরে ফেরার তোড়জোড় করতে লাগল। জমিদার মশাই অভয়কে ভালই দক্ষিণা দিলেন ও বললেন সেই রাতটা তার বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন সকালে বিষ্ণুপুরে ফিরতে। তিনি আশঙ্কা করেছিলেন এখন অভয় যদি বাড়ির পথ ধরে তাহলে দত্যির মাঠ পেরতে সন্ধ্যা নেমে যাবে। সন্ধ্যার পর ওই মাঠ পেরোনো মোটেই নিরাপদ নয়। তবে অভয় তার মা ঠাকুমাকে বলে এসেছে যে সে আজ ভাল খাবার নিয়ে ফিরবে। তারা আশা করে পথ চেয়ে বসে থাকবেন। তাই অভয় কিছুতেই থাকতে রাজি হল না। সে জমিদার মশাইয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হনহন করে বিষ্ণুপুরের পথে পা বাড়াল।

অভয় সেই তেপান্তরের মাঠ অর্ধেকও পেরোয়নি যখন সন্ধ্যা নেমে গেল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। অভয় কোনওদিকে না তাকিয়ে হাতের পুটুলিগুলি শক্ত করে ধরে হনহন করে হেঁটে চলেছে। মনে মনে ভাবছে আজ কতদিন পরে কী ভাল ভাল খাবারই না সে খেল। এমন খাবার যদি রোজ সে খেতে পেত তাহলে কী ভালই না হত। পোলাওয়ের স্বাদটা এখনও মুখে লেগে আছে।

হঠাৎ তীক্ষ্ণ বাজখাই গলায় কে যেন হেঁকে উঠল ‘কেঁ যাঁয়?’ অভয় হকচকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল, কিন্তু অন্ধকারে ভাল করে দেখা যায় না। এবার সামনে তাকিয়ে যা দেখল তাতে তো তার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হবার জোগাড়। কখন যেন তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সাদা ধুতি-চাদর পড়া এক লম্বা ছায়ামূর্তি। তাঁর ধুতি-চাদর, মুখ, হাত, পা এমনই সাদা যে এই অন্ধকারেও দেখা যাচ্ছে। ভয়ে তো অভয়ের হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যেতে লাগল।

ছায়ামূর্তি আবার বলে উঠল— ‘তুঁই কেঁ? এঁমন ভঁর সঁন্ধ্যাবেলা অঁন্নদার বঁটগাছের সাঁমনে দিঁয়ে যাঁচ্ছিস? তোঁর কিঁ কোঁন ভঁয় ডঁর নেঁই?’

অভয়চরণ ভাবল ভয় ডর নেই? ভয়ে তার হৃদকম্পন বন্ধ হবার উপক্রম। সে মনে মনে বেশ বুঝতে পারছে যে সে দত্যির মাঠে ব্রহ্মদত্যির কবলে পড়েছে। আজ তার আর নিস্তার নেই। সামনের ছায়ামূর্তি আবার বলে উঠল, ‘অঁন্নদাচরণের ডেঁরার সাঁমনে দিঁয়ে ভঁর সঁন্ধ্যেবেলা কেঁ যাঁচ্ছিস রেঁ তুঁই?’ প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যেও অন্নদাচরণ নামটা অভয়ের মাথায় বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো খেলে গেল। এই নামটা তো সে তার মা, ঠাকুমা, পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে বহুবার শুনেছে। তার এক পূর্বপুরুষ ছিলেন অন্নদাচরণ যিনি মারাঠা আক্রমণের ভয়ে অনেক সম্পত্তি লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেই গুপ্তধন তাঁর মৃত্যুর পর আর কেউ খুঁজে পায়নি। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অভয়চরণ বলল, ‘মানে . . . মানে . . . মানে . . . আমি আপনার নাতির . . . নাতির . . . নাতি’। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে অভয় হয়তো আরও কয়েকবার নাতি বলে ফেলত কিন্তু তার আগেই ছায়ামূর্তি বাজখাই গলায় গর্জন করে উঠল, ‘মাঁনে! আঁমি তোঁর ঠাঁকুরদার . . . ঠাঁকুরদার . . . ঠাঁকুরদা? আঁজ তোঁর ঘাঁড় আঁমি মঁটকাব’।

ঘাড় মটকানোর কথায় অভয় বুঝল তার আজ আর পালাবার পথ নেই, দেওয়ালে তার পিঠ ঠেকে গিয়েছে। সে মরিয়া হয়ে বলল, ‘আমি মা ঠাকুমা, গ্রামের লোকের কাছে শুনেছি আমাদের আদি পুরুষের নাম অন্নদাচরণ। আমরা যে ভাঙ্গা বাড়িতে এখন থাকি তার নাম অন্নদাভবন। তাই বলে ফেললাম আমি আপনার নাতির নাতির নাতি’।

এবার ছায়ামূর্তি একটু অন্যরকম স্বরে বলল, ‘তোঁরা অঁন্নদাভবনে থাঁকিস? আঁমি তোঁ ওঁই বাঁড়ি বাঁনিয়েছিলাম। আঁমার ছেঁলে দূঁর্গাচরণ আঁমি মাঁরা যাঁবার পঁর শ্রাঁদ্ধের সঁময় লোঁক নিঁমন্ত্রণ কঁরার জঁন্য প্রঁথম অঁন্নদাভবন কঁথাটা ব্যঁবহার কঁরে নিঁমন্ত্রণ পঁত্রে। তাঁরপর আঁর ওঁই বাঁড়ির কঁথা কিঁছু জাঁনি নাঁ। কঁতকাল হঁয়ে গেঁল এঁই বঁটগাছ ছেঁড়ে কোঁথাও যাঁইনা। তোঁর মুঁখে কঁতকাল পঁরে অঁন্নদাভবন নাঁমটি শুঁনলাম রেঁ বাঁপ’। ছায়ামূর্তির গলা কেমন উদাস হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ আর কোনও কথাবার্তা নেই। ছায়ামূর্তি আর অভয় দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। শুধু ঝিঁ-ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যায়।

অভয়ের অস্বস্তি বেড়ে যায়। নিরবতা ভেঙে সে বলে, ‘আপনি এই গাছ ছেড়ে আর কোথাও যাননি কেন?’ এবার ছায়ামূর্তি আবার দুলে উঠে বলতে শুরু করে, ‘সেঁ অঁনেক কঁথা রেঁ বাঁপ। তঁখন দেঁশে বঁর্গি আঁক্রমণ চঁলছে। যাঁদের কিঁছু অঁর্থকঁড়ি আঁছে তাঁরা ভঁয়ে মঁরছে। বঁর্গিরা তাঁদের সঁব কেঁড়ে নিঁচ্ছে। নাঁ দিঁলে প্রাঁণ নিঁচ্ছে। আঁমি তাঁই আঁমার সঁঞ্চিত আঁট ঘঁড়া মোঁহর রাঁতের অঁন্ধকারে এঁই বঁটগাছের নিঁচে পুঁতে রাঁখলাম। শেঁষ অঁবধি আঁমাদের গ্রাঁমে আঁর বঁর্গিরা আঁসেনি। কিঁন্তু মোঁহরের কঁথা আঁমার ছেঁলেকে জাঁনানোর আঁগেই আঁমি পঁট কঁরে মঁরে গেঁলুম। তাঁরপর আঁমার ব্যাঁটা আঁমার শ্রাঁদ্ধ কেঁমন কঁরল সেঁটা দেঁখতে এঁকবারই গ্রাঁমে গিঁয়েছিলাম আঁর কোঁথাও যাঁইনি। মোঁহরের মোঁহে এঁই বঁটগাছেই ডেঁরা বেঁধেছি। সেঁই থেঁকে মোঁহর পাঁহাড়া দিঁয়েই চঁলেছি। কেঁউ এঁদিকে আঁসলেই তাঁকে এঁমন ভঁয় দেঁখাই যেঁ সেঁ পাঁলিয়ে বাঁচে। সঁব সঁময় ভঁয়ে ভঁয়ে থাঁকি যঁদি কেঁউ আঁমার মোঁহরগুলি চুঁরি কঁরে নেঁয়। তঁবে আঁর ভাঁল লাঁগে নাঁ, কঁতকাল এঁইভাবে মোঁহর আঁগলে আঁমি বঁসে থাঁকব?’ এই কথাগুলি শুনে অভয়ের মনে মনে একটু কষ্টই হতে লাগল ছায়ামূর্তির জন্য।

এবার ছায়ামূর্তি সুর খুব নরম করে বলল, ‘আঁমার এঁকটা উঁপকার তোঁকে কঁরতে হঁবে বাঁপ। এঁই মোঁহরগুলি তোঁ আঁমি আঁমার বংশধঁরদের জঁন্যই মাঁটিতে পুঁতেছিলাম। তুঁই আঁমার নাঁতির নাঁতির নাঁতি। আঁমার এঁই মোঁহরগুলি তোঁকে নিঁতে হঁবে। এঁগুলি তোঁকে দিঁয়ে আঁমি মোঁহরের মোঁহ কাঁটিয়ে প্রেঁতলোক থেঁকে অঁন্যলোকে চঁলে যাঁব’। অভয়কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছায়ামূর্তি বলল, ‘এঁখন সোঁজা বাঁড়ি চঁলে যাঁ। কাঁল কাঁকভোরে এঁকটা গঁরুর গাঁড়ি নিঁয়ে এঁসে আঁট ঘঁড়া মোঁহর বঁটগাছের নিঁচ থেঁকে তুঁলে নিঁয়ে যাঁবি। আঁটঘড়া মোঁহর গঁরুর গাঁড়িতে উঁঠলেই দেঁখবি বঁটগাছের মঁগ ডাঁলটা মঁরমর কঁরে ভেঁঙে পঁড়েছে, মাঁনে আঁমি এঁই গাঁছ ছেঁড়ে চঁলে গেঁলাম। যাঁ এঁবার বাঁড়ি চঁলে যাঁ’।

অভয় কিছু বলারই সুযোগ পেল না। সে যেন প্রায় হাওয়ায় উড়ে নিজের গ্রামের প্রান্তে পৌঁছে গেল। পরদিন রাত থাকতে উঠে অভয় একটা গরুর গাড়ি জোগাড় করল ও নিজের খুব কাছের দুই একজন বন্ধুকে নিয়ে সেই বটগাছের নিচে পৌঁছাল। বটগাছের নিচের মাটি খুঁড়ে সত্যই আট ঘড়া মোহর পাওয়া গেল। দুই তিন বন্ধু ধরাধরি করে সেই ঘড়াগুলি গরুর গাড়িতে তুলল। ঘড়াগুলি গাড়িতে তোলা হয়ে যেতেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে গাছের মগডাল আপনা-আপনি মড়মড় করে ভেঙে গেল।

এরপর অভয়দের যে অবস্থা ফিরে গেল তা বলাই বাহুল্য। সেই ভাঙা বাড়ি মেরামত হল। ঠাকুর, চাকর, লেঠেলে আবার বাড়ি গমগম করতে লাগল। সত্যি অভয়দের বাড়ি আবার একটা জমিদার বাড়ি হয়ে উঠল। অভয় ও ব্রহ্মদত্যির গল্প নানাভাবে পল্লবিত হয়ে লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল। আর ওই দত্যির মাঠও লোকের মুখে আটঘড়া মাঠ নামে পরিচিতি লাভ করল।

আজ আর ফাঁকা মাঠ নেই। অনেক বাড়িঘর হয়ে গেছে সেই তেপান্তরের মাঠে। অনেক লোকের বাস সেখানে। রাস্তাঘাট সবই হয়েছে। কিন্তু আজও ওই অঞ্চলের নাম আটঘড়াই থেকে গেছে।