গত পাঁচদিন ধরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি চলেছে। লোকে ঘরের বাইরে বেরতে পারে না, হাট বসে না, বাজার বন্ধ, নদীতে বান এসেছে। পথে লোক চলাচলও বন্ধ। কাঠ, ঘুঁটে কিছুই পাওয়া যায় না। অনেকের বাড়িতেই রান্না হয় না। শুকনো চানা-মটর, চিঁড়ে চিবিয়ে খেয়ে অনেকে জীবনধারণ করছে। সাধু একনাথেরও সেই দশা।
হঠাৎ সাধু একনাথের দরজায় ঘন ঘন ঘা পড়ল। একনাথ তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলেন। তিনজন লোক ভিজতে ভিজতে বাড়িতে প্রবেশ করল। তারা শীতে থর থর করে কাঁপছিল। সাধু একনাথ ব্যস্ত হয়ে বাড়ির ভিতর গিয়ে দু’খানা ছেঁড়া ময়লা শাড়ি এনে দু’জনকে পরতে দিলেন। আর নিজে গামছা পরে নিজের কাপড়খানা আরেকজনকে পরতে দিলেন। অতিথিদের কাছে শুনলেন যে গত তিন দিন ধরে তাদের কিছু খাওয়া হয়নি।
একনাথ তাঁর গিন্নিকে বললেন তিনজনের জন্য রান্না করতে। গিন্নি বললেন, ‘ঘরে আটা, ডাল তো আছে, কিন্তু জ্বালানী কাঠ নেই। কী করে রান্না করি? আপনি তো তা জানেন ঠাকুর?’
একনাথ অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ঘরের চারিদিকে চাইতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ স্ফূর্তির সঙ্গে বললেন, ‘গিন্নি, কুড়ুলটা কোথায় আছে দাও তো’। গিন্নি কুড়ুলটা এনে স্বামীর হাতে দিয়ে অবাক হয়ে ভাবতে লাগলেন যে স্বামী এই দুর্যোগে কোথায় কাঠ কাটতে যাচ্ছেন!
গৃহিণী ভাণ্ডারঘরে ঢুকে হাঁড়িকুড়িগুলো নাড়াচাড়া ক’রে দেখতে লাগলেন কী দিয়ে অতিথির সেবা করা যেতে পারে। হঠাৎ তাঁর কানে গেল শোবার ঘর থেকে আসা কাঠ কাটার শব্দ। শোবার ঘরে ছুটে এসে গৃহিণী দেখলেন— তাঁদের শোওয়ার ঘরের খাটটাকে তাঁর স্বামী কুড়ুল দিয়ে চিরে ফেলে জ্বালানি কাঠ জোগাড় করছেন। গৃহিণী তো অবাক! একনাথ বললেন, ‘গিন্নি, এই নাও, তাড়াতাড়ি রান্না করো গে!’
গিন্নি বললেন, ‘তা না হয় করছি, কিন্তু এ কী কাণ্ড!’ একনাথ বললেন, ‘গিন্নি, খাট একটা ছিল, হয়তো আবার কিছুকাল পরে আর একটা হবে। আজ অতিথি না খেয়ে চলে গেলে এমন অতিথি আর কোথায় পাব? দুঃখ কোরো না।’ গৃহিণী বললেন, ‘প্রভু, আমার মাথায় কি এত বুদ্ধি আছে? সত্যিই আপনার উপস্থিত বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। আমার মাথাতেই আসেনি যে ঘরেই এত শুকনো কাঠ জমা রয়েছে। সত্যিই তো, খাটখানা ঘরে অকারণেই ছিল। মেঝেয় বিছানা পেতে অনায়াসে আমরা ঘুমোতে পারব। লক্ষ লক্ষ লোক তো মেঝেতেই শুয়ে থাকে। আমার কিছুমাত্র দুঃখ নেই। প্রভু, আজ আমাদের মুখ রক্ষা হল, ধর্ম রক্ষা হল।’ এই বলে গৃহিণী সাধুর পায়ের ধুলো নিয়ে পরম উৎসাহে রান্না করতে চলে গেলেন।
ঋণ: পুরাকথিকা। চলিত করেছেন ঝিলমিল বসু।