Categories
সংগ্রামগড় |

হ্যারি পটারের জন্মদাত্রী

1118 |
Share
| ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
জয়তী ভট্টাচার্য

বিজ্ঞাপনকর্মী ও প্রাক্তন রেডিওকর্মী

চিত্র সৌজন্য: Wikipedia, jkrowling.com

শহরের এক ব্যস্ততম ক্যাফে, এক কোনায় একটা টেবিলে বসে মাথা নিচু করে টাইপ রাইটারে অনবরত টাইপ করছেন বছর তিরিশের এক মহিলা। মাঝেমাঝে থমকে গিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় বুঁদ হয়ে যাচ্ছেন। টেবিলের পাশে রাখা আছে একটা প্র্যাম, সেই প্র্যামে শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে তাঁর দেড় বছরের শিশু। এইভাবে কেটে যায় দিনের পর দিন, তিনি প্রতিদিন গিয়ে বসেন তাঁর ওই নির্দিষ্ট টেবিলে। ক্যাফের কোলাহল তাঁকে স্পর্শও করতে পারে না। তিনি মন দিয়ে লেখেন, শুধু লিখেই যান। কিন্তু কে জানত, কয়েক বছরের মধ্যে ওই মহিলাই হয়ে উঠবেন বিশ্ববিখ্যাত লেখক, জে কে রাওলিং। আর তাঁর লেখা কাল্পনিক চরিত্র হ্যারি পটার হয়ে যাবে সকলের প্রিয়।

একটি অনুষ্ঠানে নিজেকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাওলিং বলেছেন ‘আমার জীবনে সাফল্য একদিনে আসেনি। বারংবার আমার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে, আমি হেরে গেছি। বিষন্নতার সম্মুখীন হয়েছি, তবু মাথা নিচু করিনি। লড়াই চালিয়ে গেছি।’ এ যেন রূপকথার চরিত্র হ্যারি পটারেরই গল্প বা বলা যায় আমাদের মত সাধারণ মানুষগুলোর গল্প, যারা বারবার ভাগ্যের কাছে পরাজিত হয়েও লড়াই চালিয়ে যাই। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, তবু দু’চোখে থাকে সফল হওয়ার অদম্য আশা।

রাওলিংয়ের জীবনও ছিল আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতোই। ১৯৬৫ সালে স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবারাতে জন্ম হয় রাওলিংয়ের। বাবা ছিলেন এয়ারক্র্যাফট ইঞ্জিনিয়ার, আর মা ছিলেন সাইন্স টেকনিশিয়ান। তাই ছোটবেলা থেকেই তাঁর একাকিত্বের একমাত্র সঙ্গী ছিল বই। কল্পনায় ঘেরা রঙিন বইয়ের রাঙা ভাবনায় ডুবে থাকতো তাঁর শিশুমন। আর সম্ভবত সেই কল্পনার আত্মপ্রকাশই ঘটেছিল তাঁর মাত্র ছয় বছরের লেখা বই ‘র‍্যাবিট’-এ। তাঁর বয়সি বাচ্চারা যখন মাঠে খেলতে যেত, তিনি তখন মন দিয়ে পড়তেন আর তারপর নিজের ছোট বোনকে সামলে রাখার জন্য বানিয়ে বানিয়ে রূপকথার গল্প শোনাতেন। এভাবেই বড় হতে লাগলেন রাওলিং, দু’চোখে তাঁর লেখক হওয়ার স্বপ্ন।

এর মধ্যেই মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন, অনেক ডাক্তার দেখানোর পর অনেকদিন বাদে ধরা পড়ল সিরোসিস। ততদিনে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে বহুবার আবেদন করেও ফল না পাওয়ায় রাওলিং ভর্তি হয়েছেন এক্সেটার ইউনিভার্সিটিতে। এই সময় একদিন ম্যানচেষ্টার থেকে লন্ডনে যাচ্ছিলেন ট্রেনে চড়ে। ট্রেনে ছিল সাংঘাতিক রকমের ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যেই টানা ৪ ঘণ্টা কাটাতে হয় রাওলিংকে। এই সময় হঠাৎই তার মাথায় আসে বাবা-মা-হারা হ্যারির কথা। যে প্রতিদিন অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করেও পালিত হচ্ছে তার এক পিসি-পিসেমশাইয়ের কাছে। সে জানে না আগামী দিনে তার জীবনে কী অপেক্ষা করে আছে, এমনকি তার জানা নেই যে তার মধ্যে আছে মায়াবী জাদুকরী ক্ষমতা। বাড়ি ফিরে এই ভাবনার ওপর ভিত্তি করেই শুরু হয় লেখা। কিন্তু ততদিনে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন তাঁকে বারবার বলছেন, রোজগার করে এই বিপদের সময় পরিবারের পাশে দাঁড়াতে। কী করবেন ভাবতে ভাবতেই মাত্র ২৫ বছর বয়সে মাকে হারান রাওলিং। ভাগ্যের পরিহাস বারবার মেনে নিলেও, এইবার ঘটে বড় বিপর্যয়। যে মায়ের জন্য তিনি লিখছিলেন, তাঁকেই লেখার কথা জানাতে না পারার দুঃখ তাঁকে প্রতি মুহূর্তে গ্রাস করতে শুরু করে। ততদিনে অবশ্য হ্যারি পটারের তিনটে পার্ট লেখা শেষ। কিন্তু চতুর্থ ভাগ আর লেখা হল না। ১৯৯২ সালে মাকে হারানোর দুঃখ ভুলতে রাওলিং লেখক হওয়ার স্বপ্ন ভুলে এডিনবারা ছেড়ে পাড়ি দিলেন পর্তুগাল। সেখানেই একজনকে ভালবেসে বিয়েও করেন তিনি। কিন্তু এবারও ভাগ্য সদয় হল না। বিয়ের মাত্র ১৩ মাসের মধ্যে সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে স্বামীর অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পেতে ডিভোর্স নিয়ে তাঁকে আবার ফিরে আসতে হল এডিনবারাতে।

যে অবসাদ ভুলতে তিনি শহর ছেড়েছিলেন, জীবন আবার তাঁকে সেই অবসাদের সমুদ্রেই ঠেলে ফেলে দিল। আর সেই জন্যই বোধহয় জীবন থেকে নিষ্কৃতি পেতে আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন রাওলিং, কিন্তু তাতে ফল হল উলটো। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে জীবনকে আবার নতুনভাবে চিনলেন তিনি। তাই যা আগে কখনও করেননি এবার সেই কাজই শুরু করলেন। নিষ্ঠা আর একাগ্রতাকে সঙ্গী করে জীবন খাদের কিনারায় দাঁড়িয়েও নিজেকে মেলে দিলেন কল্পনার রাজ্যে। আবার শুরু করলেন লেখা।

প্রতিদিন ক্যাফেতে বসে লিখতেন আর নানা পাবলিশার্সের কাছে লেখা পাঠাতেন। জেরক্স করে বা কম্পিউটারে টাইপ করে পাঠানোর পয়সা ছিল না বলে নব্বই হাজার শব্দের উপন্যাস বারবার টাইপ-রাইটারে টাইপ করে পাঠাতেন তিনি। এভাবে ১২জন পাবলিশার্সের থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে অবশেষে লন্ডনের ছোট্ট পাবলিশিং হাউস ব্লুমসবেরি তাঁর লেখা ছাপতে আগ্রহী হন। যদিও এর পিছনে একটা বড় কারণ ছিল ব্লুমসবেরি পাবলিশিং হাউসের সিইও-র ৮ বছরের মেয়ে। লেখাটা পড়ে ওর ভাল লেগে যায় বলেই ১৯৯৭ সালের ২৬ জুন অবশেষে প্রকাশিত হয় ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য ফিলোসফার্স স্টোন’। এরপরের ইতিহাস সকলেরই জানা। একেবারে অচেনা-অজানা জে কে রাওলিং হয়ে যান বিশ্ববিখ্যাত। যে রাওলিংকে এর আগে তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন ছাড়া কেউ চিনতেন না, রাতারাতি হাজার হাজার কপি বই বিক্রির পর তিনি হয়ে যান সকলের পরিচিত।

এরপর অবশ্য রাওলিংকে আর কোনওদিন পিছনে ঘুরে তাকাতে হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি ‘স্কটিশ আর্টস কাউন্সিল’ থেকে আট হাজার ডলারের গ্রান্ট পান, লেখা চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এর পাঁচমাসের মধ্যেই ‘নেস্টলে স্মার্টিস বুক পুরস্কার’ পান তিনি। তার কয়েকদিনের মধ্যেই ‘ব্রিটিশ বুক আওয়ার্ডে’ ‘চিলড্রেন বুক অফ দ্য ইয়ার’ পুরস্কারও হাতে আসে তাঁর। এরপর তাঁর বই কোন পাবলিশিং হাউস থেকে ছাপা হবে সেই নিয়ে বিরাট অকশান সভাও বসে।

আর সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হল সেইসময় জে কে রাওলিংয়ের লেখা হ্যারি পটার সিরিজের বই কেনার জন্য মানুষ প্রকাশিত হওয়ার আগের দিন রাত থেকে বইয়ের দোকানে দোকানে লাইন দিতেন। আর সম্ভবত সেই কারণেই ১৯৯৮ সালে হ্যারি পটার সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘হ্যারি পটার এন্ড দ্যা চেম্বার অফ সিক্রেট’ মুক্তি পাওয়ার পরই অক্টোবর মাসে পৃথিবী বিখ্যাত প্রোডাকশন হাউস ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স’ সিনেমার জন্য এই বই দুটির স্বত্ব মোটা টাকায় কিনে নেন। ২০০১ সালে সিনেমা হিসেবে মুক্তি পায় হ্যারি পটার সিরিজের প্রথম বই।

এইভাবে চলতে চলতেই ২০০৭ সালের ২১শে জুলাই মুক্তি পায় হ্যারি পটার সিরিজের সপ্তম বই ‘হ্যারি পটার এন্ড দ্য ডেথলি হ্যালোস’— যা সিনেমার পর্দায় দুটো আলাদা আলাদা ভাগে মুক্তি পেয়েছিল ২০১০ এবং ২০১১ সালে। তৎকালীন তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালে এক বিলিয়ন ডলারের মালিক হন রাওলিং এবং এই সময় পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই ছিলেন ‘Top Earning Author’ আর তাঁর লেখা সবকটা বই ছিল ‘Best Seller’।

বিখ্যাত হয়েও রাওলিং কিন্তু তাঁর অতীতকে ভুলে যাননি। তিনি তাঁর উপার্জিত টাকার অনেকটাই দান করেন নিউরো-রোগীদের চিকিৎসার উদ্দেশে আর বাকি টাকার অনেক অংশই তিনি দুস্থ শিশুদের শিক্ষার জন্য দিয়ে দেন। তবে এখানেই থেমে যায়নি তাঁর জয়যাত্রা। এরপরও তাঁর লেখা বহু বই ‘বেস্ট সেলার’ হিসেবে বিক্রি হয়েছে দোকানে দোকানে। মাঝেমধ্যে আবার তিনি ছদ্মনামেও লিখতেন। যেমন ‘রবার্ট গালব্রেইথ’ ছদ্মনামে তিনি ‘দ্য কুকুস কলিং’ নামের একটি বই লেখেন ২০১৩ সালে। তাঁর এই বইটি যখন প্রকাশিত হয় তখন খুব বেশি কপি বিক্রি হয় নি। কিছুদিনের মধ্যে প্রকাশ পেয়ে যায় যে, এই বইটি রাওলিংয়ের লেখা। এরপর কয়েকশো কপি কয়েকদিনের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়।

তবে রাওলিং নানাধরনের লেখা লিখলেও, হ্যারি পটার ছিল তাঁর নিজের লেখা শ্রেষ্ঠ চরিত্র। তিনি বারবার বিভিন্ন জায়গায় হ্যারিকে নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন ‘আমার জীবনের সব ওঠাপড়া, আনন্দ-দুঃখ দিয়ে আমি হ্যারিকে তৈরি করেছি। আমার মায়ের মৃত্যুর পর আমি বুঝতে পেরেছিলাম অভিভাবক হারানোর শোক কাকে বলে, সেই দুঃখের অনুভূতিগুলোই আমি হ্যারির মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছি’। আবার ম্যাজিক প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রাওলিং একজায়গায় বলেছিলেন ‘In magic, man has to believe in himself’। আসলে তিনি নিজেও হয়তো এই ম্যাজিকেই বিশ্বাস করেন, সম্ভবত তাই সব বাধা-বিপত্তির পর ক্রনিক ডিপ্রেশন নিয়েও তিনি লিখেছেন এবং নিজেকে বিশ্বাস করেছেন। তাই একটা সময় গোটা পৃথিবী তাঁর কল্পরাজ্যকে সত্যি বলেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছে।

রাওলিংয়ের জীবনের গভীরে ডুব দিলে বোঝা যাবে তিনি শুধুমাত্র নিজের লক্ষে স্থির ছিলেন বলেই অবিরাম জীবনযুদ্ধে প্রবল সংগ্রাম করে সাফল্যের শিখরে আরোহণ করতে পেরেছিলেন। জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ক্রমাগত ঝড় তাঁকে তুমুল আঘাত করেছে এবং তিনি ভেঙে পড়েছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বারবার পড়ে গিয়ে, বারবার ধুলো ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন। জীবনের নানা দরজা যখন তাঁর মুখের ওপর বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, তখনও তিনি নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছেন। লিখে গেছেন। আর তাই অনেক কষ্টের পরেও একদিন তাঁর জীবনে সাফল্য এসেছে।

ঋণ: jkrowling.com, Wikipedia, English Speeches (You Tube), Inspire Yourself (You Tube), biography.com, Minutes Videos (You Tube)