Categories
মানুষপাহাড় |

সদাই ফকিরের পাঠশালা

1789 |
Share
| ১০ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
সৌরভ মাহান্তী

কবি ও বাংলা সাহিত্যের ছাত্র

চিত্র সৌজন্য: thebetterindia.com

পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের অন্তর্গত একটি গ্রাম, যার নাম— উত্তর রামনগর। সেখানের একজন শিক্ষক, শিক্ষার অন্ধকার দু’হাত দিয়ে মুছে দিয়ে নতুন আলো ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন ২০০৪ সাল থেকে আজ পর্যন্ত। সুজিত চট্টোপাধ্যায়, পূর্ব বর্ধমানের উত্তর রামনগর গ্রামের বাসিন্দা। ছোটবেলাতে উত্তর রামনগর জুনিয়র হাইস্কুলে পড়াশোনা করার পর বোলপুরের বাঁধগড়া হাইস্কুল থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে স্নাতক এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর হন। পরে তিনি বি.টি পাশ করেন। ১৯৬৫ সালে তিনি শিক্ষকতায় যোগ দেন রামনগর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। প্রায় ৪০ বছর ধরে চাকরি করার পর তিনি ২০০৪ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন।

কিন্তু অবসর নিলে কি হবে? যাঁর রক্তে মিশে আছে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মন্ত্র তিনি কীভাবে চুপচাপ বসে থাকেন? অবসরের পর কয়েকজন ছাত্র বহুদূর থেকে তাঁর কাছে টিউশন পড়ার জন্য আসে। সুজিতবাবু খুশি হন। কিন্তু মাস্টারমশাই পড়াবেন কোথায়? তিনি স্কুলের কাছেই একটি রুমে বিনা পারিশ্রমিকে পড়ানোর জন্য আবেদন করেন। কিন্তু পাননি। পরে তাঁর বারান্দায় তিনি শুরু করেন পাঠশালা। তাঁর কাছে যারা পড়তে আসে তারা প্রায় সকলেই তফসিলি জাতি ও উপজাতি সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়ে। আজ এক এক করে মাস্টারমশাইয়ের ছাত্রসংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশোজন। প্রথমে তিনি সকল ছাত্রের কাছে মাত্র এক টাকার বিনিময়ে পড়ানোর বেতন নিতেন। এখন বেতন বেড়ে হয়েছে দুই টাকা। সেটিও বছর শেষে। এই বাজারে দুই টাকাতে হয়না কিছুই। কিন্তু মাস্টারমশাই এই দু’টাকার বেশি এক টাকাও নিতে নারাজ। গুরুদক্ষিণা হিসেবে এই দু’টাকা তাঁর কাছে অনেক। ছাত্রছাত্রীরা বছর শেষে উপহার দেয় চকোলেট। নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের কলা বিভাগ পড়ান তিনি। তবে, প্রয়োজন মতো পড়িয়ে দেন অন্যান্য বিষয়গুলোও। এমনকি, স্নাতক স্তরে বাংলাও পড়ান তিনি। নিজেকে ‘সদাই ফকির’ বলতেই ভালোবাসেন তিনিও। ‘লিখে রেখো একফোঁটা দিলেম শিশির’ এই হলো ফকিরের মুখের কথা। সকাল থেকে সন্ধ্যা, বছরের পর বছর শিক্ষার্থীদের বিশাল জ্ঞানসমুদ্রে এই একটি ফোঁটাই শিশির বিলিয়ে দিতে চেয়েছেন তিনি।

শুধুমাত্র শিক্ষার অন্ধকার মোচনেই এগিয়ে আসেননি এই মানুষটি, এগিয়ে এসেছিলেন এই ভয়ংকর লকডাউনের দিনগুলোতেও। এই লকডাউনের ‘দিন আনি দিন খাই’ পরিবারের কাছে আর্থিক সহায়তা করেছেন তিনি। অন্যদিকে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের পাশেও রয়েছেন বছরভর। বছর শেষে তাদের হাতেও তুলে দেন আর্থিক সহযোগিতা। এই সমস্তকিছুই চলে তার পেনশনের টাকাতে। বাড়িতে স্ত্রী শয্যাশায়ী। তাঁরও চিকিৎসা চলছে।

সুজিতবাবুর কাছে পড়েছেন পরপর বর্ধমানের বহুমানুষ। আজ সেই মানুষের নাম শুধুমাত্র বর্ধামনেই নয়, ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশের বাড়িতে বাড়িতে। ২০২১ সালের পদ্মশ্রী সম্মান পাচ্ছেন সুজিতবাবু। আসলে এই সমস্ত সম্মান, পুরস্কার কিছুই নয়। একটা কথা খুব মনে পড়ে ‘কাজগুলো থেকে যাবে . . . ’ এই কথা যাঁদের মাথায় ঢুকেছে তারা যেন সবকিছু ভুলে নিজের কাজটুকু করে যান। টাকার জন্য আটকায় না কিছুই। মাস্টারমশাই পেরেছেন। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া এই সমাজের বুকে এমন মাস্টারমশাই পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। আর সেই মাস্টারমশাই যখন পদ্মশ্রী সম্মান পাচ্ছেন, তখন স্বাভাবিক ভাবেই খুশি হয়েছেন শিক্ষার্থীরা ও গ্রামবাসীরা।