Categories
পুরনো পরগণা |

নরহরি দাস

1087 |
Share
| ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

১৮৬৩-১৯১৫। বাংলা শিশুসাহিত্যের স্তম্ভ। লেখক, চিত্রকর, বিজ্ঞানী, সংগীতজ্ঞ এবং মুদ্রণশিল্পে অগ্রণী গবেষক। 'সন্দেশ' পত্রিকা প্রকাশ করেন ১৯১৩ সালে।

অলংকরণ: উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী

যেখানে মাঠের পাশে বন আছে, আর বনের ধারে মস্ত পাহাড় আছে, সেইখানে, একটা গর্তের ভিতরে একটি ছাগলছানা থাকত৷ সে তখনও বড়ো হয় নি, তাই গর্তের বাইরে যেতে পেত না৷ বাইরে যেতে চাইলেই তা মা বলত, ‘যাসনে! ভালুকে ধরবে, বাঘে নিয়ে যাবে, সিংহে খেয়ে ফেলবে!’ তা শুনে তার ভারি ভয় হত, আর সে চুপ করে গর্তের ভিতর বসে থাকত৷ তারপর সে একটু বড়ো হল, তার ভয়ও কমে গেল৷ তখন তার মা বাইরে চলে গেলেই সে গর্তের ভিতর থেকে উঁকি মেরে দেখত৷ শেষে একদিন একেবারে গর্তের বাইরে চলে এলে৷

সেইখানে এক মস্ত ষাঁড় ঘাস খাচ্ছিল৷ ছাগলছানা আর এত বড়ো জন্তু কখনও দেখেনি৷ কিন্তু তার শিং দেখেই সে মনে করে নিল, ওটাও ছাগল, খুব ভালো জিনিস খেয়ে এত বড়ো হয়েছে৷ তাই সে ষাঁড়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘হ্যাঁগা, তুমি কী খাও?’

ষাঁড় বললে, ‘আমি ঘাস খাই৷’

ছাগলছানা বললে, ‘ঘাস তো আমার মাও খায়, সে তো তোমার মতো এত বড়ো হয় নি!’

ষাঁড় বললে, ‘আমি তোমার মায়ের চেয়ে ঢের ভালো ঘাস অনেক বেশী করে খাই৷’

ছাগলছানা বললে, ‘সে ঘাস কোথায়?’

ষাঁড় বললে, ‘ঐ বনের ভিতর৷’

ছাগলছানা বললে, ‘আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে৷’ এ কথা শুনে ষাঁড় তাকে নিয়ে গেল৷

সেই বনের ভিতরে খুব চমৎকার ঘাস ছিল৷ ছাগলছানার পেটে যত ঘাস ধরল, সে তত ঘাস খেল৷ খেয়ে তার পেট এমনি ভারি হল যে, সে আর চলতে পারে না৷

সন্ধ্যে হলে ষাঁড় বললে, ‘এখন চল বাড়ি যাই!’

কিন্তু ছাগলছানা কি করে বাড়ি যাবে? সে চলতেই পারে না৷

তাই সে বললে, ‘তুমি যাও, আমি কাল যাব৷’

তখন ষাঁড় চলে গেল৷ ছাগলছানা একটা গর্ত দেখতে পেয়ে তার ভিতরে ঢুকে রইল৷

সেই গর্তটা ছিল এল শিয়ালের৷ সে তার মামা বাঘের বাড়ি নিমন্ত্রণ খেতে গিয়েছিল৷

অনেক রাত্রে ফিরে এসে দেখে, তার গর্তের ভিতর কি-রকম একটা জন্তু ঢুকে রয়েছে৷ ছাগলছানা কালো ছিল, তাই শিয়াল অন্ধকারের ভিতর ভালো করে দেখতে পেল না৷ সে ভাবল, বুঝি রাক্ষস-টাক্ষস হবে৷ এই মনে করে সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘গর্তের ভিতরে কে ও?’

ছাগলছানা ভারি বুদ্ধিমান ছিল, সে বললে—

‘লম্বা লম্বা দাড়ি
ঘন ঘন নাড়ি৷
সিংহের মামা আমি নরহরি দাস
পঞ্চাশ বাঘে মোর এক-এক গ্রাস!’

শুনেই তো শিয়াল ‘বাবা গো!’ বলে সেখান থেকে দে-ছুট! এমনি ছুট দিল যে একেবারে বাঘের ওখানে গিয়ে তবে সে নিশ্বাস ফেললে৷

বাঘ তাকে দেখে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলে, ‘কী ভাগ্নে, এই গেলে, আবার এখুনি এত ব্যস্ত হয়ে ফিরলে যে?’

শিয়াল হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ‘মামা, সর্বনাশ তো হয়েছে, আমার গর্তে একটা নরহরি এসেছে! সে বলে কিনা যে পঞ্চাশ বাঘে তার এক গ্রাস!’

তা শুনে বাঘ ভয়ানক রেগে বললে, ‘বটে, তার এত বড়ো আস্পর্ধা! চল তো ভাগ্নে! তাকে দেখাব কেমন পঞ্চাশ বাঘে তার এক গ্রাস!’

শিয়াল বললে, ‘আমি আর সেখানে যেতে পারব না মামা, আমি সেখানে গেলে যদি সেটা হাঁ করে আমাদের খেতে আসে, তাহলে তুমি তো দুই লাফেই পালাবে৷ আমি তো তেমন ছুটতে পারব না, আর সে বেটা আমাকেই ধরে খাবে!’

বাঘ বললে ‘তাও কি হয়? আমি কখনও তোমাকে ফেলে পালাব না৷’

শিয়াল বললে, ‘তবে আমাকে তোমার লেজের সঙ্গে বেঁধে নিয়ে চল৷’

তখন বাঘ তো শিয়ালকে বেশ করে লেজের সঙ্গে বেঁধে নিয়েছে, আর শিয়াল ভাবছে, ‘এবারে আর বাঘ মামা আমাকে ফেলে পালাতে পারবে না৷’

এমনি করে তারা শিয়ালের গর্তের কাছে এল৷ ছাগলছানা দূর থেকেই তাদের দেখতে পেয়ে শিয়ালকে বললে—

‘দূর হতভাগা! তোকে দিলুম দশ বাঘের কড়ি,
এক বাঘ নিয়ে এলি লেজে দিয়ে দড়ি!’

শুনেই তো ভয়ে বাঘের প্রাণ উড়ে গিয়েছে! সে ভাবলে যে, নিশ্চয় শিয়াল তাকে ফাঁকি দিয়ে নরহরি দাসকে খেতে দেবার জন্য এনেছে৷ তারপর সে কি আর সেখানে দাঁড়ায়? সে পঁচিশ হাত লম্বা এক-এক লাফ দিয়ে শিয়ালকে সুদ্ধ নিয়ে পালাল৷ শিয়াল বেচারা মাটিতে আছাড় খেয়ে, কাঁটার আঁচড় খেয়ে, খেতের আলে ঠোক্কর খেয়ে একেবারে যায় আর কি! শিয়াল চেঁচিয়ে বললে, ‘মামা, আল! মামা, আল!’ তা শুনে বাঘ ভাবে বুঝি সেই নরহরি দাস এল, তাই সে আরও বেশি করে ছোটে! এমনি করে সারা রাত ছুটোছুটি করে সারা হল৷

সকালে ছাগলছানা বাড়ি ফিরে এল৷

শিয়ালের সেদিন ভারি সাজা হয়েছিল৷ সেই থেকে বাঘের উপর তার এমনি রাগ হল যে, সে রাগ আর কিছুতেই গেল না।