বিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রহরে বিশ্বপ্রকৃতির উদার প্রাঙ্গণে ছেলেদের মুক্তি দেবার জন্য রবীন্দ্রনাথ তৈরি করলেন শান্তিনিকেতন-বিদ্যালয়।
শান্তিনিকেতন-বিশ্বভারতী বয়ে নিয়ে চলেছে রবীন্দ্রনাথের সারা জীবনে কর্মসাধনার পরিচয়। এই সাধনা তাঁর মতে, মনুষ্যত্বসাধনা। এই সাধনায় যাঁরা স্থপতি, এই সহযোগীর দল, এঁরা আশ্রমের সৃষ্টিকার্যে নিজেদের সর্বতোভাবে উৎসর্গ করেছিলেন। এই সঙ্গী কর্মী এবং বন্ধুদের কথাই ধরা রয়েছে ‘শান্তিনিকেতনের গোড়ার কথা’য়।
আজ কালীমোহন ঘোষের কথা।
‘যখন এ কথা কাউকে ব’লে ক’য়ে বোঝাতে পারলুম না যে, আমাদের স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষিপল্লীতে, তার চর্চা আজ থেকেই শুরু করা চাই, তখন কিছুক্ষণের জন্যে কলম কানে গুঁজে এ কথা আমাকে বলতে হল— আচ্ছা আমিই এ কাজে লাগব। এই সংকল্পে আমাকে সহায়তা করবার জন্যে সেদিন একটিমাত্র লোক পেয়েছিলুম, সে হচ্ছে কালীমোহন। শরীর তার রোগে জীর্ণ, দু-বেলা তার জ্বর আসে, তার উপরে পুলিসের খাতায় তার নাম উঠেছে। . . . ঔষধের বাক্স খুলে আমি নিজেই তাঁর চিকিৎসা করতুম। মনে করতুম তাঁকে বাঁচাতে পারব না।’
১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ বার্লিন থেকে চিঠি লিখছেন নির্মলকুমারী মহলানবিশকে। তাঁর সাহিত্যসাধনার মধ্যেও পল্লীসংস্কার যে কতটা জায়গা জুড়ে ছিল, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি শিলাইদহের জমিদারি পরিদর্শনের সময়। স্বদেশি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক নেতারা তাঁর পরিকল্পনায় কর্ণপাত করেননি। কিন্তু দূরদর্শী রবীন্দ্রনাথ একাই উদ্যোগী হন পল্লীসঞ্জীবনের লক্ষ্য নিয়ে। এই কাজে তাঁকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কালীমোহন ঘোষ। কালীমোহন কোচবিহার রাজ কলেজে তাঁর উচ্চশিক্ষা ছেড়ে জড়িয়ে পড়েন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে। তিনি ছিলেন অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য। পূর্ববাংলার প্রত্যন্ত গ্রামেগঞ্জে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে তখন তিনি সক্রিয় সংগ্রামী। বিদেশি পণ্য-বর্জনের ডাক দিয়েছেন সোচ্চারে। বাংলাদেশের গ্রামের সাধারণ নিরক্ষর মানুষের সঙ্গে তো বটেই, শিক্ষিত নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। এর মূল কারণ, তাঁর সহৃদয় আচরণ আর অসাধারণ বাগ্মীতা। এই দুটি মহৎ গুণ পরবর্তীকালে বিশ্বভারতী তথা শ্রীনিকেতনের উন্নতিকল্পে কাজে লেগেছিল।
ঢাকা-বিক্রমপুর অঞ্চলে ইংরেজ-শাসন বিরোধী প্রচার করতে করতেই তাঁর সঙ্গে ক্ষিতিমোহন সেনের পরিচয় ও মিত্রতার সূত্রপাত। ক্ষিতিমোহনের সান্নিধ্য তাঁকে আরও উদ্বুদ্ধ করে। ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘শুনিলাম, একদল স্বদেশি প্রচারক গ্রামে আসিয়াছেন। বৈকালে গ্রামের সভামধ্যে তাঁহাদের দেখিলাম। তাঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বক্তা, আর কেহ কেহ গান করেন। সকলের মধ্যে দেখিলাম কালীমোহন ঘোষই যেন প্রাণস্বরূপ। শরীরে কিছুই নাই, অথচ উৎসাহ-পরিপূর্ণ চিত্ত, তাহারই সাক্ষ্য দিবার উপযুক্ত দুইটি চক্ষু। গ্রামের পুরস্ত্রীরা এই প্রিয়দর্শন যুবকটিকে স্নেহে ও বাৎসল্যে একেবারে ঘরের ছেলে করিয়া লইয়াছেন।’ এই সময় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ। বঙ্গভঙ্গ, স্বদেশি আন্দোলন নিয়ে তাঁদের দীর্ঘ আলোচনা ও মতবিনিময় দুজনকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। পল্লীসেবার কাজে সক্রিয়ভাবে তিনি যোগ দিলেন জমিদারি শিলাইদহ অঞ্চলে। ভূপেশচন্দ্র রায়, অনঙ্গমোহন চক্রবর্তী, প্যারীমোহন সেন আর অক্ষয়চন্দ্র সেন ছিলেন তাঁর নিত্যসঙ্গী। তাঁদের নিয়েই পল্লী-সংগঠনের সূত্রপাত।
এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন গ্রাম-উন্নয়নের কাজ করে তিনি প্রচুর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। সেই সময় পূর্ববাংলার লালন ফকির সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। তাঁদের কাছ থেকে প্রচুর বাউলগান সংগ্রহ করেন কালীমোহন ঘোষ।
অনেকেরই দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, কালীমোহন সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সদস্য। তাঁর ওপর বরাবর পুলিশের নজরদারি ছিল। শোনা যায়, ১৯০৬ থেকে ১৯০৯ সাল পর্যন্ত বাংলা ও আসাম পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ কালীমোহনের রাজনৈতিক যোগাযোগ ও কার্যকলাপ নিয়ে একটি গোপন রিপোর্ট তৈরি করেছিল।
১৯০৭ সালে শান্তিনিকেতনের শিশুবিভাগে তিনি যোগ দেন। এর মূল কারণ, পল্লীঅঞ্চলে নিয়মিত ঘোরাঘুরির ফলে তাঁর স্বাস্থ্য ক্রমশ ভেঙে পড়েছিল। শান্তিনিকেতনের কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়ে একদিকে শারীরিক আবার অন্যদিকে মানসিক স্বাস্থ্যেরও প্রভূত উন্নতি হয়। হীরেন্দ্রনাথ দত্ত লিখছেন, ‘কালীমোহনবাবুর মহৎ গুণ— কাজের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা। যে কাজই দেওয়া হত, সে কাজটিই তিনি প্রাণ দিয়ে করতেন। বেশ কিছুদিন তিনি শিশুদের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন, গৃহাধ্যক্ষ হিসেবে ছোটোদের আবাসগৃহে তাদের সঙ্গেই তিনি থাকতেন। তাদের সুখসুবিধার প্রতি তাঁর প্রখর দৃষ্টি ছিল। মিষ্টভাষী মিশুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন বলে ছোটদের সঙ্গে ভাব জমাতে তাঁর একটুও বিলম্ব হত না। পড়াতেন বাংলা এবং ইতিহাস। পুরনো ছাত্রদের মুখে শুনেছি তিনি ক্লাসে গ্রীক রোমান ইতিহাসের কাহিনি পড়ে শোনাতেন আর অতিশয় স্বদেশবৎসল মানুষ ছিলেন বলে সেইসঙ্গে ভারতীয় বীরদের শৌর্যবীর্যের কাহিনিও খুব গর্বের সঙ্গে জাঁকিয়ে বলতেন। ছেলেরা খুব রোমাঞ্চিত বোধ করত।’
রবীন্দ্রনাথের সহযোগিতায় ১৯১২ সালে কালীমোহন ভর্তি হন ইংল্যান্ডের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। উদ্দেশ্য ছিল, ইংরেজি সাহিত্যপাঠ এবং শিশুদের শিক্ষাপদ্ধতি অনুশীলন। সেই বছর প্রকাশিত হয়েছে ‘গীতাঞ্জলি’। ইংল্যান্ডের পণ্ডিতমহলে সমাদৃত হচ্ছে সেই কাব্য। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গী হিসেবে কালীমোহনের বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে ওঠে ডব্লিউ বি ইয়েটস, এজরা পাউন্ড, এইচ জি ওয়েলস, রোটেনস্টাইনের সঙ্গে। ‘পিতৃস্মৃতি’তে রথীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘কালীমোহন ঘোষ ও আমি বহু সন্ধ্যা যাপন করেছি ইয়েটসের চিলেকোঠায়, অনেক রাত অবধি গল্পগুজবে কেটেছে। বাবার কাছে নিত্যনতুন লোকের আনাগোনা চলছে। আমি ও কালীমোহনবাবু এদিকে আমাদের উদ্বৃত্ত সময়টুকু কাটাচ্ছি ইয়েটস ও এজরা পাউন্ডের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে।’
ইংল্যান্ড থেকে ফিরে আসতে হয় কালীমোহনকে। যেসব সুহৃদ বিদেশে যাওয়া-আসা ও পঠনপাঠনের জন্য অর্থসাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তাঁরা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। দেশে ফিরে এসে তিনি আবার পূর্ণ উদ্যমে যোগ দেন শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের কাজে।
রবীন্দ্রনাথের নির্দেশ অনুসারে শ্রীনিকেতন পল্লী-সংগঠন বিভাগ আরম্ভ করেন লেনার্ড নাইট এলমহার্স্ট এবং কালীমোহন। ১৯২২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শুভ সূচনা হয় এই কার্যক্রমের। কালীমোহনের জ্যেষ্ঠপুত্র শান্তিদেব লিখছেন, ‘এলমহার্স্ট প্রথমেই পিতৃদেবের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে শ্রীনিকেতনের নিকটবর্তী কয়েকটি গ্রামের মানুষদের সামগ্রিক জীবনের পরিচয় নিলেন। . . . ’ এইভাবে তাঁরা গ্রামটিকে চিনলেন, তার ভৌগোলিক অবস্থান, সেখানকার মানুষের রোজকার জীবনযাত্রা, তাদের অভাব-অভিযোগ-চাহিদা বোঝার চেষ্টা করলেন। গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনাকে তাঁরা দুটি স্তরে ভাগ করেন। শিক্ষিত অভিজ্ঞ মানুষ থাকবেন শিক্ষা আর স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বে। এর জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং পরিকল্পনা তৈরি করবেন এলমহার্স্ট। এর সঠিক প্রয়োগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন কালীমোহন। ঋণদান ব্যাংক, ধর্মগোলা, কৃষি-সমবায়, স্বাস্থ্য-সমবায়, শিক্ষা-সমবায়, শিল্প-সমবায় শুরু হল এ পথে। আজকের পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা, স্বরোজগার বা কো-অপারেটিভ তৈরির বহু আগেই কালীমোহন ছিলেন এই উন্নয়নমূলক কাজের পথিকৃৎ। এর সঙ্গে ছিল তাঁর ব্রতীবালক দল। গ্রামবাসীদের সাহায্য নিয়েই তৈরি হয়েছে গ্রামের পথঘাট, সংস্কার হয়েছে ডোবা। ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার, ম্যালেরিয়া-নিবারণী সমিতি বা অস্পৃশ্যতা-বর্জন সমিতির মতো সংগঠনের উল্লেখ করলেই বোঝা যাবে গ্রামে ঠিক কী কী ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিলেন তাঁরা। মনে রাখা দরকার, এই কাজে প্রথম বাধা সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন ইংরেজ শাসক। তাদের সন্দেহ ছিল, এই কাজের পিছনে কোনও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে। যদিও পরবর্তীকালে এই সন্দেহ দূর হয়। ১৯২৭ সালে বাংলা সরকার যখন দরিদ্র গ্রামবাসীদের উন্নতির উপযোগী একটি শিক্ষামূলক প্রদর্শনী-ট্রেনের ব্যবস্থা করেন, সেই প্রদর্শনী পরিচালনার কাজে তাঁরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কালীমোহন ঘোষকে। বাংলাদেশের তিরিশটি স্টেশনে এই ট্রেন থামে, অসংখ্য সাধারণ মানুষ এই ট্রেনে উঠে অভিনব প্রদর্শনীটি দেখার সুযোগ পান।
কালীমোহনের কাজের পরিধি শুধুমাত্র শ্রীনিকেতনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বীরভূম জেলা প্রশাসনের সহায়তায় শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের অধ্যাপক-কর্মী-ছাত্রদের নিয়ে ব্রতীবালক দল গঠন করে তিনি বোলপুরে অসংখ্য মেলা পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে যেমন রয়েছে জয়দেব-কেঁদুলির মেলা, তেমনই রয়েছে শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা।
অসাধারণ বাগ্মীতার জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন তিনি। জনসংযোগের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। বিশ্বভারতীর অর্থ-সংকটে তিনি আবেদন-পত্র নিয়ে চলে যেতেন উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের রাজা-মহারাজাদের কাছে। ১৯২৭ সালে হায়দ্রাবাদের নিজামের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা অনুদান নিয়ে আসেন কালীমোহন।
রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ তাই বোধহয় লিখেছিলেন—
কালীমোহনের অশেষ গুণ
যে তারে জানে—সেই জানে
দীনদুখে হৃদয়ে জ্বলে আগুন
অবিচার সহে না প্রাণে।।
ঋণ: আমার পিতৃদেব: শান্তিদেব ঘোষ; শান্তিনিকেতনের একযুগ: হীরেন্দ্রনাথ দত্ত; রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন: প্রমথনাথ বিশী; রবীন্দ্র-পরিকর: পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়; রবিজীবনী: প্রশান্ত কুমার পাল